গালে নয়, হৃদয়ে আঁকতে হবে উল্কি by ড. মাহবুব উল্লাহ্

৭ মার্চ বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক দিন। এ দিনটিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে যে ভাষণ দিয়েছিলেন, পরিমিত সময়ের মধ্যেই সেটি তার বাগ্মিতা, আমাদের জাতীয়তাবোধের উন্মেষ ও বিকাশের বিশাল ক্যানভাসটির সুচারু উপস্থাপনা, দেশবাসীর প্রতি দিকনির্দেশনা প্রদান এবং শত্রুর ভয়ঙ্কর রণপ্রস্তুতির মুখে দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে জাতির আকাঙ্কাকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা এবং একইসঙ্গে হত্যাকাণ্ড এড়িয়ে চলার কুশলী দক্ষতা- এক শব্দে শুধু বলা যায় ‘অতুলনীয়’। এ কারণে তাকে কেউ কেউ রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ ভাষণটিকে রাজনীতির কবিতা বলে অত্যুক্তি করা হয়নি। ইতিহাসে তার এ ভাষণটি অনন্য বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল হয়ে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে। আজ আমার স্মরণ করতে গর্ব হয়, ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে মুক্ত হওয়ার পর তাকে সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে একই ময়দানে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়, সেই সংবর্ধনা সভায় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে আমি নিজেও একজন বক্তা ছিলাম। মজার ব্যাপার হল, মঞ্চে তার পাশেই আমি বসেছিলাম। আমার সংক্ষিপ্ত ভাষণে তার প্রতি কঠোর সাবধানবাণী উচ্চারিত হয়েছিল। আমি বলেছিলাম, পূর্ব বাংলার মুক্তি অর্জনের জন্য এদেশের শত-সহস্র মানুষ পুষ্পমাল্যের মতো বুলেটকে বুকে ধারণ করেছিল। তাদের এ নজিরবিহীন সাহসিকতা ও ত্যাগের প্রতি কোনোরকম কুণ্ঠাবোধ জাতি মেনে নেবে না। আমার বক্তব্য শেষে শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব আমার পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলেছিলেন, খুব তো কইলি, আমাকে ঝামেলায় ফেলাইলি। প্রত্যুত্তরে আমি বলেছিলাম, আমার বক্তৃতা আপনার জন্য সামান্যতম ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারবে না। কারণ আপনি আপনার দীর্ঘ রাজনীতি ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানেন কীভাবে এরকম ঝামেলা উৎরে যেতে হয়। আমার বক্তব্যের নির্যাসটুকু ছিল গোলটেবিল বৈঠক থেকে কোনো সুফল পাওয়া যাবে না। অথচ সেদিন তিনি মনস্থির করে ফেলেছিলেন, সংগ্রামকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তাকে আইয়ুব খান আহূত গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দিতে হবে।
সেই ২৩ ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান বুদ্ধিমত্তা এবং দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছিলেন, আমি গোলটেবিল বৈঠকে যাব। কেন যাব না? আমি কি আইয়ুব খানকে ডরাই! আমি আমার ছয় দফার কথা বলব, আপনাদের ১১ দফার কথা বলব, বাঙালির দাবির কথা বলব। তিনি আরও বলেছিলেন, ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবিতে তার ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য তিনি ছাত্রসমাজের প্রতি কৃতজ্ঞ। তাৎক্ষণিকভাবে রাজনীতির ধারাকে নিজ ধারার সঙ্গে সমন্বিত করার অপূর্ব দক্ষতা তার ছিল। উল্লেখ্য, শুধু ৭ মার্চের ভাষণ নয়, ১৯৬৯-এর ২৩ ফেব্রুয়ারির ভাষণটিও ছিল সবদিক থেকে অনন্য। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে অনেকে অনেক রকম কথা বলেন। কিন্তু সবটুকু এখনও বলা হয়নি। পুরো ইতিহাস উন্মোচনের জন্য আরও কয়েক দশক অপেক্ষা করতে হবে। প্রয়োজন হবে নিবিড় গবেষণা। এতে হয়তো অনেক কিংবদন্তি মুছে যাবে, আবার আসবে নতুন নতুন তথ্য, যা আমাদের উপলব্ধির জগৎকে প্রসারিত করবে। হবে নতুন কোনো বিশ্লেষণ। এটাই ইতিহাসের নিয়ম। ভারতবর্ষের ইতিহাসে গজনির সুলতান মাহমুদ সম্পর্কে অনেক কাহিনী ছড়িয়ে আছে। ব্রিটিশ শাসনামলের সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ সম্পর্কে যে বয়ান পাঠ্যপুস্তকে স্থান পেয়েছিল, সেই বয়ান হিন্দু ও মুসলমানের দূরত্বকে বহু যোজন বাড়িয়ে দিয়েছিল। ব্রিটিশ শাসকরাও এতে লাভবান হয়েছে। তাদের ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ নীতি কার্যকর করা সহজতর হয়েছে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের ইমেরিটাস অধ্যাপক রোমিলা থাপার বেশ ক’বছর আগে ‘সোমনাথ’ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ রচনা করেছেন। রোমিলা থাপার প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের একজন স্বনামখ্যাত বিশেষজ্ঞ। প্রাচীন ভারতীয় ভাষায় তার ব্যুৎপত্তি অতুলনীয়। সোমনাথ গ্রন্থে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের আলোকে গজনির সুলতান মাহমুদের সোমনাথ মন্দির আক্রমণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি বয়ান প্রতিষ্ঠিত করেছেন।
এ বয়ানের সারসংক্ষেপ হল, মন্দির আক্রমণটি কোনো সাম্প্রদায়িক প্রতিশোধের ঘটনা ছিল না। এটি ছিল নিছক একটি রাজনৈতিক ঘটনা। মধ্যযুগে যেসব যুদ্ধবিগ্রহ এ উপমহাদেশে হয়েছে সেগুলোর মধ্যে ধর্মীয় বিদ্বেষকে অপ্রাসঙ্গিক প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন এক সত্য যার মূলে ছিল রাজনৈতিক প্রভাব-প্রতিপত্তি ও সাম্রাজ্য বিস্তারের নেশা। সুলতান মাহমুদের সঙ্গে সোমনাথের অনেক ক্ষুদ্র হিন্দু নৃপতিও যোগ দিয়েছিলেন। যে কথাটি বলতে চাই তা হল, ইতিহাস সম্পর্কে শেষ রায়টি দেয়ার সময় কখনও আসে না। ইতিহাসের বয়ান নতুন নতুন আবিষ্কৃত ঘটনাবলির আলোকে বদলে যায়। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি সম্পর্কে ওই সময় যেসব সাংবাদিক এবং ঘটনাবলির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ছিলেন, তাদের মুখ থেকে শুনেছি ভাষণ দেয়ার আগে শেখ মুজিবের ওপর তরুণদের ভয়ানক চাপ ছিল সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার। এর ফলে তিনি ঠিক স্থির করতে পারছিলেন না, তার কতটুকু বলা উচিত এবং কতটুকু বলা উচিত নয়। তিনি তার বক্তব্যের সীমারেখা নির্ধারণে মনস্থির করার জন্য ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন। এমন সময় তার প্রিয় সহধর্মিণী বেগম ফজিলাতুননেছা তাকে বলেছিলেন, তুমি খেয়ে নাও, তারপর একটু বিশ্রাম নাও। জনসভায় কী বলতে হবে তা কি তোমাকে কেউ শিখিয়ে দেবে? জীবনে অনেক রাজনৈতিক ভাষণ তুমি দিয়েছ। কখনই তোমাকে চিন্তাগ্রস্ত হতে দেখা যায়নি। তুমি নিজের হৃদয়ের মধ্য থেকে দেশ ও দেশের মানুষের জন্য যা ভালো বলে মনে করবে, তাই বলবে। এরপর শেখ মুজিব প্রশান্ত চিত্তেই বক্তৃতা মঞ্চে এসে হাজির হয়েছিলেন। তার সেদিনকার ভাষণ ছিল উদ্দীপনার দিক থেকে খুবই ব্যতিক্রমী। ৭ মার্চের তাৎক্ষণিক পটভূমি সম্পর্কে আমি যে গল্পটি বললাম সেটি এখনও ইতিহাসের পদ্ধতিআশ্রয়ী গবেষণার দ্বারা সেভাবে প্রতিষ্ঠা পায়নি। অনেকটা জনশ্র“তির মতো এ গল্পটি চলে আসছে।
এর যথার্থতা প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজন হবে গভীর অনুসন্ধান। নিদেনপক্ষে যারা ওই সময় তার ধারে-কাছে ছিলেন তাদের সাক্ষাৎকার নিতে হবে। পরিতাপের বিষয় এদের অনেকেই হয়তো জীবিত নেই। সেই সময়কার ছাত্রলীগের নেতারা অনেকে এখনও জীবিত আছেন। তাদের সাক্ষাৎকার নেয়া প্রয়োজন। এছাড়া ঘটনাবলি প্রত্যক্ষকারী কেউ যদি কোনো চিঠিপত্র লিখে থাকেন অথবা স্মৃতিকথা লিখে থাকেন সেগুলোও ইতিহাসের বেশ মূল্যবান উপাদানস্বরূপ ব্যবহৃত হতে পারে। তবে যিনি ইতিহাস রচনা করবেন তাকে অবশ্যই ভাবালুতা ও আবেগের বিষয়গুলো যত্নসহকারে এড়িয়ে চলতে