পা হারানো রোজিনাকেও বাঁচানো গেল না

বাঁচানো গেল না বাস চাপায় পা হারানো রোজিনা আক্তারকেও। চিকিৎসকদের সব চেষ্টা ব্যর্থ করে গতকাল সকালে তিনি মারা যান। এর আগে দুই বাসের চাপায় হাত হারানো রাজীব হোসেনের মৃত্যুও নাড়া দিয়েছিল দেশব্যাপী। রাজীবের মৃত্যুতে আশ্রয়হারা হয়েছে তার এতিম দুই ভাই। রোজিনার মৃত্যুতেও মুষড়ে পড়েছে তার পরিবার। গৃহকর্মী রোজিনা সাংবাদিক ইশতিয়াক রেজার বাসায় কাজ করে মাসে ছয় হাজার টাকা পাঠাতেন গ্রামে থাকা পরিবারের কাছে। গতকাল সকাল সাড়ে ৬টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোজিনার মৃত্যু হয়। পরিবারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে কোনো প্রকার ময়নাতদন্ত ছাড়াই সকাল সাড়ে ১১টার দিকে লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করে ঢামেক কর্তৃপক্ষ। গত ২০শে এপ্রিল রাতে বিআরটিসির দোতলা বাসের চাপায় ডান পা হারান রোজিনা। তাকে প্রথমে জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানে (পঙ্গু হাসপাতাল) ভর্তি করা হয়। পরে নেয়া হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তার চিকিৎসায় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের অধ্যাপক ডা. মো. আবুল কালামকে প্রধান করে ৯ সদস্যের একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। রোজিনা আক্তারের জন্য গঠিত মেডিকেল বোর্ডের প্রধান বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারির বিভাগীয় প্রধান আবুল কালাম বলেন, গত বুধবার রোজিনাকে যখন পঙ্গু হাসপাতাল থেকে ঢামেকে আনা হয়, তখনই ওর শ্বাসকষ্টের উপসর্গ দেখা যাচ্ছিল। বড় আঘাত, বড় অস্ত্রোপচারের পর এমনটা হয়ে থাকে। কিডনি ও ফুসফুস ঠিকমতো কাজ করলে সমস্যা ছিল না। কিন্তু বৃহস্পতিবার থেকেই ওর শ্বাসকষ্টটা বাড়ছিল। রোজিনাকে অক্সিজেন দিয়ে রাখা হয়েছিল। পরে আর ওই অক্সিজেনেও কুলাচ্ছিল না। শনিবার থেকে ওর জ্বর আসে। ধারণা করা হচ্ছে, সংক্রমণ বা রক্তে জীবাণু ঢুকে পড়েছিল। শনিবার রাতেই ওকে ভেন্টিলেশনে দেয়া হয়। তবে, অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো গেল না।
রোজিনার বাবা ময়মনসিংহের ধোবাউড়ার রসুল মিয়া পরের জমি বর্গা চাষ করেন। তিনি বলেন, আর কারও ভাগ্য যেন এমন না হয়। রাবিয়া খাতুন ও রসুল মিয়ার ছয় মেয়ে, এক ছেলে। বড় মেয়ে রমিজা খাতুনের বিয়ে হয়েছে।
গত আট বছর ধরে সংসারের প্রধান উপার্জনকারী ১৮ বছর বয়সী রোজিনা আক্তারের আয় দিয়েই চলছিল ময়মনসিংহে থাকা ১০ সদস্যের পরিবারটি। রোজিনা গাজী টেলিভিশনের প্রধান সম্পাদক সৈয়দ ইশতিয়াক রেজার বাসায় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। ওই ঘটনায় গাজী টেলিভিশনের স্টাফ রিপোর্টার মহিউদ্দিন আহমেদ বাদী হয়ে রাজধানীর বনানী থানায় মামলা করেন।
রাসেলের খোঁজ নেয়নি গ্রিন লাইন কর্তৃপক্ষ: এদিকে বাস চাপায় পা হারিয়ে হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন পিআর এনার্জির গাড়িচালক রাসেল সরকার। শনিবার দুপুরে রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ধোলাইপাড় ঢালে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি বাসের (ঢাকা মেট্রো ব-১৪-২৭৮৬) চাকায় পিষ্ট হয়ে রাসেলের পা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। পিআর এনার্জির ব্যবস্থাপক ইমতিয়াজ নবী বলেন, গুলশানের এ্যাপোলো হাসপাতালে রাসেলের পা জোড়া লাগানোর জন্য শনিবার রাত দুইটা পর্যন্ত অপারেশন করেন ডাক্তাররা। কিন্তু তার পা কোনোভাবেই জোড়া লাগাতে পারেননি চিকিৎসকরা। রাসেলের উন্নত চিকিৎসায় দেশের বাইরে থেকে আগত একটি মেডিকেল টিমের সমন্বয়ে মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়েছে। তবে, তার শারীরিক অবস্থা এখন ভালো। পা বাদে সব কিছুই স্বাভাবিক রয়েছে।
