পানি কমছে ফুটছে ক্ষত

উজান থেকে নেমে আসা ঢল ও অতি ভারী বর্ষণে সৃষ্ট বন্যার পানি নামতে শুরু করেছে। স্বস্তি ফিরছে আতঙ্কে দিন পার করা বন্যার্ত এলাকার বাসিন্দাদের। তবে পানি যত কমছে ততই দৃশ্যমান হচ্ছে ক্ষত। সর্বনাশা বন্যায় ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, ফসলি জমি থেকে শুরু করে সব কিছু। পানি নামার পর যখন সড়ক দৃশ্যমান হয় তখন দেখা যায় প্রতিটি সড়কই প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। বেশির ভাগ পিচঢালা সড়ক ভেঙে গেছে, স্রোতে ভেঙে গেছে সড়কের বিভিন্ন অংশ। যেগুলো নতুন করে সংস্কার করা ছাড়া কোনো যানবাহন চলার উপায় নেই। ফেনীর সব উপজেলা থেকেই পানি নামছে। ভয়াবহ বন্যা পরিস্থিতি থেকে ক্রমেই উন্নতির দিকে যাচ্ছে কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, নোয়াখালী, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, লক্ষ্মীপুর ও কক্সবাজার। তবে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন নদীর পানি বৃদ্ধি পেতে পারে।

নতুন করে কোনো জেলা প্লাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব কামরুল বলেন, বন্যার কবলে পড়েছে ১১ জেলার ৭৩ উপজেলা, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৫৪৫টি ইউনিয়ন ও পৌরসভা। এ পর্যন্ত ১০ লাখ ৪৭ হাজার ২৯টি পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সংখ্যা ৫২ লাখ ৯ হাজার ৭৯৮ জন। মারা গেছেন ১৮ জন। গতকাল পরশুরাম, ফুলগাজী, ছাগলনাইয়া, সদরের যে সব এলাকা থেকে পানি নেমেছে সেসব এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরেছে। অনেকে অনেকদিন পর স্বজনের সন্ধান পেয়েছেন। সেখানে দেখা যায় প্রায় সব সড়কই বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত। কোনো সড়কই ঠিক নেই। যার কারণে পানি কমলেও ত্রাণবাহী যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। আবু বকর নামে পরশুরামের এক বাসিন্দা বলেন, অনেকদিন পর পরিবারের খোঁজ পেয়েছি। এলাকার মানুষের তীব্র খাদ্য সংকট রয়েছে। অনেকে দীর্ঘ সময় না খেয়ে আছেন। পরশুরামের আরেক বাসিন্দা বলেন, এলাকায় খাদ্য ও সুপেয় পানির সংকট রয়েছে। এদিকে পানি কমেছে ফুলগাজী, ছাগলনাইয়াও। সেখানকার বাসিন্দারা জানান, পানি কমলেও এখানে খাদ্যের সংকট রয়েছে। সদরে যত পানি নামছে ততই দৃশ্যমান হচ্ছে সড়ক ও অবকাঠামোর ক্ষয়ক্ষতি। ঢাকা চট্টগ্রাম হাইওয়ের বিভিন্ন স্থানে মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্রোতে ভেঙে গেছে সড়ক। এদিকে সোনাগাজী ও দাগনভূঞা পানি কমলেও সেটি অনেক কম। এ দুই উপজেলার অধিকাংশ মানুষ পানিবন্দি। এখনো দুর্গম অনেক এলাকায় পৌঁছায়নি ত্রাণ সহায়তা। তাই মানবেতর জীবন পার করছেন এসব এলাকার বাসিন্দারা। তাছাড়া জেলার বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণবাহী ট্রাক পৌঁছালেও নৌকার স্বল্পতার কারণে সেগুলো দুর্গম অঞ্চলে পৌঁছানো যাচ্ছে না। গতকাল সকাল ৯টায় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের বুলেটিনে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও ফেনী জেলার ভারতীয় ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী অঞ্চলে এবং ত্রিপুরা প্রদেশে তেমন বৃষ্টি হয়নি। এতে উজানের নদ-নদীর পানি সমতল হ্রাস অব্যাহত রয়েছে। ফলে মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, ফেনী, কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের নিম্নাঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি অব্যাহত আছে। আগামী ২৪ ঘণ্টায় ফেনীর বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে কোনো কোনো স্থানে স্থিতিশীল থাকতে পারে। আবহাওয়া সংস্থার বরাত দিয়ে বলা হয়েছে, আগামী ২৪ ঘণ্টায় দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও এর কাছাকাছি উজানে ভারী বৃষ্টিপাতের শঙ্কা নেই।

বন্যার পানিতে ডুবে গেছে কুমিল্লার আরও একটি উপজেলা। গোমতী নদীর বাঁধ ভেঙে ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার বেশির ভাগ গ্রাম ডুবে যায়। শনিবার বিকাল থেকে পানি আসতে শুরু করলেও সন্ধ্যায় ডুবে যায় উপজেলার মানুষের বাড়িঘর। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২২শে আগস্ট রাতে গোমতীর বুড়িচং উপজেলার বুরবুড়িয়া এলাকায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করে। রাতেই প্লাবিত হয় বুড়িচং উপজেলা। এতে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি হয় উপজেলা জুড়ে। শনিবার সেই পানি প্রবেশ করে পার্শ্ববর্তী ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায়। এ ছাড়া সকালে ব্রাহ্মণপাড়া এলাকায় ঘুংঘুর নদীর বাঁধ ভেঙে উপজেলায় পানি ঢুকতে থাকে। এখন পর্যন্ত ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার চার ইউনিয়নের ২৩ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

