সহিংসতা নয়, চাই নারীর মর্যাদা by দিলরুবা খানম প্রধান

ব্যক্তির সুষ্ঠু বিকাশ, কাঙ্ক্ষিত ও সুস্থ জীবনের জন্য সামাজিকীকরণ প্রয়োজন। সামাজিকীকরণের প্রথম ও শক্তিশালী ক্ষেত্র হলো পরিবার। পরিবার মানুষের সবচেয়ে নিরাপদ আবাসস্থল। কিন্তু সেই পরিবারেই নারীর প্রতি সবচেয়ে বেশি সহিংসতা ও নির্যাতনের ঘটনা সংঘটিত হচ্ছে। পরিবারের সদস্য, বিশেষ করে স্বামীর দ্বারা জীবনের কোনো না কোনো সময় নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন নারী। বৃহত্তম বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের ২০১৭ সালে সংঘটিত নারী নির্যাতন সংক্রান্ত সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে :নির্যাতনের শিকার নারীদের মধ্যে ৮২ শতাংশ বিবাহিত, ১৭ শতাংশ অবিবাহিত এবং অন্যান্য এক শতাংশ। দেখা যাচ্ছে, বিবাহিত নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি ২০১৭ সালে মোট ১০ হাজার ৫৯৬টি নারী নির্যাতনের ঘটনা নথিভুক্ত করেছে। যার মধ্যে ৭৭ শতাংশ পারিবারিক নির্যাতন। ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) পরিচালিত এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ নারী বিবাহিত জীবনে একবার হলেও নিজ গৃহে নির্যাতিত হন। এক থেকে ৩৫ বছর বয়সী নারীরা বেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নির্যাতনের ধরন : যৌতুকজনিত, যৌন, শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক নির্যাতন। এর মধ্যে যৌতুকজনিত যৌন ও শারীরিক নির্যাতনের মাত্রা ভয়াবহ মাত্রায়। ২০১৭ সালে সংঘটিত নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বিশ্নেষণে দেখা যায়, ৩২ শতাংশ ঘটনাই ঘটেছে যৌতুকজনিত কারণে আর পারিবারিক সংঘাতজনিত কারণে ২৪ শতাংশ নির্যাতন হয়েছে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের রিপোর্ট অনুযায়ী ২০১৭ সালে ৮৯৪ জন নারীশিশু (১৮ বছরের নিচে) যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে। নির্যাতনের ধরনগুলো হলো :ধর্ষণ, জখম, পর্নোগ্রাফির শিকার। যার মধ্যে ৫৯৩ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছে। ধর্ষণের পর শিশুহত্যা বা শিশুর আত্মহত্যার ঘটনাও আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। নারীশিশুরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিকটাত্মীয়, প্রতিবেশী বা পরিচিত মানুষ দ্বারাই নির্যাতিত হচ্ছে। সমাজের একেবারে নিম্নস্তর থেকে উচ্চতর পর্যন্ত এসব সহিংসতার চিত্র ফুটে উঠছে। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্যমতে, ২০১৭ সালে সারাদেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনায় ১৭ হাজার ৭৩টি মামলা হয়েছে। বিবিএসের জরিপে আরও দেখা গেছে, বাংলাদেশে ৮০ শতাংশ নির্যাতনের বিপরীতে মাত্র ২.৬ শতাংশ বিবাহিত নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়েছেন। নির্যাতিত নারীরা সামাজিক মর্যাদা, আইনি জটিলতা, মানবিকতা সর্বোপরি বৃহত্তর পারিবারিক স্বার্থে পুরুষের পাশবিকতা ও নিষ্ঠুরতা সত্ত্বেও উদার হচ্ছেন, তাদের ক্ষমা করছেন, বস্তুত পুরুষকে করুণা করছেন। নারীরা মেনে নিয়ে বা মানিয়ে নিয়ে সমাজে চলছেন। যখন কোনো নারী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন, সঙ্গে তার পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এক জরিপে দেখা গেছে, নারী নির্যাতনের কারণে বছরে মোট জিডিপির ২.