ইমতিয়াজ জানান, ‘আমরা কোম্পানির পক্ষ থেকে রাসেলের চিকিৎসা খরচ দিচ্ছি। কিন্তু রাসেলের সারা জীবনে যে অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল, তার জন্য বড় ক্ষতিপূরণ দিতে হবে গ্রিন লাইন বাস কর্তৃপক্ষকে। এখন পর্যন্ত গ্রিন লাইনের কেউ আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। আমরা যোগাযোগের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এ বিষয়ে আমরা আইনি পদক্ষেপ নেব।
শনিবার দুর্ঘটনার পর পর তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে প্রথমে স্কয়ার হাসপাতালে পরে এ্যাপোলো হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। এরপর রাসেলের পরিবার ও কর্মক্ষেত্র থেকে বারবার গ্রিন লাইন পরিবহনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
রাসেলের ভাই আরিফ সরকার আক্ষেপ করে বলেন, ‘যে বাস আমার ভাইয়ের এত বড় ক্ষতি করল, সেই বাসের কেউ এখন পর্যন্ত আমাদের খবরও নিতে আসেনি। ভাই কি মরেছে না বেঁচে আছে, সে কথাও তাদের কেউ জিজ্ঞেস করেনি। চিকিৎসকরা রাসেলের সঙ্গে কথা বলতে নিষেধ করায় আত্মীয়স্বজনরা চুপচাপ তাকে দেখে চলে যাচ্ছেন।
রাসেলের শারীরিক অবস্থা জানাতে গিয়ে আরিফ সরকার বলেন, রাসেলের অবস্থা বেশি ভালো না। গতকাল রাতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা ধরে তার অপারেশন করা হয়েছে। প্রচুর রক্তক্ষরণ হওয়ায় তিন ব্যাগ রক্ত দিতে হয়েছে তাকে। অপারেশনের পর আইসিইউতে ছিলেন। পরে তাকে ওয়ার্ডে দেয়া হয়েছে। তিনি জানান, রাসেল কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। চুপচাপ শুয়ে থাকছেন। মুখে কিছু না বললেও দেখলে বোঝা যায় যে, ভবিষ্যৎ নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় ভুগছেন।
তিন ভাই দুই বোনের মধ্যে রাসেল দ্বিতীয়। পরিবার নিয়ে রাসেল সরকার মোহাম্মদপুরের সুনিবিড় হাউজিং এলাকায় থাকেন। সেখানে থাকেন তার স্ত্রী মীম আক্তার আর ১৭ মাস বয়সী ছেলে।
বাসের চাপায় রাসেল সরকারের পা হারানোর ঘটনায় শনিবার রাত সাড়ে ১০টায় রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা হয়েছে। মামলায় গ্রিন লাইন বাসের চালক কবির মিয়াকে আসামি করা হয়েছে। রাসেল সরকারের বড় ভাই মো. আরিফ সরকার মামলাটি করেন।
হৃদয় ঝুঁকিমুক্ত নয়: ডান হাত নেই। ডানপাশে আছে শূন্যতা। আছে শুধু যন্ত্রণা। চলন্ত বাসের গা ঘেঁষে ওভারটেক করা ট্রাকটি দুঃস্বপ্নে মতো তা কেড়ে নিলো। দিয়ে গেল শারীরিক ও মানসিক যন্ত্রণা। যন্ত্রণা বাড়লেই ব্যথানাশক ওষুধ দিয়ে ভুলিয়ে রাখা হচ্ছে। তীব্র যন্ত্রণায় ঘুম পাড়িয়ে দেয়া হয়। মানসিক কষ্ট লাঘবে চিকিৎসক, নার্স ও স্বজনদের সান্ত্বনা তো রয়েছেই। কিন্তু কিছুতেই দুর্ঘটনার দুঃসহ স্মৃতি ভুলিয়ে রাখতে পারছে না। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে ১৩ দিন কাটছে ২০ বছরের টগবগে তরুণ খালিদ হাসান হৃদয়ের। আপাত দৃষ্টিতে তিনি বিপদ মুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত ঝুঁকিমুক্ত নন বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
