কুনিও হত্যা মামলার আইনজীবী নিখোঁজ: হুমকির বিষয়ে পুলিশকে জানিয়েছিল পরিবার

জাপানি নাগরিক হোশি কুনিও ও মাজার খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলায় সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী ও রংপুর বিশেষ জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আওয়ামী লীগ জেলা আইন বিষয়ক সম্পাদক রথিশ চন্দ্র ভৌমিক বাবু সোনা নিখোঁজ। ২৪ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলেও তার সন্ধান না পাওয়ায় জেলার প্রশাসন, রাজনৈতিক, সামাজিক ও  সাংস্কৃতিক সংগঠনে  চলছে ব্যাপক তোলপাড়। অ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্র ভৌমিককে উদ্ধারের টার্গেট নিয়ে মাঠে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী র‌্যাব-পুলিশ। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার কোনো সন্ধান পায়নি প্রশাসন। আওয়ামী লীগ নেতা ও আইনজীবী অ্যাডভোকেট রথিশ কেন নিখোঁজ হলো, কারা এর সঙ্গে জড়িত, কিংবা কেউ কি অপহরণ করেছে, অপহরণের নেপথ্যের কারণই বা কী, জঙ্গিদের বিপক্ষে আইনজীবী অবস্থান নেয়ার কারণ কী তার কাল নাকি ডিমলা জমিদারের রাজ দেবোত্তর সম্পত্তি সাড়ে ৯ একর জমি দখলের বিরোধের কারণে নিখোঁজ। এ নিয়ে নগরজুড়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা ও গুঞ্জন। এদিকে অ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্রের উদ্ধারের দাবিতে গতকাল শনিবার সকালে নগরীর স্টেশন এলাকায় রেললাইন ও সড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করেছে আওয়ামী লীগ। অপরদিকে এলাকাবাসী কুড়িগ্রাম-লালমনিরহাট ও রংপুর মহাসড়কের তাজহাট এলাকায় সকাল সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১১টা পর্যন্ত দুই ঘণ্টাব্যাপী সড়ক অবরোধ করে রাখে। ফলে দুই ধারে শত শত গাড়ি আটকা পড়ে যানজটের সৃষ্টি হয়। এ সময় কুড়িগ্রাম ও লালমনিরহাট থেকে সারা দেশের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওদিকে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খিষ্ট্রান ঐক্য পরিষদ জেলা ও মহানগর শাখা এবং বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ রংপুর জেলা ও মহানগর শাখার যৌথ উদ্যোগে বেলা ২টায় রংপুর প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খিষ্ট্রান ঐক্য পরিষদের জেলা সভাপতি বনমালী পাল তার লিখিত বক্তব্যে বলেন,  হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট্রের ট্রাস্ট্রি, পূজা উদযাপন পরিষদ রংপুর জেলা শাখার সভাপতি অ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্র ভৌমিক শুক্রবার সকাল সাড়ে ৬টায় তার আলমনগর বাবুপাড়া রোডস্থ বাড়ি থেকে বের হয়ে আর ফিরে আসেনি। এ ঘটনায় রাতে তার পরিবারের পক্ষ থেকে থানায় জিডি করা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা উদ্বেগ প্রকাশ করছি তার এ নিখোঁজে। তারা আরো বলেন, অ্যাডভোকেট বাবু সোনা রংপুর জেলা সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আইনজীবী সমিতির সহসাধারণ সম্পাদক। তার মতে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত সমাজের নাগরিক এভাবে নিখোঁজ হওয়া আমাদেরকে হতাশ করেছে। দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি অবিলম্বে আমাদের প্রিয় নেতাকে সুস্থ অবস্থায় উদ্ধার করে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন। তারা এ নিখোঁজের জন্য পুলিশ প্রশাসনকে দায়ী করে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অ্যাডভোকেট রশিথ চন্দ্র ভৌমিককে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করে বলেন, রথিশ চন্দ্র রংপুর বিশেষ জজ আদালতে সরকার পক্ষে জঙ্গিদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া দুটি মামলা পরিচালনা করছিলেন। তিনি জামায়াতে ইসলামের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল এটিএম আজাহারুল ইসলামের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার সাক্ষী ছিলেন। ওই মামলার রায়ে আজাহারুলের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। তিনি মামলা পরিচালনা করে জঙ্গিদের ফাঁসির রায় নিশ্চিত করেন। জাপানি নাগরিক হত্যার মামলার রায়ের পর থেকেই তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয় জেএমবি। এ ব্যাপারে পুলিশকে জানালে তার বাড়ির সামনে পুলিশি পাহারা বসানো হয়। দুদিন পর সে পাহারা তুলে নেয় প্রশাসন। সম্প্রতি