৩৯ দফা ঢাকা ঘোষণায় শেষ হলো ওআইসি সম্মেলন

৩৯ দফা ঢাকা ঘোষণা গ্রহণের মধ্য দিয়ে ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) ৪৫তম পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের দুইদিনব্যাপী সম্মেলন শেষ হয়েছে। রোববার বিকালে প্রেস স্টেটম্যান্টে এ ঘোষণা গৃহীত হয়েছে বলে জানান সম্মেলনের সভাপতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পরে ওআইসি’র মহাসচিব ড. ইউসুফ আল ওসাইমিনও এ নিয়ে কথা বলেন। রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ওআইসি সম্মেলনের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির পর বাংলাদেশের অর্জন বিষয়ে ব্রিফ করেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেন, ‘আমরা দু’টো জিনিস চেয়েছিলাম। একটি হচ্ছে- রোহিঙ্গা ইস্যু এবং অন্যটি ওআইসি’র সংস্কার। আমরা দু’টোই অর্জন করতে পেরেছি।’ তিনি জানান, রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি মন্ত্রীপর্যায়ের কমিটির বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। গাম্বিয়ার প্রস্তাব ছিল এটি। সব সদস্য রাষ্ট্র এতে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছে। ওই কমিটি ওআইসি’র তরফে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে রাখাইনে গণহত্যাসহ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের যেসব ঘটনা ঘটেছে তার বিচার নিশ্চিতে কাজ করবে। এছাড়া, ওআইসি’র সংস্কার নিয়ে বাংলাদেশ এবং তুরস্ক একসঙ্গে কাজ করবে বলে জানান প্রতিমন্ত্রী। এর আগে সমাপনী প্রেস স্টেটম্যান্টে যৌথভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএস মাহমুদ আলী এবং ওআইসি মহাসচিব জানান- সম্মেলনে বিভিন্ন বিষয়ে ১২০টির বেশি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন ইস্যুতে মন্ত্রিপরিষদ কমিটি গঠনের প্রস্তাবও অনুমোদন করেছেন ওআইসি’র সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিরা।
এ ইস্যুতে কারও কোনো দ্বিমত বা ভিন্নমত ছিল না বলেও জানানো হয়। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে ওআইসি’র সদস্যভুক্ত দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সম্মেলনে একটি বিশেষ সেশনে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। পরে এটি ঢাকা ঘোষণায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ওই সেশনে গোয়েন্দা বিষয়ক গাম্বিয়ার প্রস্তাবিত একটি রেজ্যুলেশনের সংশোধন চেয়েছে বাংলাদেশ। রেজ্যুলেশনে বলা আছে, রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের দায়বদ্ধতার জন্য ওআইসি’র এডহক মন্ত্রী পর্যায়ের একটি কমিটি কাজ করবে। অপরাধের পরিবর্তে মানবাধিকার লঙ্ঘন শব্দটির প্রতিস্থাপিত করে সংশোধনী চেয়েছে। বাংলাদেশের পক্ষে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি এই সংশোধনীর প্রস্তাব করেন। মূল প্রস্তাবে বলা আছে, গত বছর ২৫শে আগস্টের পর রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে যে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তার দায়বদ্ধতার জন্য আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক সমর্থন আদায় করা। এছাড়া মানবাধিকার পরিষদ, নিরাপত্তা পরিষদ, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে মিয়ানমারের ওপর রাজনৈতিক চাপ নিশ্চিত করা। বিশেষ সেশনে সভাপতিত্ব করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী এবং সঞ্চালনার দায়িত্ব ছিলেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। অনুষ্ঠানে কানাডার প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ দূত বব রে, জাতিসংঘের এসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি জেনারেল রশিদ খালিকভ, ওআইসি’র ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশনের সভাপতি, আরাকান ইউনিয়নের পক্ষে ড. ওয়াকার উদ্দিন বক্তব্য রাখেন। এরপর উন্মুক্ত আলোচনায় জিবুতি, ইরান, উগান্ডা, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তান, ইরাক, মালয়েশিয়া, মিশর, তুরস্ক, কাজাখস্তান ও সুদানের প্রতিনিধিরা বক্তব্য রাখেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী তার বক্তব্যে বলেন, ‘আমরা মিয়ানমারের সঙ্গে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত চুক্তি করেছি। রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর জন্য আমরা তৈরি। তবে সমস্যা হচ্ছে ফেরত পাঠানোর জন্য তাদের যে বাড়িঘর তা এখনও তৈরি করা হয়নি।’ কানাডার দূত বব রে বলেন, ‘আমি যখন কক্সবাজার সফর করেছিলাম তখন রোহিঙ্গারা বিশেষভাবে অনুরোধ করেছিলেন যেন আমি বিশ্বকে বলি তারা মানুষ। কানাডা দায়বদ্ধতার নীতিতে বিশ্বাসী এবং আমরা জানি এটি জটিল একটি প্রক্রিয়া। কিন্তু দায়বদ্ধতা থাকতে হবে।’ রশিদ খালিকভ বলেন, ‘রোহিঙ্গাদের জন্য সবচেয়ে বেশি কাজ করছে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ। রোহিঙ্গাদের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ শিশু এবং অনেকে যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জাতিসংঘের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যানে ৯৫১ মিলিয়ন ডলারের সহায়তা প্রস্তাব করা হয়েছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল।’ ওআইসি’র ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কমিশনের সভাপতি বলেন, আমরা ২০১১ সালে থেকে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইন্ডিপেনডেন্ট হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের আলোচনা করছি। আমাদের একটি সুপারিশ আছে, রোহিঙ্গা বিষয়ে একটি বিশেষ ‘পাথ ফাইন্ডিং কমিশন’ গঠন করা। ওয়াকার উদ্দিন বলেন, ‘আমার জন্ম রাখাইনে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর এ ধরনের অত্যাচার আমি জন্ম থেকে দেখে আসছি। জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত করার আহ্বান জানাই।’ জিবুতির প্রতিনিধি বলেন, ‘আমি ৪-৫ বছর আগে রাখাইনে গিয়েছিলাম। আমি তাদের দুঃখ-কষ্ট নিজ চোখে দেখে এসেছি।’ ইরানের প্রতিনিধি বলেন, ‘মিয়ানমার সরকার মানবাধিকার আইন লঙ্ঘন করছে। আমাদের চেষ্টা করতে হবে টেকসই উপায়ে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর। উগান্ডার প্রতিনিধি বলেন, ‘আমি জোর দিয়ে বলতে চাই রোহিঙ্গাদের বেঁচে থাকার ও শান্তিপূর্ণ বসবাসের অধিকার আছে।’ ইন্দোনেশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, ‘আমাদের প্রেসিডেন্ট ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ঢাকা সফর করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন।’ পাকিস্তানের প্রতিনিধি বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশের বিষয়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সম্পূর্ণ সংহতি প্রকাশ করছি।’ ইরাকের প্রতিনিধি বলেন, ‘রোহিঙ্গারা মানুষ। মিয়ানমার সরকারের প্রতি আহ্বান জানাই তাদের মানবাধিকারকে সম্মান করার।’ মালয়েশিয়ার প্রতিনিধি বলেন, ‘নিরাপত্তা পরিষদের এ বিষয়ে বড় ভূমিকা আছে।’
ওআইসিতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন মাত্রা, ভারত ‘অন্তর্ভুক্তি’ নিয়ে প্রশ্ন: এদিকে ওআইসি সংশ্লিষ্ট ঢাকার কূটনীতিকরা বলছেন, গেল বছরের আগস্টে রাখাইন বর্মী বর্বরতা শুরু হওয়া এবং আচমকা বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ঢল বাংলাদেশের পর এই প্রথম সংস্থাটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হলো। এবং ঘটনাচক্রে কিংবা কাকতালীয়ভাবে সম্মেলনটি ঢাকায় হওয়ার জন্য পূর্ব-নির্ধারিত ছিল। বাংলাদেশ এ আয়োজনের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করার চেষ্টা করেছে জানিয়ে এক দায়িত্বশীল প্রতিনিধি গতকাল সন্ধ্যায় মানবজমিনকে বলেন- সদস্য রাষ্ট্রগুলোর নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের প্রতিনিধিদের কক্সবাজার নিয়ে যাওয়া হয়েছিল রোহিঙ্গা সংকটের একেবারে মাঠ পর্যায়ের পরিস্থিতি সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেয়ার জন্য। তারা যে ধারণা পেয়েছেন তা সম্মেলনের রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ সেশনে তুলে ধরেছেন। সেখানে ওআইসি’র প্রায় সব রাষ্ট্রের প্রতিনিধিই কথা বলেছেন। তারা পুঞ্জীভূত এ সংকেটের টেকসই সমাধানে মিয়ানমারের ওপর বিশ্ব সমপ্রদায়ের সঙ্গে মিলে চাপ বাড়ানোর বিষয়ে তাদের প্রত্যেকে নৈতিক, রাজনৈতিক এবং কার্যকরী সমর্থন দেয়ার দৃঢ় অঙ্গীকার করেছেন। ৩৯ দফা ঢাকা ডিকলারেশনে তার প্রতিফলন রয়েছে। সেখানে ১৪, ১৫, ১৬, ১৭ চারটি দফায় এর বিস্তারিত রয়েছে। সেখানে রোহিঙ্গা সংকটের স্থায়ী সমাধানে আনান কমিশনের পূর্ণ বাস্তবায়ন, গণহত্যা, গণধর্ষণের জন্য দায়ী বর্মী সেনাদের বিচারের আওতায় নিয়ে আসা এবং বাস্তুচ্যুতদের ফেরাতে সই হওয়া চুক্তির দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ রয়েছে।
কেবল ওআইসি নয়, পশ্চিমা দুনিয়া বিশেষ করে কানাডার পররাষ্ট্র মন্ত্রী এবং প্রধানমন্ত্রীর রোহিঙ্গা বিষয়ক বিশেষ দূত বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক মহলে জোরালোভাবে উপস্থাপনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছেন। সব মিলে এটি স্পষ্ট যে ঢাকায় ওআইসি’র সম্মেলন রোহিঙ্গা ইস্যুকে নতুন মাত্রা দিয়েছে। ওআইসি’র সংস্কার প্রশ্নে বাংলাদেশের যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তার ব্যাখ্যায় দিল্লির সংবাদ মাধ্যম জানিয়েছে- বাংলাদেশ ভারতকে ওআইসি’র পর্যবেক্ষক করার জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছে। এবং বাংলাদেশ এতে লবি করছে। অবশ্য ওআইসি সংশ্লিষ্ট অন্য একটি কূটনৈতিক সূত্র ধারণা দিয়েছে- ওআইসিতে পর্যবেক্ষক হিসেবে ভারতের অন্তর্ভুক্তির আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব এলে বৈরী অবস্থানে থাকা পাকিস্তান আপত্তি বা রিজারভেশন দিতে পারে। কিন্তু আদৌ কি ঢাকা ভারতের জন্য লবি করছে, ওআইসি’র সংস্কারের জন্য বাংলাদেশ যে প্রস্তাব দিয়েছে তা কি ভারতের অন্তর্ভুক্তির জন্য? সম্মেলনের ক্লোজডোর সেশনে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়েছে কি? তাকে পাকিস্তানের কোনো অবজারভেশন বা রিজারভেশন ছিল কি? এমন না না প্রশ্ন গতকাল দিনভর বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রের আঙ্গিনায় ঘুরপাক খেয়েছে। পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সংবাদ বিফিংয়েও বিষয়টি এসেছিল। প্রতিমন্ত্রী তাতে যা বলেন- তা হলো বিশ্বের এমন দেশও রয়েছে যেখানে ওআইসিভুক্ত অনেক রাষ্ট্রের চেয়ে বেশি মুসলমানের বসবাস। কিন্তু ওই দেশ ওআইসিতে অন্তর্ভুক্ত হয়। ওআইসি এখন অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কান্ট্রি নয়, কো-অপারেশন। সেখানে নন-ওআইসি রাষ্ট্রগুলোর মুসলমানদেরও অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশ ও তুরস্ক ওআইসি’র সামগ্রিক সংস্কার নিয়ে কাজ করছে। এতে ওআইসি’র ম্যান্ডেটও রয়েছে। তবে ভারতের অন্তর্ভুক্তি নিয়ে ঢাকা সম্মেলনে আলোচনা বা পাকিস্তানের আপত্তির প্রশ্ন এড়িয়ে যান প্রতিমন্ত্রী। পররাষ্ট্র দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও এ নিয়ে আনুষ্ঠানিক বা অনানুষ্ঠানিক কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

No comments

Powered by Blogger.