ঢামেক হাসপাতালের উপ- পরিচালক ডা. শাহ আলম তালুকদার গতকাল মানবজমিনকে বলেন, হৃদয়ের অস্ত্রোপচার হয়েছে। রক্ত দেয়া হয়েছে। এখন শ্বাস-প্রশ্বাস, নাড়ির স্পন্দন স্বাভাবিক আছে। তবে তার শরীরে যন্ত্রণা আছে। তা বাড়লে যন্ত্রণানাশক ওষুধ ও ইনজেকশন দেয়া হয়। ড্রেসিং করা হচ্ছে। কাটা হাতের ক্ষতস্থান আস্তে আস্তে শুকাচ্ছে। তবে হৃদয় এখনো ঝুঁকিমুক্ত নয়। সংক্রমণের ঝুঁকি তো রয়েছেই। পাশাপাশি সাইকোলজিক্যাল ঝুঁকিও আছে। গত ১৭ই এপ্রিল সকালে গোপালগঞ্জ সদরের বেতগ্রাম বাসস্ট্যান্ডে এই অপ্রত্যাশিত মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হন হৃদয়। তিনি টুঙ্গিপাড়া এক্সপ্রেস নামে স্থানীয় পরিবহন সংস্থার বাসের চালকের সহকারী হিসেবে কাজ করতেন। বাড়ি গোপালগঞ্জ সদরের পুলিশ লাইন এলাকায়।
হাসপাতালের উপ-পরিচালক শাহ আলম বলেন, কৃত্রিম হাত সংযোজন করে হৃদয় তার ডান হাতের বিকল্প ফিরে পেতে পারে। এজন্য দেড়-দু’লাখ টাকা প্রয়োজন। তবে, আমাদের এখানে ফান্ড বা বরাদ্দ নেই। তা সংযোজনের ব্যবস্থাও নেই। বাইরে করতে হবে। আমরা মাপজোখ নিয়ে দিতে পারি। কোনো হৃদয়বান এগিয়ে আসলে হৃদয় একটি কৃত্রিম হাত পেতে পারে।
সুমির অবস্থা ভালো নয়:  প্রতীক ওমর, বগুড়া থেকে জানান, প্রাণচঞ্চল শিশু সুমি এখন নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে হাসপাতালের বিছানায়। ডাক্তার দেখলেই ভয়ে কুকড়ে যাচ্ছে। ক্ষতস্থানে ড্রেসিং করার সময় প্রচণ্ড ব্যথা পায় সুমি। এ জন্যই ভয়টা আরো বেশি। শরীরে প্রায় সময় হালকা জ্বর থাকছে। কয়েক দিন আপেল কমলা খেলেও এখন সেসবও খেতে চাইছে না সুমি। দাঁতের ব্যথাও শুরু হয়েছে। মুখের আঘাতও ছিল মারাত্মক। ঘটনার সময় দাঁতের তেমন ব্যথা না থাকলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখন দাঁতের ব্যথাও বেড়েছে। জুস এবং তরল খাবার কিছুটা খেলেও অন্য খাবারের প্রতি সুমির আগ্রহ নেই বললেই চলে।
শনিবার শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজে সুমিকে সরজমিন গিয়ে দেখা যায়, সুমি বিছানায় শুয়ে আছে। স্বজনরা জানান, সকালে যখন ড্রেসিংয়ের জন্য ওটিতে নেয়া হয় তখন সে ভয়ে কুকড়ে যায়। চিৎকার করে বলে আমি ওখানে যাবো না। একটু পর পর কেটে ফেলা হাতের দিকে তাকিয়ে মাকে বলছে, মা আমার হাত কোথায় আমার হাত ডাক্তাররা কেন খুলে রেখেছে
এদিকে সুমির পরিবার সুমিকে নিয়ে চরম দুঃশ্চিন্তায় আছে। সুমির বাবা দুলাল মিয়া শেরপুর এলাকায় ভ্যান চালাতেন। শারীরিকভাবে দুর্বল হয়ে যাওয়ায় এখন তিনি আর কোনো কাজ করতে পারেন না। মা মরিয়ম বেগম বাসাবাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। তিন সন্তানের মধ্যে সুমি সবার ছোট। বাড়ি শেরপুরের শাহবন্দেগী ইউনিয়নের ফুলতলা দক্ষিণপাড়া এলাকায়। স্থানীয় ব্র্যাক স্কুলের প্রথম শ্রেণিতে পড়ে সুমি। এই বয়সেই তার এত বড় ক্ষতি হবে ভাবতেই পারছেন না মা মরিয়ম বেগম। মেয়ের এই অবস্থায় অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়েছেন তিনি। তেমন কোনো কথাও বলছেন না। মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে অঝরে চোখের পানি ঝরাচ্ছেন তিনি। সুমির মা অনেকটা বোবা হয়ে গেছেন।
সুমির বাবা দুলাল মিয়া কেঁদে কেঁদে বললেন, আমি ওর কষ্ট দেখে রাতে ঘুমাতে পারি না। খাবারও পেটে ঢুকছে না। কি করবো কূল খুঁজে পাচ্ছি না।

No comments

Powered by Blogger.