প্রশ্ন ফাঁসের উদ্বেগের মধ্যে আগাম ঘোষণা by নূর মোহাম্মদ

প্রশ্ন ফাঁসের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যে আগামীকাল শুরু হচ্ছে এইচএসসি ও সমমানের পরীক্ষা। প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে সব ধরনের প্রস্তুতির পরও প্রশ্ন ফাঁসের আগাম ঘোষণা দিয়েছে প্রশ্ন ফাঁসকারী চক্র। গতকাল ‘লাল আকাশসহ’ বেশ কয়েকটি গ্রুপে একদিন আগেই এসএসসি মতো এবার এইচএসসি’র প্রশ্নফাঁস করার আগাম ঘোষণা দিয়েছেন। তবে এটাকে প্রতারণা হিসেবে দেখছেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এদিকে প্রশ্ন ফাঁস বন্ধে অন্যান্য যে কোনো পরীক্ষার চেয়ে এবারের প্রস্তুতি বেশি বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পুলিশের বিশেষায়িত ১৭টি টিম ছাড়াও জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থা, র‌্যাব পুলিশ প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরতে হোয়াটসঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম মনিটরিং করবে। প্রশ্ন ফাঁসকারীদের যে কোনো তৎপরতা চোখে পড়লে পুলিশের কন্ট্রোল নাম্বার ৯৯৯ ফোন করে জানাতে বলা হয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।
এ ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন বলেন, যে কোনো মূল্যেই এবারের পরীক্ষা সুষ্ঠুভাবে নেয়া প্রস্তুতি নিয়েছি। এজন্য আমরা সকলকে সব ধরনের সহযোগিতা দরকার। তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসকারীদের শনাক্ত করতে হোয়াটঅ্যাপ, ইমো, ফেসবুকসহ সব ধরনের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো কঠোর নজরদারীতে রাখা হয়েছে। র‌্যাব, পুলিশ, এনএসআইসহ অন্যান গোয়েন্দা সংস্থা এবং পুলিশের বিশেষায়িত ১৭টি ইউনিট কাজ করছে। আর কোনো ব্যক্তি বা গ্রুপ যদি প্রশ্ন ফাঁসের অগ্রিম কোনো ঘোষণা দেন, তবে পুলিশের কন্ট্রোল নাম্বার ৯৯৯ কল করে জানানোর অনুরোধ করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়।
চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় প্রায় প্রতিটি পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ার অভিযোগ উঠার পর চরম বেকায়দায় পড়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। নানা উদ্যোগে থামানো যায়নি প্রশ্ন ফাঁস। প্রশ্ন ফাঁস শনাক্ত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন সচিবের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ে কমিটি হয়। বিষয়টি হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। তদন্ত কমিটি প্রশ্ন ফাঁস হয়েছে বলে স্বীকার করে প্রতিবেদন দিয়েছে। তবে কতটুকু ফাঁস হয়েছে তা পর্যালোচনা চলছে। এদিকে আগামীকাল থেকে শুরু হওয়ার পরীক্ষা নিয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে ২৫ মিনিট আগে লটারির মাধ্যমে সেট নির্ধারণ, ট্রেজারি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত প্রশ্ন নেয়ার একজন ম্যাজিস্ট্রেট সঙ্গে থাকাসহ বেশ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা, বিটিআরসিসহ অন্যান্য সংস্থাগুলো সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় থাকবে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ আরও বলা হয়েছে, সব সেট প্রশ্নপত্র কেন্দ্রে নিয়ে যেতে হবে। প্রতিটি বিষয়ের প্রশ্নপত্র সেটের জন্য একটি খাম ব্যবহার করা হবে। খামটি সিলগালা নয়, খাম থাকবে একটি বিশেষায়িত সিকিউরিটি টেপ দিয়ে আটকানো। জেলা প্রশাসকরা পরীক্ষা শুরুর আগে যে কোনো দিন ট্রেজারিতে এ কাজ সম্পন্ন করবেন। উপজেলা নির্বাহী অফিসার বা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের উপস্থিতিতে ওই সিকিউরিটি টেপ লাগাতে হবে। ট্রেজারি থেকে কেন্দ্রে প্রশ্ন নেয়ার জন্য একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নিয়োজিত থাকবেন। ট্রেজারি বা থানা থেকে কেন্দ্র সচিবসহ পুলিশের পাহারায় কেন্দ্রে প্রশ্নপত্র নিতে হবে। ম্যাজিস্ট্রেট বা দায়িত্বশীল কর্মকর্তা, কেন্দ্র সচিব ও পুলিশ কর্মকর্তার উপস্থিতি ও স্বাক্ষরে প্রশ্নপত্রের প্যাকেট খুলতে হবে।
