বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো by বিমল সরকার

অনেকদিন আগে পরিবার পরিকল্পনাবিষয়ক একটি গল্প শুনেছিলাম। ডাক্তার সাহেব অত্যন্ত দক্ষ। বেশ সুনাম আছে তার। চার সন্তানের জনক পঞ্চাশোর্ধ্ব সরল প্রকৃতির এক ব্যক্তি গ্রাম থেকে অনেক দূরে শহরে অবস্থিত কেন্দ্রে গিয়ে ওই ডাক্তারের কাছে ভ্যাসেকটমি করিয়ে আসেন। পুরুষের জন্য অত্যন্ত নিরাপদ ও সুন্দর বন্দোবস্ত নিশ্চিত জেনেই তিনি এ পদ্ধতি গ্রহণ করেন। পদ্ধতি গ্রহণের পরও মোটামুটি ভালোই চলছিল তাদের সংসার ও দাম্পত্য জীবন। পরস্পরের প্রতি বিশ্বাসের কোনো কমতি ছিল না। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল বছর না যেতেই তার স্ত্রী নতুন করে গর্ভবতী হওয়ায়। তারা হতভম্ব হয়ে পড়লেন। এমনটি তো হওয়ার কথা ছিল না। এ নিয়ে মনে দুশ্চিন্তা ও উৎকণ্ঠা দেখা দেয়। সংসারেও অশান্তি। স্বামী-স্ত্রী কেউই এ অনভিপ্রেত পরিস্থিতির জন্য তৈরি ছিলেন না। ভদ্রমহিলা তো রেগেমেগে পরিবার পরিকল্পনা কেন্দ্রের সংশ্লিষ্ট ডাক্তারের অদক্ষতা কিংবা খামখেয়ালিপনাকেই দায়ী করে বসেন। এমনই সংশয়-সন্দেহের দোলাচলের মধ্যে কয়েকটি দিন কাটিয়ে অবশেষে ভদ্রলোক একদিন ডাক্তারের কাছে গিয়ে উপস্থিত হলেন। তার কাছে পরিস্থিতির আদ্যোপান্ত ব্যক্ত করলেন। ডাক্তার সাহেব গভীর মনোযোগের সঙ্গে সবকিছু শুনে প্রথমে কিছুটা বিস্মিতই হলেন। পরক্ষণেই কী ভেবে ভদ্রলোকটিকে উদ্দেশ করে বললেন, ‘শুনুন, আমাদের পদ্ধতি কিংবা দক্ষতা-অদক্ষতা নিয়ে এখানে প্রশ্ন তোলার কোনো অবকাশ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। অতএব এ ব্যাপারে আপনি অন্য চিন্তা করুন।’ ভদ্রলোক একটি সান্ত্বনা-প্রবোধ পাওয়ার আশা নিয়ে ডাক্তারের কাছে এসেছিলেন।
কিন্তু তার মুখ থেকে এসব কথা শুনে তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন। তিনি বললেন, ‘কেন ডাক্তার সাব, আপনি যা বলেছেন আমি তো তাই করেছি। টাকা-পয়সা কম দিইনি, তাছাড়া যেভাবে যা যা করতে বা পালন করতে বলেছেন, আমি তাই করেছি এবং এখনও করে চলেছি। তাহলে?’ এবার ডাক্তার বললেন তার মনের আসল কথাটি- ‘আপনার এসব কথা ঠিকই আছে। আপনাকে আমি অবিশ্বাস করছি না। কিন্তু দেখুন, আমি আপনার শরীরে নিয়ম-বিধি অনুসরণ করে পদ্ধতি সম্পন্ন করে দিয়েছি। এতে কোনো ভুল নেই। ব্যক্তিগতভাবে আপনিও সঠিক বলেছেন বা করছেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে, আমি কিন্তু আপনাকেই কেবল পদ্ধতির আওতায় এনেছি। গ্রামের অনেক পুরুষ কিন্তু এখনও পদ্ধতির বাইরেই রয়ে গেছে। অতএব পদ্ধতি গ্রহণের পর আপনার স্ত্রীর গর্ভধারণের সঠিক কারণ বলা বা কৈফিয়ত দেয়া আমার মতো ডাক্তারের পক্ষে সম্ভব নয়।’ গল্পটির শেষ এখানেই। গতবার এইচএসসি পরীক্ষা চলাকালে আকস্মিক জানতে পারি, আমার তিন সহকর্মী এ বছর (২০১৭) এইচএসসি পরীক্ষায় কোনো দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রয়েছেন। তাদের সন্তানরা পরীক্ষার্থী। অতএব নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে পরীক্ষা গ্রহণের স্বার্থে বোর্ডের নির্দেশনা অনুযায়ী এ ব্যবস্থা। অবশ্য পরীক্ষার্থী হলেও সহকর্মীর সন্তানদের কারোরই পরীক্ষার কেন্দ্র আমাদের কলেজে নয়। একজন ঢাকায়, একজন জেলা সদরে এবং অন্য একজন পার্শ্ববর্তী উপজেলা সদরে বসে পরীক্ষা দেবে। শুনে আমি বিস্মিত হলাম। ২০ বছর, ২৫ বছর কিংবা ৩০ বছর ধরে আমরা একই সঙ্গে শিক্ষকতা করছি। তা-ও নিজের কলেজের পরীক্ষার্থী হলে না হয় মানা যেত। শত কিলোমিটার, পঞ্চাশ কিলোমিটার দূরবর্তী কেন্দ্রে বসে একেকজন পরীক্ষা দেবে। বিষয়টি আমার কাছে খুবই অসঙ্গতিপূর্ণ বলে মনে হল। অন্যরা যেমন-তেমন, তাদের মধ্যে কলেজের স্বয়ং অধ্যক্ষ মহোদয়ও রয়েছেন। অনার্সসহ ডিগ্রি পর্যায়ের একটি বড় পরিসরের কলেজে অধ্যক্ষের ব্যস্ততার কোনো সীমা নেই।
আছে কাজের ধারাবাহিকতা ও গতিশীলতার বিষয়টিও। কিন্তু না। যেহেতু তার সন্তান এ বছর পরীক্ষায় অবতীর্ণ হচ্ছে (ঢাকায়), অতএব পরীক্ষা সম্পর্কিত সব কর্মকাণ্ড থেকে তিনি বিরত থাকবেন। দু-চার দিন নয়, দীর্ঘ এক-দেড় মাস; অর্থাৎ যতদিন না পরীক্ষা শেষ হয়। এ বিবেচনায় নিয়ম অনুযায়ী অধ্যক্ষের স্থলে কলেজের একজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে কেন্দ্র সচিবের দায়িত্ব দেয়া হয়। জানা গেছে, গত ক’বছর ধরে পাবলিক পরীক্ষায় নকল আবার যেভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে এবং একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়ে চলেছে তা প্রতিরোধ করতেই নাকি এ ব্যাপারে শিক্ষা বোর্ডের এরূপ কড়াকড়ি। এসএসসি পরীক্ষায় এবার (২০১৮) দেখলাম অন্য এক বিরল দৃষ্টান্ত। ছেলে পরীক্ষার্থী, তাই পরীক্ষার সময় নিষ্কলুষ থাকার জন্য স্বেচ্ছায় অব্যাহতি নিয়েছেন চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ মাহবুব হাসান। তার স্থলে পরীক্ষাসংক্রান্ত দায়িত্ব দেয়া হয় উপপরীক্ষা নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ তাওয়ারিক আলমকে। বোর্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর শাহেদা ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ১ ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের এসএসসি পরীক্ষা। পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কাজের সঙ্গে কোনো শিক্ষার্থী কিংবা পরীক্ষার্থীর সংশ্লিষ্টতার কোনো সুযোগ নেই। তবুও ছেলের অংশগ্রহণের কারণে আমাদের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক এসএসসি পরীক্ষায় তার দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি চেয়ে আবেদন করেছেন। তাই তাকে সাময়িকভাবে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে। এ আদেশ পরীক্ষার শুরুর দিন থেকে চূড়ান্ত ফল প্রকাশ পর্যন্ত কার্যকর থাকবে (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ১৩ জানুয়ারি ২০১৮)। আমাদের দেশে যে কোনো পাবলিক পরীক্ষা অনুষ্ঠানে কিছু সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। যেমন কোনো শিক্ষকের সন্তান, স্বামী বা স্ত্রী কিংবা অন্য কোনো আপনজন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করলে