নজরদারি ও আড়িপাতা প্রযুক্তির ব্যবহার নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি

ভিন্নমত দমন ও নাগরিক অধিকার দমনের জন্য দেশে গত কয়েক বছর কী কী ধরনের সফ্‌টওয়্যার ও প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে তার শ্বেতপত্র প্রকাশের দাবি করা হয়েছে   নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে। গতকাল রাজধানীর বেসিস সম্মেলন কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠানে এই দাবি জানানো হয়। অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেন, গত ১০ বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার অত্যাধুনিক সফ্‌টওয়্যার ও প্রযুক্তি আড়িপাতার জন্য কেনা হয়েছে। ইসরাইল ও অন্যান্য দেশ থেকেও করদাতাদের অর্থে কেনা এই সফ্‌টওয়্যার কোন বিবেচনায় ক্রয় করা হলো, কোন পদ্ধতিতে হলো এবং এগুলো কী কাজে ব্যবহার করা হয়েছে সে ব্যাপারে নাগরিকদের জানার অধিকার আছে। বক্তারা বলেন, জাতীয় নিরাপত্তার কথা বলে এ সব দামি সফ্‌টওয়্যার কেনা হলেও তা মূলত ব্যবহার হয়েছে রাজনৈতিক কারণে ও ভিন্নমত দমানোর জন্য। বেসিসের প্রাক্তন সভাপতি ফাহিম মাশরুরের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত ‘আড়িপাতা, গোপনীয়তার অধিকার ও বাক-স্বাধীনতা’- শীর্ষক এই নাগরিক সংলাপে উপস্থিত ছিলেন রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, মানবাধিকারকর্মী, সাংবাদিক ও তথ্য-প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। আলোচকরা বলেন, দেশের সংবিধানে ৪৩ ধারায় প্রতিটি নাগরিকের গোপনীয়তার অধিকার সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। কিন্তু তা সত্ত্ব্বেও সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক টেলিযোগাযোগ আইনের কিছু ধারা ব্যবহার করে। গত বেশকয়েক বছর টেলিকম নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে নিয়মিতভাবে সাধারণ নাগরিকদের ফোন ট্যাপ করা হয়েছে। এটি করা হয়েছে কোনো ধরনের বিধি না মেনে কিছু ব্যক্তি বিশেষের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী।

আলোচনার ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এনটিএমসি ও ডিওটি’র মতো সরকারি যে সব অঙ্গপ্রতিষ্ঠান গত কয়েক বছর এই আড়িপাতার সঙ্গে জড়িত ছিল তাদের সংস্কার করা বা নতুন লোক বসিয়ে কোনো সমাধান হবে না। এই দুই প্রতিষ্ঠানকে বিলুপ্ত করতে হবে এখনই। জাতীয় নিরাপত্তার জন্য আড়িপাতার প্রয়োজনীয়তা থাকলে সেটির জন্য আলাদা কমিশন করে নতুন বিধিবিধান তৈরি করতে হবে। মানবাধিকারকর্মী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, আদালতের ঘাড়ে বন্দুক ব্যবহার করে গত কয়েক বছর অনেক মানবাধিকার হরণের ঘটনা ঘটেছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ও আগের মতো অপ্রাসঙ্গিক ও দুর্বল মামলা এবং রিমান্ডে বিভিন্ন আসামির বক্তব্য মিডিয়ায় প্রকাশের প্রতিবাদ জানান। তিনি গত কয়েক বছর মিডিয়াতে বিভিন্ন ব্যক্তির কল রেকর্ড ফাঁসের ঘটনায় মিডিয়ার নৈতিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্য-প্রযুক্তি অধ্যাপক মইনুল হোসেন বলেন, দেশের কোনো আইন যদি আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড বা মানের সঙ্গে না হয়, তাহলে তার পরিবর্তন করতে হবে। সাংবাদিক গোলাম মুর্তজা বলেন, পেগাসাসসহ যে সব ইসরাইলি পণ্য কেনা হয়েছে এবং কেনার সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে যেসব বেআইনি কাজ করা হয়েছে, এই কাজগুলো কার নির্দেশে হয়েছে, কোন প্রক্রিয়াতে হয়েছে, টাকা কীভাবে পরিশোধ করা হয়েছে, এটা বর্তমান সরকারের কাছে সুনির্দিষ্ট হিসেবে জানতে চাই। এনটিএমসিতে বসে মানুষের ফোন কল যে রেকর্ড করা হচ্ছে, এটি দিয়ে কার নিরাপত্তা রক্ষা করা হয়েছে? হাছান মাহমুদ মাঝে-মধ্যেই হুমকি দিতেন। বলতেন, আমাদের কাছে সব তথ্য আছে ফাঁস করে দেবো। আমার কথা রেকর্ড করার অধিকার তাকে কে দিয়েছিল। কোন সংবিধান দিয়েছিল।

