শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলিবর্ষণের ভিডিও নিয়ে তোলপাড়
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চলমান আন্দোলনের একপর্যায়ে সরকার পদত্যাগের আন্দোলনে রূপ নেয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ৫ই আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয় এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। সরকার পতনের পর শামীম ওসমান ও তার সহযোগীরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।
এদিকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সময় ১৯শে জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে অনেকগুলো হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহতের ঘটনায় শেখ হাসিনা, স্থানীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানসহ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে বেশ কয়েকটি হত্যা মামলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ১৯শে জুলাই বিকালে শহরের চাষাঢ়া বঙ্গবন্ধু সড়কে আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য শামীম ওসমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা সশস্ত্র অবস্থায় মিছিল বের করে। একটি উঁচু ভবনের উপর থেকে মুঠোফোনে ২৯ সেকেন্ডের ভিডিওটি ধারণ করা।
ভিডিও চিত্রে দেখা যায়, শামীম ওসমান ও তার কয়েক শতাধিক অনুসারী আগ্নেয়াস্ত্র ও ধারালো অস্ত্র নিয়ে শহরের চাষাঢ়া এলাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সড়কে শহরের ২ নম্বর রেলগেট এলাকার দিকে ধাওয়া দিচ্ছে। সেখানে শামীম ওসমানের শ্যালক তানভীর আহমেদ (টিটু) গুলি ছোড়ে।
দুটি আগ্নেয়াস্ত্র হাতে ছিল টেলিভিশন চ্যানেল ডিবিসি নিউজ ও যুগান্তর পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি রাজু আহমেদ। আরও ছিল, শামীম ওসমানের আত্মীয় (অয়ন ওসমানের শ্বশুর) ফয়েজ উদ্দিন লাভলু, তার ছেলে মিনহাজুল ইসলাম ভিকি ও শীতল পরিবহন বাসের পরিচালক অনুপ কুমার সাহা, ১২ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি নিয়াজুল ইসলাম, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাত হোসেন ভূঁইয়া সাজনু প্রমুখ। মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর আব্দুল করিম বাবু ও তার ছেলে এমআরকে রিয়েনও গুলি চালিয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মহড়ায় শামীম ওসমানের ভাতিজা আজমেরী ওসমান, মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আশরাফুল ইসমাইল রাফেল প্রধান, মহানগর ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান সম্রাট, সাধারণ সম্পাদক রাসেল প্রধান উপস্থিত ছিল। তারা আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য করে গুলি চালিয়েছে বলে জানান প্রত্যক্ষদর্শীরা। দেশ রূপান্তর পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি কমল খানকেও অস্ত্রের মহড়ায় দেখা যায়। গুলি করে শামীম ওসমানের ছেলে ইমতিনান ওসমান অয়নের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ছাত্রলীগ নেতা কাউসার আহমেদও।
১৯শে জুলাই শামীম ওসমানের নেতৃত্বে গুলি চালানোর ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন বেশ কয়েকজন সাংবাদিক। তারা জানান, সেদিনের পরিস্থিতি ছিল ভীতিকর। ওই পরিস্থিতিতে ছবি ও ভিডিওধারণের কোনো সুযোগ ছিল না। ভিডিওধারণ করতে গিয়ে একজন সাংবাদিক মারধরেরও শিকার হন।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বঙ্গবন্ধু সড়কের চাষাঢ়া থেকে মণ্ডলপাড়া মোড় পর্যন্ত শামীম ওসমান ও তার বাহিনী কয়েক দফায় আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। এই সময় শতাধিক গাড়ির বহর ব্যবহার করে তারা। তারা গাড়ি নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সংযোগ সড়কের জালকুড়ি এলাকাতেও আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি ছোড়ে। এ ছাড়া চাষাঢ়া-আদমজী চিটাগাংরোড সড়ক দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জেও মহড়া দেয়।