১৩ শতাংশ ক্ষতি হচ্ছে। প্রভাব পড়ছে রাষ্ট্রের উন্নয়নের ওপরও। অন্যদিকে বর্তমানে নারীর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অনেক সফলতা ও অগ্রগতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। আজকের নারীরা রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। নারীরা শুধু ঘর আর সন্তান সামলানো নয়, বিভিন্ন পেশায়, নীতিনির্ধারণী, সাহিত্য, ক্রীড়া এমনকি পর্বতারোহণের মতো চ্যালেঞ্জিং কাজেও সফলতা দেখাচ্ছেন। পোশাক শিল্পে নারীর অবদান গর্ব করার মতো। পুরুষের পাশাপাশি নারীরা নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্রের টেকসই উন্নয়নে আত্মনিয়োগ করছেন, সহযাত্রী হিসেবে কাজ করছেন। সাম্যবাদের কবি কাজী নজরুল ইসলাম যথার্থই বলেছেন, 'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।' নারীদের যাবতীয় প্রতিবন্ধকতা দূর করে নারী-পুরুষে সমতা আনয়ন করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন পুরুষশাসিত সমাজে নারীর ক্ষমতায়ন। আর নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান শর্ত হচ্ছে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বতা। এই স্বাধীনতা ভোগ করছেন নারী সমাজের ক্ষুদ্র অংশ, বিস্তৃত অংশ নানাভাবে নিপীড়ন ও নির্মমতার শিকার হচ্ছেন। বর্তমান যুগে নারীর অনেক প্রাপ্তি নারীর সামনে এগিয়ে চলাকে সাফল্যের দ্বারে পৌঁছে দিচ্ছে; অন্যদিকে নারীর প্রতি সহিংসতা নারীর পথচলাকে ও অগ্রসরতাকে বাধাগ্রস্ত করছে।
নারীরা এখন অনেক আত্মসচেতন ও প্রতিবাদী হয়েছেন। বর্তমান সময়ে নারীদের ভোগ্যপণ্য ভাবার সুযোগ নেই। তারা এখন অনেক আত্মপ্রত্যয়ী। নারী-পুরুষ সম্পর্কের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সবাইকে বেরিয়ে আসতে হবে। সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ সৃষ্টির অর্ধেক হলো নারী আর নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারী সমাজকে যখন সামাজিক কুসংস্কার, অশিক্ষা, ধর্মীয় গোঁড়ামির শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে অন্ধকারে, অন্তরালে রাখা ছিল, তখন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া নারী সমাজকে জাগ্রত করে সভ্যতার আলোয় উদ্ভাসিত করতে এগিয়ে আসেন। তিনি যথাযথ বলেছেন- 'নারী-পুরুষ একটি গাড়ি দুটি চাকা।' নারী-পুরুষ সমঅধিকার ও ক্ষমতায়নের বিষয়ে আমাদের পবিত্র সংবিধানে সুস্পষ্ট বিধান রয়েছে। পরিবার যেহেতু প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, পরিবার থেকেই ছেলেসন্তানটিকে নারীর প্রতি ইতিবাচক ও শ্রদ্ধাশীল হতে শেখাতে হবে। পুরুষশাষিত সমাজে পুরুষের কর্তৃত্বপরায়ণতা ও পিতৃতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করে বন্ধুত্বপূর্ণ হতে হবে। সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নারীর প্রতি পুরুষের সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি, আচার-আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে। নারী নির্যাতন সংক্রান্ত বিভিন্ন সভা-সমাবেশ ও অনুষ্ঠানাদিতে পুরুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং প্রচার-প্রচারণার মাধ্যমে গণসচেতনতা বাড়াতে হবে। যদিও নারী সংগঠনগুলো বহুমুখী পদক্ষেপ নিচ্ছে এবং বর্তমান সরকারও নারীর ক্ষমতায়ন ও উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। তারপরও সর্বোপরি রাষ্ট্রকে শুধু আইন প্রণয়ন বা সংশোধন নয়, প্রয়োগেও কঠোর হতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতার ধরন, কৌশল ও নির্যাতনের মাত্রা দিন দিন উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে, ঘটছে নিষ্ঠুরতম ঘটনা। নারীর প্রতি আর সহিংসতা নয়, সর্বাগ্রে আপনারা মানুষ হন, তাদের মানুষ ভাবুন এবং তাদের প্রতি মানবিক ও শ্রদ্ধাশীল হোন। নারী-পুরুষ একসঙ্গে একটি সুস্থ ও সুন্দর পরিবার, সমাজ ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বিনির্মাণে এক কাতারে আসুন। আর নারীর প্রতি যে ১৮ শতাংশ পুরুষ মানবিক, শ্রদ্ধাশীল, সংবেদনশীল ও দায়িত্বশীল আছেন, শ্রদ্ধা রইল তাদের প্রতি। এ বছর আন্তজার্তিক নারী দিবসের প্রতিপাদ্য ছিল-'সময় এখন নারীর : উন্নয়নে তারা, বদলে যাচ্ছে গ্রাম-শহরে কর্মজীবন ধারা', যা বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই সামঞ্জস্যপূর্ণ ও সময়োপযোগী।
ডেপুটি কিউরেটর, শহীদ স্মৃতি সংগ্রহশালা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

No comments

Powered by Blogger.