আলোচনায় অংশ নিয়ে আল-জাজিরা খ্যাত অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সামি জানান, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পরে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ও কাছের মানুষের ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল তথ্য, কল রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া গেছে। যা এনটিএমসি ও অন্যান্য এজেন্সির মাধ্যমে জোগাড় ও সংরক্ষণ করা হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।  এগুলো দিয়ে তাদেরকে নিয়মিতভাবে ব্ল্যাকমেইল করা হতো বিশেষ প্রয়োজনে। তিনি বলেন, গোপনীয়তা ভঙ্গকারী রাষ্ট্রের এই এজেন্সিগুলো শুধুমাত্র সাধারণ নাগরিক ও ভিন্নমতাবলম্বীদের নজরদারি করতেই ব্যবহার হতো না, নিজেদের লোকজনের কার্যক্রমও মনিটর করতে ব্যবহার হতো। অবিলম্বে সকল ব্যক্তিগত ও গোপনীয় রেকর্ড ধ্বংস করার দাবি জানান তিনি। মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অপরাধীদের শনাক্তকরণ এবং বিচারের স্বার্থে অভিযুক্ত ব্যক্তির তথ্য সংগ্রহের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে কিন্তু তা হতে হবে অবশ্যই আদালতের নির্দেশক্রমে। এনটিএমসি যা করেছে তার সম্পূর্ণভাবে সংবিধান এবং আইন-বহির্ভূত। বিটিআরসি’র চেয়ারম্যানের গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের জন্য সোর্স মানি অর্থ কোথায় ব্যয় হয়েছে তাও তদন্ত করা দরকার। বিদেশে যেহেতু অধিদপ্তর এ রূপান্তর করা হয়েছে তাই ডট এর প্রয়োজন নেই। ডট কে বিটিআরসি’র সঙ্গে একীভূত করা প্রয়োজন। আমরা ১০-১১ বছর কেন ঘুমিয়ে থাকলাম? ইন্ডাস্ট্রি গণমাধ্যম এবং নাগরিক সমাজ এমনকি রাজনৈতিক দলগুলোকে কেন কথা বলতে দেখলাম না আমরা এতদিন? বিভিন্ন টেলিভিশন এবং ডিজিটাল বিন্যাসে নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ হলো দিনের পর দিন কিন্তু কেউ প্রশ্ন করল না এই ভিডিও রেকর্ড বা কল রেকর্ড তারা কোথায় পেলেন। অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন- রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. জাহেদ উর রহমান, সাংবাদিক গোলাম মুর্তজা, সাংবাদিক আশরাফ কায়সার, রাজনীতিবিদ জুনায়েদ সাকি, এবি পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার ফুয়াদ, সাইবার বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির, মুঠোফোন গ্রাহক এসোসিয়েশন সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ, প্রাইভেসি বিশেষজ্ঞ সাবহানাজ রশিদ দিয়া, আইনজীবী ব্যারিস্টার মিতি সানজানা, তথ্য-প্রযুক্তি সাংবাদিক ও উদ্যোক্তা জাকারিয়া স্বপন, রাষ্ট্র চিন্তার দিদার ভূঁইয়া, উন্নয়ন গবেষক আহমেদ ওমর তৈয়ব প্রমুখ।

No comments

Powered by Blogger.