হবে। ব্যক্তিগতভাবে আমার দুর্ভাগ্য হল, আমি সেই সভায় উপস্থিত ছিলাম না। কারণ আমি ছিলাম কারারুদ্ধ। স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক পূর্ববাংলার কর্মসূচি উত্থাপনের অপরাধে সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে আমাকে সশ্রম কারাদণ্ড ও বেত্রদণ্ড দেয়া হয়েছিল। সামরিক আদালতের ভাষায় আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, Advocating territorial dismemberment of Pakistan. সুতরাং সহৃদয় পাঠককে সবিনয়ে বলব, আমার বিবৃত কাহিনীকে তারা যেন প্রামাণ্য ইতিহাস বলে গ্রহণ না করেন। এ বছর বিশাল আয়োজনের মধ্য দিয়ে ৭ মার্চের দিবসটি উদযাপিত হয়েছে। এ রকম হওয়া অনাকাক্সিক্ষত কিছু নয়। কিন্তু ৭ মার্চের জনসমাবেশটি শেষ হওয়ার পর নারী-পুরুষ, শিশু, তরুণ-তরুণীরা যখন হেঁটে ঘরে ফিরছিলেন, তখন খুবই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটে। অনেক নারী ও তরুণী লাঞ্ছনার শিকার হন। অনেকে লজ্জায় ও দুঃখে এ ঘটনা সম্পর্কে মুখ খোলেননি। তবে শুনেছি সোশ্যাল মিডিয়াতে এর কিছুটা প্রকাশ পেয়েছে। এদেশে এখন অনেকে চরম বিপদের মুখে পড়েও কী বিপদ হয়েছিল সে সম্পর্কে মুখ খুলতে চান না! গুম হয়ে যারা সৃষ্টিকর্তার অসীম কৃপায় আপনজনদের কাছে ফিরে এসেছেন তারাও কেউ মুখ ফুটে বলেননি তাদের জীবনের ওপর দিয়ে কী ঝড় বয়ে গেছে। একইভাবে এবারকার ৭ মার্চের নির্যাতিতরাও অনেকে মুখ খোলেননি। শুনেছি একটি মামলা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ মামলার পরিণতি কী হবে তা বলা মুশকিল। আশ্চর্যের ব্যাপার হল, দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে এ সংক্রান্ত সংবাদ আসেনি বললেই চলে। হয়তো সংবাদপত্রের মালিক ও সম্পাদকরা সরকারকে বিব্রত করতে চাননি। হয়তো কোনো মহৎ চিন্তাও তাদের এ পদক্ষেপ নেয়া থেকে বিরত রেখেছে।
হতে পারে, আমাদের জাতীয় ইতিহাসের পবিত্র এ দিনটি যাতে কলঙ্কিত না হয়ে যায়, সেটাই তারা চেয়েছেন। আমি ভাবতে পারি না, ৭ মার্চের মতো পবিত্র ও ভাবগাম্ভীর্যময় দিনে যেসব পাষণ্ড এমন পাপাচারে লিপ্ত হয়েছে তারা কোথা থেকে এমন সাহস পায়। কেউ কেউ বলবেন, বিচারহীনতার সংস্কৃতির জন্য এ ঘটনা সংঘটিত হতে পেরেছে। আমি তাদের সঙ্গে একমত হতে পারি না। মানুষের জীবনে এমন কিছু সময় ও মুহূর্ত আসে যখন মানুষ নিজেকে নিজে শাসন করে। সব রকমের কালিমা-কলঙ্ক থেকে দূরে থাকার জন্য অসীম নিষ্ঠার পরিচয় দেয়। যে স্বাধীনতা আসবে বলে আমাদের রাষ্ট্রের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান এমন চেতনা জাগানিয়া ভাষণ দিয়েছিলেন, যে স্বাধীনতা আসবে বলে হরিদাসীর সিঁথির সিঁদুর মুছে গিয়েছিল, যে স্বাধীনতা আসবে বলে ‘মায়ের নোলক’ হারিয়ে গিয়েছিল, সেই স্বাধীনতার কাহিনীর সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত এ দিনটিতে কী করে কিছু মানুষ এত পাষণ্ড হয়ে পড়ল! আমি একবার বিটিভিতে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ দুর্জনকে সজ্জনে পরিণত করেছিল। আজ এ কী দেখছি! মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার চেতনার বিপরীতে এমন দুর্বৃত্তসুলভ স্পর্ধা কী করে এদেশের একটি মানুষও দেখাতে পারে! ফরাসি ঔপন্যাসিক মলিয়েরের এক চরিত্র সারাজীবন গদ্যে কথা বলেছে, অথচ সে জানে না, গদ্য কী। ঠিক তেমনি আমরাও কি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে যাব, এর তাৎপর্য না বুঝে এবং জীবনে তার অনুশীলন না করে? শুধু কপাল ও মুখমণ্ডলে মুক্তিযুদ্ধের উল্কি এঁকে মুক্তিযুদ্ধকে পাওয়া যাবে না। এর জন্য প্রয়োজন হবে হৃদয়ের ক্যানভাসে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ছবিটি আঁকা।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ

No comments

Powered by Blogger.