মাজার খাদেম হত্যার রায়ে জেএমবি জঙ্গিদের ফাঁসি রায় হলে আবার তিনি হুমকির মুখে পড়েন। কিন্তু তার নিরাপত্তার জন্য প্রশাসন থেকে কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় আজকের এ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিতিরা বলেন, অবিলম্বে আমাদের প্রিয় নেতা অ্যাডভোকেট রথিশকে উদ্ধার করা না হলে আমরা বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তুলবো। সংবাদ সম্মেলনে আজ রোববারের রংপুর জেলা ও উপজেলায় মানববন্ধন ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। এতে উপস্থিত ছিলেন, বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ ও খিষ্ট্রান ঐক্য পরিষদের জেলা সাধারণ সম্পাদক স্বপন কুমার রায়, গৌতম রায়, মহানগর কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কমল কুমার মজুমদার, পূজা উদ্‌যাপন মহানগর কমিটির সভাপতি সুব্রত সরকার মুকুল, সহ-সভাপতি অজয় প্রসাদ বাবন, যুগ্ম সম্পাদক লহ্মীণ চন্দ্র দাস, পার্থ বোস, সাংগঠনিক সম্পাদক অলোক নাথ প্রমুখ। পাশাপাশি নিখোঁজ অ্যাডভোকেট বাবু সোনার পরিবারের সদস্যসহ স্বজন ও সহকর্মীদের অভিযোগ, বেশ কিছুদিন ধরে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া হচ্ছিল। বিষয়টি পুলিশকে জানানোর পরও তারা নিরাপত্তার ব্যবস্থা নেয়নি বলে একই অভিযোগ করা হয়। নিখোঁজ আইনজীবীর স্ত্রী দীপা ভৌমিক জানান, শুক্রবার সকাল ৬টার দিকে তাদের রংপুর নগরীর আলমনগর বাবুপাড়া এলাকার বাসা থেকে বাবু সোনাকে কেউ ডেকে নিয়ে যায়। এসময় তিনি ঘরে কাজ করছিলেন। কোথায় যাচ্ছেন জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘বাইরে যাচ্ছি দুপুরের আগে বাসায় ফিরবো।’ এরপর পাঞ্জাবি পরা এক ব্যক্তির লালরঙের মোটরসাইকেলে চড়ে চলে যান। মোটরসাইকেলে কে বা কারা এসেছিল তা তিনি জানেন না। তিনি আরও জানান, সাধারণত বাবু সোনা সকাল ৮-৯টার দিকে বাসা থেকে বের হন। তিনি যাওয়ার পর সকাল ৭টার পর থেকে তার মোবাইল ফোন বন্ধ পাওয়া যায়। তখন আমরা ভেবেছি হয়তো কোনো জরুরি মিটিংয়ে আছেন, সেজন্য ফোন বন্ধ। কিন্তু দুপুর ৩টার পরেও তার ফোন বন্ধ পাওয়ায় আমরা বিভিন্ন স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ করি। রাতেও তিনি বাসায় না ফেরায় আমরা পুলিশকে বিষয়টি জানাই। দীপা ভৌমিক তার স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় ফিরে পাওয়ার দাবি জানান। সরকার পক্ষের প্রধান আইনজীবী রথিশ চন্দ্র ভৌমিক নিখোঁজ বাবু সোনার ছোট ভাই সাংবাদিক সুশান্ত ভৌমিক জানান, সকালে কে তাকে (আইনজীবী) ডাকতে এসেছিল, সেটাও অনুসন্ধান করা দরকার। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। প্রাণনাশের হুমকির বিষয়ে স্বজনদের অভিযোগ বিষয়ে রংপুরের কোতোয়ালি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) বাবুল হোসেন বলেন, ‘আমরা বিষয়টির তদন্ত করছি।’ এদিকে নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পেয়ে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী, আইনজীবী (পিপি) রথিশ চন্দ্র ভৌমিকের বাড়িতে আসেন। তারা পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রেজাউল করিম রাজু জানান, বাবু সোনা অসম্ভব জনপ্রিয় মানুষ। তিনি জেলার বিভিন্ন সংগঠনের শীর্ষ নেতা ছিলেন। দুই মামলায় জঙ্গিদের ফাঁসির আদেশ হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি বলছিলেন তাকে বিভিন্নভাবে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ‘মূলত সামনে নির্বাচন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে এটা পরিকল্পিত কাজ। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং দলের ঊর্ধ্বতন নেতাদের জানানো হয়েছে।’
রংপুরের অতিরিক্ত জেলা পুলিশ সুপার মারুফ হোসেনও নিখোঁজ বাবু সোনার বাসা পরিদর্শন করেছেন। তিনি সাংবাদিকদের জানান, তারা জঙ্গিদের বিষয়সহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তদন্ত শুরু করছেন। অচিরেই ভালো খবর দিতে পারবেন বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি। সর্বশেষ সংবাদ লেখা পর্যন্ত সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের নেতা অ্যাডভোকেট রথিশ চন্দ্র ভৌমিককে উদ্ধারের দাবিতে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠ থেকে এক বিক্ষোভ মিছিল বের করে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট।

No comments

Powered by Blogger.