তিনি সে পরীক্ষার পরীক্ষক মনোনীত হবেন না। একটা সময় ছিল, এমনকি আশি ও নব্বইয়ের দশকেও আমরা প্রতিষ্ঠানে বা কেন্দ্রে নিজের ছেলেমেয়ের হলে (পরীক্ষার হল) পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেছি। বিধিবিধানে কী আছে আমরা সাধারণ শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই তা বিস্তারিত জানি না। অধ্যক্ষ বা প্রধান শিক্ষকরা ভালো জানেন। এসব কিছু জানার চেয়ে আমরা বরাবরই বেশি গুরুত্ব দিয়েছি সঠিক ও যথাযথভাবে দায়িত্ব পালনের বিষয়টির ওপর। এ ব্যাপারে কখনও কোথাও কারও মনে প্রশ্নের উদ্রেক হয়েছে বলে অনুভূত হয়নি। সৃষ্টি হয়নি কোনো ধরনের বিপত্তির।
কিন্তু আজ? পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুষ্ঠুভাবে নকলমুক্ত পরিবেশে পরীক্ষা গ্রহণের ঘোষণা ও দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি, ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ, পরীক্ষা শুরু হওয়ার ৩০ মিনিট আগে পরীক্ষার্থীর কেন্দ্রে প্রবেশ নিশ্চিতকরণ, মোবাইল ফোন ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ, পুরস্কার ঘোষণাসহ আরও কত রকমের ব্যবস্থা। পরীক্ষা শুরুর ছয় দিন আগে থেকে দেশের কোচিং সেন্টারগুলো বন্ধ রাখা হয়। এ নিষেধাজ্ঞা পরীক্ষা শেষ না হওয়া পর্যন্ত কার্যকর রাখা হয়। কিন্তু তারপরও কি শেষ রক্ষা হয়েছে? শিক্ষামন্ত্রী মহোদয় পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে পরীক্ষা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দিকনির্দেশনা প্রদানের পাশাপাশি মতলববাজদের উদ্দেশে কঠোর হুশিয়ার বাণীও উচ্চারণ করেছেন। আমাদের দুর্ভাগ্য যে এতসবের পরও চোরারা কেউই ধর্মের কাহিনী শোনেনি। একের পর এক বলতে গেলে সব প্রশ্নপত্রই ফাঁস হয়ে যায়। তাই আমাদের আসল গলদটি কোথায় তা খুঁজে বের করাটা অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। পঞ্চাশ মাইল, সত্তর মাইল, একশ’ মাইল দূরবর্তী স্থানে সন্তান পরীক্ষা দেয়; আমরা আইন মেনে পরীক্ষার দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রইলাম। সন্তান পরীক্ষার্থী বলে পরীক্ষাকে নিষ্কলুষ রাখার স্বার্থে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রইলাম; অন্য আরও যা যা বিধিবিধান তা তো মানলামই বা এখনও মানছিই। তাহলে? এই দুরপনেয় কালিমা লাগল কেন? প্রশ্নফাঁস রোধে এমন সর্বাত্মক ও ব্যাপক প্রস্তুতি মনে হয় ইতিপূর্বে আর কখনও নেয়া হয়নি। কিন্তু থামানো যাচ্ছে না কিছুতেই। বিষয়টি মতলববাজ স্বার্থান্বেষী ছাড়া গোটা জাতিকেই আজ ভাবিয়ে তুলেছে। তাহলে গলদটি কোথায়? পরীক্ষায় এমসিকিউ প্রশ্ন উঠিয়ে দেয়ার কথাও ভাবা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের ‘জুতা আবিষ্কার’-এর ঠিক যেন আগের পরিস্থিতি! তবে যাই করা হোক না কেন, প্রশ্নপত্র ফাঁস রোধে আরও কৌশলী ও কঠোর হতে হবে। আর গল্পে উল্লিখিত ডাক্তার সাহেবের কথাগুলো তো অনুধাবন করতেই হবে।
বিমল সরকার : সহকারী অধ্যাপক, বাজিতপুর কলেজ; কিশোরগঞ্জ

No comments

Powered by Blogger.