গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় দুই ঘণ্টা পড়েছিল মনসুর by শরিফ রুবেল

সেদিন মনসুরের পুরো শরীর রক্তে ভেজা ছিল। রক্ত গড়িয়ে রাস্তার দুই ফুট জায়গা জুড়ে লাল হয়ে যায়। পরদিন পর্যন্ত রাস্তায় ছোপ ছোপ রক্ত জমে ছিল। ওরা একটা না, আমার ভাইকে দু’টি গুলি করেছে। গুলি খেয়ে পড়ে যাওয়ার পরও বেধড়ক পিটিয়েছে। তলপেটে গুলি ঢুকে পেছনে আটকে যায়। ভাইটা আমার গুলি খেয়ে ২ ঘণ্টা রাস্তায় পড়ে ছিল। কাউকে আসতে দেয়া হয়নি। অনেক সময় মাটিতে পড়ে ছটফট করেছে। দুইবার উঠে দাঁড়াতে গেছে। পারেনি, মাটিতে পড়ে গেছে। ওরে উদ্ধার করতে র‌্যাব সেদিন কাউকেই এগিয়ে আসতে দেয়নি। তারা মুহুর্মুহু গুলি ছুড়েছে। গুলির ভয়ে কেউ মনসুরের কাছে যাওয়ার সাহস পায়নি। মনসুর বছিলা ব্রিজের নিচেই পড়ে ছিল। আমরা সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে মনসুরের নিথর দেহ রাস্তা থেকে তুলে হাসপাতালে রওনা হই। হাসপাতালে যাওয়ার পথে পুলিশ আমাদের বাধা দেয়। বছিলা ৪০ ফিট এলাকায় পুলিশ আমাদের মারধর করে। পুলিশ তখন বলে, সোজা বাসায় যা, হাসপাতালে যেতে দেবো না। আন্দোলনে আসবি, গুলি খাবি না, তাতো হবে না। গুলিই তোদের জন্য উচিত শিক্ষা। পুলিশের বাধা উপেক্ষা করেই আমরা মনসুরকে কাঁধে করে মোহাম্মদপুর তিন রাস্তার মোড় পর্যন্ত যাই। সেখান থেকে অটোরিকশায় করে বেড়িবাঁধ হয়ে ঢাকা মেডিকেলে যাই। মেডিকেলে নিতে নিতে আমার ভাইয়ের শরীরের সব রক্ত পড়ে গেছে। রক্তে আমার পুরো শরীরের সব কাপড় ভিজে যায়। মনে হয়, হাসপাতালে নিতে নিতেই আমার ভাই মারা গেছিল। ওরা আমার ভাইকে বাঁচতে দেয়নি। সময়মতো হাসপাতালে নিতে পারলে, হয়তো ভাইটাকে বাঁচাতে পারতাম। আমার ভাই কোনো রাজনীতি করতো না। একটি তেলের পাম্পে চাকরি করতো। কাজ শেষে ফেরার পথে তাকে গুলি করা হয়। সঠিক বিচার চাই। হত্যাকারীদের শাস্তি দেখতে চাই। তাহলে আমার মনটা শান্তি পাবে।

মানবজমিন-এর কাছে এমনভাবেই ছোটভাই হত্যার স্মৃতিচারণ করছিলেন নিহত মনসুর মিয়ার বড়ভাই আয়নাল হক। আয়নাল হক মানবজমিনকে বলেন, মনসুরের একটি ১০ বছরের ছেলে আছে। নাম রিমন। ও এখনো বুঝতে পারেনি যে, কী হারিয়েছে। তবে  যেদিন মনসুর দুনিয়া ছেড়ে চলে গেছে, সেদিন থেকেই রিমন আমার ছেলে। আমি ওর বাবা। বাকি জীবনে ওরে বাবা হারানোর দুঃখ বুঝতে দিবো না ইনশাআল্লাহ্‌।

১৯শে জুলাই শুক্রবার জুমার নামাজ শেষে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় মোহাম্মদপুর। আল্লাহ্‌ করিম বাসস্ট্যান্ড থেকে বছিলা ব্রিজ পর্যন্ত আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ, র‌্যাব, এপিবিএন ও এসবি’র সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয় আন্দোলনকারীদের। পুলিশ, র‌্যাব সেদিন নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরাও আগ্নয়াস্ত্র নিয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। ওই এলাকায় র‌্যাব’র হেলিকপ্টার থেকে অতর্কিত গুলি ছোড়া হয়। গুলিতে অনেকেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ওইদিন মোহাম্মদপুর এলাকায় দুপুর ২টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত সংঘর্ষ চলে। এতে অন্তত ১১ জন মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। নিহত মনসুরের পরিবারের অভিযোগ, সেদিন র‌্যাব’র গুলিতেই মারা যায় মনসুর। র‌্যাব তাদের কার্যালয় থেকে বের হয়ে গুলি ছুড়তে ছুড়তে লোকজনকে ধাওয়া দেয়। ব্রিজের ঢালের আশপাশের অলি-গলিতে র‌্যাব নির্বিচারে গুলি ছুড়েছে। ওই গুলিতেই আমার ভাই মাটিতে পড়ে যান। গুলিবিদ্ধ অবস্থায়ই হামাগুড়ি দিয়ে কাঠপট্টি ব্রিজের নিচ পর্যন্ত যায়। পরে ওখানেই মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আর আগাতে পারেনি। মনসুর বাসার দিকে যেতে চেয়েছিল। সেদিন গুলিতে অনেকে হতাহত হয়েছে। অনেকে মারা গেছেন বলে শুনেছি। অনেকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে ছিলেন। আশপাশের বিল্ডিংয়ের ছাদেও গুলি ছোড়া হয়েছিল। ১৯শে জুলাই ভয়ঙ্কর একদিন দেখেছে বছিলাবাসী।

পারিবারিক সূত্র বলছে, নিহত  মো. মনসুর মিয়া একজন তেলের পাম্পকর্মী ছিল। বয়স ৪২ বছর। এক সন্তানের পিতা। ছেলে স্থানীয় একটি মাদ্রাসার ৪র্থ  শ্রেণির ছাত্র। বাড়ি মোহাম্মদপুরের বছিলা উত্তরপাড় মোল্লা মার্কেট এলাকায়। গত ১৯শে জুলাই বছিলা র‌্যাব-২, সদরদপ্তরের পাশে বছিলা ব্রিজের ঢালে কাঁচাবাজার গলিতে গুলিবিদ্ধ হন মনসুর। পরে তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেলে নেয়া হলে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ময়নাতদন্ত শেষে গভীর রাতে মনসুরের লাশ রায়েরবাজার কবরস্থানে দাফন করা হয়।

No comments

Powered by Blogger.