এদিকে এসএসসি পরীক্ষা মতো এই পরীক্ষায় আগাম প্রশ্ন ফাঁসের ঘোষণা দিয়েছে একটি চক্র। ‘লাল আকাশ’ নামে ফেসবুকে একটি গ্রুপে প্রশ্নফাঁসের এ আগাম ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেখানে অগ্রিম টাকা পরিশোধ করার একটি বিকাশ নম্বর দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, এইচএসসি প্রশ্ন দিবো, ১লা এপ্রিল রাত ৩টায় লিখিত প্রশ্ন দেয়া হবে আর সকাল সাড়ে ৮টায় উত্তরসহ দেয়া হবে নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন। এজন্য প্রতি সাবজেক্টের জন্য ১ হাজার টাকা দিতে হবে। অগ্রিম ৫০০ টাকা দিলে প্রশ্ন দেয়া হবে। বাকি টাকা প্রশ্ন পাওয়ার পর দিতে হবে। বিজ্ঞাপনে আরো বলা হয়, এসএসসিতে টাকা ছাড়া প্রশ্ন দিয়ে ধরা খেয়েছি। তাই এবার অগ্রিম টাকা ছাড়া কোনো প্রশ্ন দেয়া হবে না। যাদের প্রশ্ন লাগবে তারা ০১৬৩২-৮৮০১৪১ এ নম্বরে যোগাযোগ করতে বিজ্ঞাপনে বলা হয়। এ প্রতিবেদক পরিচয় গোপন করে সংশ্লিষ্ট নম্বরে ফোন দিয়ে প্রশ্ন কীভাবে দেয়া হবে তা জানতে চাওয়া হয়। প্রশ্ন ফাঁসকারী চত্রেুর একজন সদস্য জানান, ০১৭৯১-৭৫৫৮৪৩ এ নম্বরে টাকা বিকাশ করার পর আপনার ফেসবুকের ইকবক্সে প্রশ্ন পাঠিয়ে দেয়া হবে। এজন্য আপনাকে লাল আকাশ এ ফেসবুক গ্রুপে যোগ দিতে হবে। প্রশ্ন পাবো এ নিশ্চিয়তা কীভাবে দিবেন এমন প্রশ্নে এ সদস্য বলে, এর আগেও দিয়েছি শতভাগ মিলেছে এবারও দিবো আশা করি মিলবে। তিনি বলেন, রাত ৩টায় লিখিত প্রশ্ন দেয়া হবে। আর সকাল সাড়ে ৮টায় উত্তরসহ নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন দেয়া হবে। তার ভাষ্য শিক্ষামন্ত্রী অনেক কথাই বলেন। কিন্তু বাস্তবে করেন না। ২৫ মিনিট আগে সেট নির্ধারণের বিষয়ে চক্রের এ সদস্য বলে, যত সেট করুক প্রশ্ন তো আর পরিবর্তন করতে পারবে না। সব সেটেই প্রশ্ন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই। সে প্রশ্ন ‘ক’ সেটের ১০ নম্বর ক্রমিকে সেটা ‘খ’ সেটের হয়তো অন্য কোন নম্বরে আছে। তাই যত সেট করুক প্রশ্ন মিলেই যাবে।
লাল আকাশ ছাড়া আরও বেশ কয়েকটি গ্রুপ এভাবে প্রশ্ন ফাঁসের অগ্রিম ঘোষণা দিয়েছে।
এ ব্যাপারে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেন, সব ধরনের প্রস্তুতি আমরা শেষ করেছি। জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়েছে। উত্তরপত্রও কেন্দ্রে পৌঁছে দেয়া হয়েছে। পরীক্ষা কেন্দ্রে আনুষঙ্গিক যে নিরাপত্ত তা নিশ্চিত করেছি। সব মিলিয়ে আমাদের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সকালে লটারি করে কোন সেট প্রশ্নে পরীক্ষা হবে তা নির্ধারণ করা হবে। পরীক্ষা শুরুর ৩০ মিনিট আগে জেলা প্রশাসককের জানিয়ে দেয়া হবে। তিনি কেন্দ্রে সচিবদের জানিয়ে দেবেন। তবে নিরাপত্তার স্বার্থে কোথায় বসে কেন্দ্রীয় লটারি হবে- তা তিনি জানাননি। এ বছর ১০টি বোর্ডের অধীনে ১৩ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ পরীক্ষার্থী অংশ নেবে। এরমধ্যে সাধারণ আটটি বোর্ডের অধীনে ১০ লাখ ৯২ হাজার ৬০৭ পরীক্ষার্থী অংশ নেবে। মাদ্‌রাসা বোর্ডের অধীনে ১ লাখ ১২৭ জন ও কারিগরি বোর্ডের অধীনে ১ লাখ ১৭ হাজার ৭৫৪ জন। বিদেশি কেন্দ্রে ৯৬৯ জন পরীক্ষার্থী অংশ নেবে। এবার ৮ হাজার ৯৪৩টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ২ হাজার ৫৪১টি কেন্দ্রে পরীক্ষা দেবে।

No comments

Powered by Blogger.