বেদে পল্লীতে একদিন by পিয়াস সরকার

এক ঘাটেতে রান্ধি-বাড়ি মোরা/আরেক ঘাটে খাই/মোদের বাড়ি ঘর নাই;/ সব দুনিয়া বাড়ি মোদের/ সকল মানুষ ভাই।
বহুল প্রচলিত এ স্লোক মনে করিয়ে দেয় বেদে জাতির কথা। যারা যাযাবর। তাদের নির্দিষ্ট কোনো ঘরবাড়ি নেই। এক সময় নৌকায় নৌকায় কাটতো বেদেদের দিন। নৌকায় ছিল তাদের ঘরবাড়ি। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ঘুরে বেড়াতো বেদেরা। সাপ ধরা, সাপের খেলা দেখানো, সিঙ্গা লাগানো, কবিরাজি ওষুধ বিক্রি, ঝাড় ফুঁক, চুড়ি ফিতা বিক্রি ছিল তাদের পেশা। এই সমাজের নারীরা মূলত প্রধান উপার্জক। কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে বেদেরা করেছে স্থায়ী বসতি। পাল্টিয়েছে পেশা। ঢাকার অদূরে সাভারের বংশী নদীর তীরে পোড়াবাড়ি, অমরপুর, কাঞ্চনপুর ও বাড্ডা গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন তারা। এই পল্লীতে তাদের বর্তমান সদস্য ২০ হাজারের ওপরে। স্থায়ী বসতির পাশাপাশি অনেকেই বদলে ফেলেছেন পেশা। তবে তাদের সংস্কৃতির বাহক সাপকে এখনো অনেকেই পেশা হিসাবে ধরে রেখেছেন।
বেদেনীরা সাধারণত রঙিন শাড়ি কিছুটা উঁচু করে কুচি ছাড়া পড়েন। সঙ্গে থাকে কিছুটা ছোট ব্লাউজ। আবার থ্রি-পিস পরলেও কোমড়ের কাপড় একটু ছোট এবং উঁচু। শাড়ি হোক কিংবা থ্রি-পিস শরীরের সঙ্গে টানটান করে পড়েন। প্রায় সকলের নাকে বড় নোলক শোভা পায়। পুরুষ বেদেদের দেখে চেনাটা দুষ্কর। তবে অধিকাংশের গলায় শোভা পায় রুদ্রাক্ষের মালা। বেদে-বেদেনি সবার মুখে পান সবসময়ের সঙ্গী।
বেদে পল্লীতে ঢুকতেই চোখে পড়ে অনেক পুরুষ তাস খেলায় মত্ত। ছেলেরা খেলছে ক্যারাম বোর্ড। তাস খেলতে খেলতে বেদে তৈয়ব আলী বলেন, বাপ দাদার পেশা, ছাড়তে পারি না। এই জন্যই সাপ নিয়ে আছি। আর সাপের সঙ্গে একটা মায়া তৈরি হয়ে গেছে। ইস্কানদার আলী বলেন, সাপের খেলা এখন আর মানুষ দেখে না। মেলা হলে সাপ নিয়ে খেলা দেখাতে যাই শুধু। আগের মত সাপ পাওয়াও যায় না। আগে মানুষের ঘরে সাপ ঢুকলে আমাদের ডাক দিত। আমরা সাপ ধরে নিয়ে আসতাম। ছোটবেলায় দেখেছি বর্ষাকালে সাপ ধরার জন্য প্রচুর ডাক আসতো। এখন মাসে দুই থেকে তিনটার বেশি ডাক আসে না। বেদে পল্লীর ভেতরে চোখে পড়ে বৃদ্ধা সালেহা বেগম তেল মালিশ করছেন আট বছরের একটি ছেলের পায়ে। সঙ্গে উচ্চ স্বরে মন্ত্র পড়ছেন। ছেলেটির বাবা রিকশাচালক আব্দুল কাদের মিয়া বলেন, ছেলের পা ভাঙছিল একবছর আগে। চিকিৎসা নিয়েছি মেডিকেলে। ভালো হয়ে গেছিল আবার পায়ে ব্যথা পায়। ডাক্তারের কাছে না নিয়ে এখানে আনার কারণ হিসাবে বলেন, ডাক্তারের কাছে নিলে অনেক খরচ। আর অনেকের কাছে শুনেছি সালেহা কবিরাজের মালিশে ভালো হয়ে যায় ব্যথা। মালিশ শেষে দ্বিগুণ স্বরে কাতরাচ্ছিল ছেলেটি। কবিরাজ একটি তাবিজ ধরিয়ে দিলেন। বললেন, ভক্তি নিয়ে কাল ফজরের নামাজ পড়ে ছেলেকে গোসল করিয়ে পরিয়ে দিতে। মালিশ এবং তাবিজে ৩০১ টাকা হাদিয়া পেলেন তিনি। বেদেদের সাপ ধরা ও সাপের খেলা দেখানোর পাশাপাশি আরেকটি উল্লেখযোগ্য পেশা ঝাড়-ফুঁক এবং ওষধ বিক্রি করা। তাও যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। সালেহা বেগম বলেন, আগে গ্রামে গ্রামে ওষুধ বিক্রি করতাম, ঝাড়-ফুঁক করে বেড়াতাম, সাপের বিষ নামাতাম। এখন অন্য কাজ করি কেউ আসলে সেবা দেই।