লক্ষ্মীপুরে বন্যার আরও অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে থাকা জেলার ৫টি উপজেলার বেশির ভাগ এলাকার মানুষ। পানিবন্দি অন্তত ৮ লাখ বাসিন্দা। প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। চারদিকে এখন বানভাসি মানুষের হাহাকার। এরই মধ্যে দেখা দিয়েছে ত্রাণ ও সুপেয় পানির সংকট। স্থানীয় এলাকাবাসী ও জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, গত ২০ বছরের পর এত পানি আর জলাবদ্ধতা দেখেনি লক্ষ্মীপুরের মানুষ। গত দুইদিন ধরে ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যার পানি রহমতখালী ও ডাকাতিয়া খাল হয়ে লক্ষ্মীপুরে ঢুকে পড়ছে।  বিশেষ করে ৫টি উপজেলা, চারটি পৌরসভা ও সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলের মান্দারী, চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, বাঙ্গাখাঁ, লাহারকান্দি ও উত্তর জয়পুরসহ ৪০টি ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। কোথাও কোথাও প্রায় চার থেকে ৬ ফুট পানিতে ডুবে আছে জনপদ। এতে করে সরকারি হিসেবে ৭ লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। কিন্তু বাস্তবে তা আরও বেশি। ঘরবাড়ি ছেড়ে অনেকেই শিশু সন্তান নিয়ে ছুটছেন আত্মীয়স্বজন ও বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও আশ্রয়ণ কেন্দ্রগুলোতে। এখন পর্যন্ত ২০ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। শুক্রবার বিকাল থেকে জেলার অনেক এলাকা বিদ্যুৎবিহীন হয়ে অর্ধলক্ষাধিক মানুষ দুর্ভোগে রয়েছে। জেলা প্রশাসক সুরাইয়া জাহান বলেন, শনিবার পর্যন্ত সাড়ে ৬ লাখ মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। তবে সে সংখ্যা আরও বাড়বে। পাশাপাশি ১৮৫টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র ও ৬৬টি মেডিকেল টিম প্রস্তুত রাখা হয়েছে। ইতিমধ্যে প্রায় ২০ হাজারের মতো মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। অন্যদের উদ্ধারে কাজ করা হচ্ছে। এ ছাড়া ৫৭৬ টন চাল, নগদ প্রায় ১১ লাখ টাকা, শিশু ও গো-খাদ্যের বরাদ্দ পাওয়া যায়। সেগুলো উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্তদের দেয়া হচ্ছে। আরও বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। সবাই মিলে এই দূর্যোগ মোকাবিলা করা হবে।

ফেনীর উজানের পানিতে নোয়াখালীর বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। এতে পানিবন্দি রয়েছে প্রায় ২১ লাখ মানুষ। বন্যাদুর্গত এলাকায় দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানি ও খাদ্য সংকট। অন্যদিকে, খাদ্য সংকট ও সাপের উপদ্রবে দুয়ে মিলে নাকাল বন্যাদুর্গতরা। অনেকের কাটছে নির্ঘুম রাত। রোববার দুপুরের দিকে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট নোয়াখালী জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) সৈয়দ মহিউদ্দিন আব্দুল আজিম বলেন, গত তিন দিনে নোয়াখালীতে ৬৩ জনকে সাপে কেটেছে। এর মধ্যে গত ২৪ ঘণ্টায় নতুন করে সাপে কেটেছে ২৮ জনকে। বন্যার কারণে ডায়রিয়া আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে ১০৮ জন। সেনবাগ উপজেলার বাসিন্দা মো. আবুল খায়ের জানান, ফেনীর মুহুরী নদীর উজানের পানি প্রবেশ করায় জেলার সেনবাগ, বেগমগঞ্জ, সোনাইমুড়ী উপজেলার আরও নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এসব উপজেলায় গত দু’দিন বৃষ্টি না হলেও উজানের পানিতে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। অনেক জায়গায় ঘরবাড়ি ও সড়ক তলিয়ে গেছে। স্কুলে ঢুকে পড়েছে পানি। দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট। কবিরহাটের বাসিন্দা ফরমান হোসেন বলেন, বন্যা ও ভারী বর্ষণের কারণে কবিরহাটের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। এদিকে দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষ কাজ করতে না পেরে মানবেতর জীবনযাপন করছে। কর্মহীন মানুষেরা সাহায্যের আবেদন জানিয়েছেন সরকার ও বিত্তশালীদের কাছে। নোয়াখালী জেলা আবহাওয়া অধিদপ্তরের উচ্চ পর্যবেক্ষক আরজুল ইসলাম বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় ৩২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। উজানের পানিতে বন্যার পানি বাড়ছে। বন্যাকবলিত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জেলার ৮টি উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষ পানিবন্দি হয়ে আছেন। প্রতিটি বাড়িতে ৩ থেকে ৫ ফুট জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। নিচু এলাকাগুলো যার পরিমাণ ৬ থেকে ৭ ফুট। বসতঘরে পানি প্রবেশ করায় বুধবার রাত পর্যন্ত অনেকে খাটের উপর অবস্থান করলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে তারা নিকটস্থ আশ্রয়কেন্দ্র, প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে অবস্থান নিয়েছেন। বসত ও রান্নাঘরে পানি ঢুকে পড়ায় খাবার সংকটে রয়েছে বেশির ভাগ মানুষ। জেলার প্রধান সড়কসহ প্রায় ৮০ ভাগ সড়ক কয়েক ফুট পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বেশির ভাগ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হয়েছে। সড়কগুলোতে যান চলাচল অনেকটাই কম।

No comments

Powered by Blogger.