ওদিকে ১৯শে জুলাই জুমার নামাজের পর যখন শামীম ওসমান তার বাহিনী নিয়ে আন্দোলনকারীদের ওপর মুহুর্মুহু গুলি ছোড়েন তখন বঙ্গবন্ধু সড়কের নয়ামাটি এলাকার চারতলা ভবনের ছাদে খেলছিল ছয় বছর বয়সী রিয়া গোপ। রিয়ার বাবা ব্যবসায়ী দীপক কুমার গোপ সাংবাদিকদের তখন জানিয়েছিলেন, ‘গুলির শব্দ শুনে তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে মেয়েকে আনতে ছাদে যান। ছাদ থেকে শিশুকন্যাকে কোলে নেয়ার পরই রিয়ার মাথার পেছনের দিকে একটি গুলি লাগে। রক্তে ভেসে যায় দীপক কুমারের হাত।’ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারের পর ২৪শে জুলাই হাসপাতালে মারা যায় রিয়া।
বঙ্গবন্ধু সড়কে শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলি করার ভিডিওটি নিজের ফেসবুক একাউন্টে শেয়ার করেছেন সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বিও। ভিডিওর ক্যাপশনে তিনি লিখেছেন, ১৯শে জুলাই ২০২৪, শুক্রবার বিকালে নারায়ণগঞ্জ শহরে শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর অস্ত্রসন্ত্রাস। যোগাযোগ করা হলে রফিউর রাব্বি জানান, ১৯শে জুলাই শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলিতেই শিশু রিয়া গোপ নিহত হয়। তিনি বলেন, ঘটনার দিন ওই সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সেখানে ছিল না। তখন শামীম ওসমান তার সন্ত্রাসী বাহিনীকে নিয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর অসংখ্য গুলি ছুড়েন। প্রশাসনের অনুপস্থিতিতে মুহুর্মুহু গুলি ছোড়ার বিষয়টি থেকে বোঝা যায়, শামীম ওসমানদের গুলিতেই রিয়া গোপ মারা গেছে। এই বিষয়ে প্রশাসনের নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানান তিনি। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নারায়ণগঞ্জের সমন্বয়ক ফারহানা মানিক বলেন, ওই দিন (১৯শে জুলাই) ওই এলাকায় কোনো পুলিশ সদস্য ছিলেন না। কার গুলিতে রিয়া গোপের মৃত্যু হলো, সেটি প্রশাসনকে খুঁজে বের করতে হবে।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, শামীম ওসমান, তার ছেলে অয়ন ওসমান ও তাদের অনুসারী শাহ নিজামের নামে অস্ত্রের লাইসেন্স রয়েছে। এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) আমীর খসরু গণমাধ্যমকে জানান, অস্ত্রের মহড়া দিয়ে গুলি করার ভিডিওটি আমাদের নজরে এসেছে। সেখানে কারা, কী ধরনের অস্ত্র ব্যবহার করেছেন, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। লাইসেন্সকৃত বৈধ অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার করে থাকলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। গুলিবিদ্ধ হয়ে শিশু রিয়া গোপের মৃত্যুর বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেদিন ওই এলাকায় কোনো পুলিশ সদস্য ছিলেন না। কার গুলিতে রিয়া গোপের মৃত্যু হয়েছে, সেটি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
দুই সাংবাদিক বরখাস্ত: ওই ভিডিও ছড়িয়ে পড়ার পর পেশাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হওয়ার অভিযোগে শনিবার রাতে দৈনিক যুগান্তর ও ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষ নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি রাজু আহমেদকে বরখাস্ত করেন। ডিবিসি নিউজ কর্তৃপক্ষ ও যুগান্তর কর্তৃপক্ষ তাদের অনলাইনে প্রকাশিত সংবাদে বলেন, একটি জাতীয় দৈনিক সংবাদপত্রে প্রচারিত প্রতিবেদন কর্তৃপক্ষের দৃষ্টিগোচর হলে পেশাবহির্ভূত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এই আদেশ ২৪শে আগস্ট থেকে কার্যকর করেছে কর্তৃপক্ষ।
ওদিকে রোববার দুপুরে দেশ রূপান্তরের নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি মো. মোবারক হোসেন খান কমল (কমল খান)কে বরখাস্ত করা হয়। সাংবাদিকসুলভ আচরণের পরিপন্থি কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে বলে পত্রিকাটি তাদের অনলাইনে প্রকাশ করেন। এই আদেশ ২৫শে আগস্ট ২০২৪ থেকে কার্যকর করেছে কর্তৃপক্ষ।
No comments