এসব ঝাড়-ফুঁকের কোনো বৈজ্ঞাণিক ব্যাখ্যা নেই বলে জানান ডা. ফাহমিদা আক্তারও। সাপের বিষ মন্ত্রে চলে যাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তবে কিছু সাপের বিষ থাকে না। আক্রান্ত স্থানে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। এসব সাপের কামড়ের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষ ভেবে নেয় উপকার পেয়েছেন, বিষ নেমে গেছে। তিনি বলেন, গাছ-গাছড়া দিয়ে বানানো ওষধে অনেক ক্ষেত্রে মানুষ উপকার পায়। তবে, বিষাক্ত সাপের কামড়ে তাদের ঝাড়-ফুঁক কোনো কাজেই আসে না। মানুষের বিশ্বাসকে পুঁজি করে গড়ে উঠছে তাদের ব্যবসা।
লোকেদের কাছে সাপ দেখিয়ে টাকা তোলার সঙ্গে জড়িত আছে অনেক নারী। তাদের খোলের ভেতর অািধকাংশ সময় মেলে না সাপ। সাতজন মহিলার একটি দল টাকা তুলে এসে চা খাচ্ছিলেন পল্লীর একটি চায়ের দোকানে। রিনা বানু বলেন, ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যাই। একেক দিন একেক স্থানে। আয় হয় ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা। দুলালি বেগম বলেন, পেটের দায়ে করি। মানুষ খারাপ ব্যবহার করে। গায়ে হাত তোলে, খারাপ প্রস্তাব দেয়। বাক্সে সাপ আছে কি না এমন প্রশ্নের জবাবে অর্ধমৃত দুটি সাপ দেখিয়ে বলেন, আমরা সাতজন বেরিয়েছিলাম সাতটা বাক্স নিয়ে। সাপ ছিল দুইটা। আমাদের সাপের সংকট যেমন আছে আবার সারা দিন সাপ নিয়ে ঘুরলে সাপের অবস্থা খারাপ হয়ে যায়। দুটা সাপ রাখি কেউ সমস্যা করলে দেখাই।
অনেকে চুড়ি-ফিতার ফেরি করে বেড়ান। খুরশিদা খাতুন বলেন, চুড়ি-ফিতার ব্যবসায় অনেক সমস্যা। ভারি ডালি নিয়ে বিভিন্ন স্থানে যেতে হয়। বাসে নিতে চায় না, লাভ কম। এসব কারণে কমে যাচ্ছে চুড়ির ব্যবসা। তবে বিভিন্ন দিন যেমন পহেলা বৈশাখ, পহেলা ফাল্গুন, ঈদ ইত্যাদি দিবসের আগে বিক্রি হয় চুড়ি।
বেদেদের রীতি অনুযায়ী মহিলারা হবে পরিবারের প্রধান উপার্জনকারী। তবে মহিলারা এখনো পরিশ্রম করেন যাচ্ছেন, পাশাপাশি কাজ করেন পুরুষরা। এজাজুল হক বেদে পল্লীতে তার সাপের বাক্সের দোকান। বিভিন্ন দামের বাক্স রয়েছে ১০০ টাকা থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত। তার তিন ছেলে দুই মেয়ে। এক ছেলে চালায় পিকআপ, একছেলে রিকশা, আরেক ছেলে লেখাপড়া আর দুই মেয়ে পোশাকশ্রমিক। তিনি বলেন, বর্তমানে ছেলেমেয়েরা সাপের পেশায় আসতে চায় না। আমরাও জোর করতে পারি না। কারণ আয় কম। অন্য পেশায় আয় বেশি।
বেদেরা লেখাপড়ায় অনেক পিছিয়ে। অধিকাংশরাই অক্ষর জ্ঞান শূন্য। আবার যারা লেখাপড়া করেন তাদের অধিকাংশই পেরুতে পারেন না মাধ্যমিকের ধাক্কা। বেদে শিক্ষার্থীদের রয়েছে অনেক অভিযোগ। অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া বিটুল বলে, স্কুলে অন্য ছেলেরা আমাদের পাশে বসতে চায় না। নানা ধরনের মজা করে। যেমন ব্যাগে সাপ আছে নাকি রে? সাপের গন্ধ আসছে তোর শরীর থেকে ইত্যাদি। আবার কাজের ক্ষেত্রেও একই সমস্যা। পোশাকশ্রমিক বিলকিস বলেন, মেয়েরা আমাদের দেখে কেমন জানি একটা ভঙ্গি করে। পাশে বসতে চায় না, একসঙ্গে খেতে চায় না।
বেদে পল্লীর বাসিন্দাদের নিয়ে প্রতিবেশীদের অভিযোগের শেষ নেই। বাসেদ আলী বলেন, বেদেদের জন্য ছেলেপেলে মানুষ করা কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেদে ছেলেদের সঙ্গে মিশে হাতে নিচ্ছে মাদক, ছাড়ছে লেখাপড়া। বেদেপল্লীতে মাদক বিশেষ করে গাঁজা এবং ইয়াবা খুব সহযেই পাওয়া যায়। বেদে মেয়েদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের সঙ্গেও জড়িয়ে পড়ছে তারা। আবার ছেলেরা প্রায়ই চুরি করে। বিশেষ করে গাছের ফল রাখাই যায় না গাছে।
বেদে পল্লীতে একেক পরিবারে সন্তান সংখ্যা চোখে পড়বার মতো। অধিকাংশ পরিবারে ৪ থেকে ৫ জন সন্তান সাধারণ ঘটনা। ইদ্রিস মিয়ার বাড়িতে দেখা যায় তার ৪ জন স্ত্রীর ১৫ জন সন্তান। ইদ্রিস মিয়া বলেন, অধিক সন্তান মানেই অধিক আয়। এখানে সন্তানের জন্ম যেমন খুশির উপলক্ষ আনে না আবার বিয়ে, বহুবিবাহ এবং বিচ্ছেদটাও খুবই স্বাভাবিক। তাদের বিয়ে হয় এই বেদে পল্লীতেই। আবার দেশের অন্য বেদে পল্লীতেও বিয়ে হয়। সেই সঙ্গে সাধারণ ঘরেও বিয়ে হয় তবে তার সংখ্যা খুবই কম। বেদে মেয়ের বিয়ে সাধারণ ঘরে হলে খুব স্বাভাবিকভাবে তারা নিলেও ছেলে যখন সাধারণ অন্য মেয়ে বিয়ে করে আনেন তখন সমস্যায় পড়তে হয় তাদের। বেদে অমিত হুকি বলেন, একবার সাপ ধরতে গিয়েছিলাম চলনবিলে। বিলের মাঝে হঠাৎ দল ছাড়া হয়ে যাই। সঙ্গে মোবাইল ফোন ছিল না। আশ্রয় নেই একটি দরিদ্র পরিবারে। ভালো লেগে যায় বাড়ির স্বামী হারা মেয়েকে। বিয়ে করে নিয়ে আসি পরের দিনই। কিন্তু ফেরার পর পরিবার, পল্লী ভালো চোখে দেখছিল না। খারাপ আচরণ করত, কথা বলত না। এসব কারণে বাড়িছাড়া ছিলাম প্রায় সাত মাস। স্ত্রী সন্তান সম্ভাবা হলে ফিরে আসি। এখন সব কিছু স্বাভাবিক।
বেদে পল্লীতে নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে সাস নামে একটি এনজিও। তাদের পরিচালিত একটি স্কুলে প্রাথমিক শিক্ষা নিচ্ছেন বেদে শিশুরা। নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও হস্তশিল্পের কাজেও সহায়তা করে থাকে। এছাড়া বিভিন্ন সচেতনমূলক কাজের সঙ্গেও যুক্ত তারা। সাসে কর্মরত মৃদুল রহমান বলেন, পিছিয়ে পরা এসব মানুষদের মূল স্রোতধারায় আনতে আমরা বদ্ধপরিকর। তারা খুবই সম্ভাবনাময়, তারা একটু সহযোগিতা পেলে আরো উন্নতি করতে সক্ষম হবে।

No comments

Powered by Blogger.