অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন

সংবিধান অনুযায়ী আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এখনো দশ-এগারো মাস বাকি। যদিও এখন থেকেই নির্বাচনের তোড়জোড় শুরু হয়ে গেছে। ২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে এ নির্বাচন নিয়ে বাড়তি আগ্রহ ও কৌতূহল রয়েছে বিদেশিদেরও। ইউরোপীয় পার্লামেন্টারি (ইপি) প্রতিনিধিদলের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের উদ্দেশ্য যে ছিল আগামী নির্বাচন, সে কথা তারা পরিষ্কার করেই জানান দিয়ে গেছে। তিন দিনের সফরে এসে প্রতিনিধিদলটি জাতীয় সংসদের স্পিকার, প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেছে, যাতে ঘুরেফিরে নির্বাচন, সুশাসন ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার অগ্রাধিকার পেয়েছে।
প্রতিনিধিদলের নেতা জিন ল্যামবার্ট বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিকে কঠিন ও চ্যালেঞ্জিং হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, তাঁরা অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চান। নির্বাচন কমিশন যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে এবং ভোটাররা স্বাধীনভাবে তাঁদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারেন, সেই নিশ্চয়তাও চেয়েছেন তিনি। ইউরোপীয় পার্লামেন্ট আমাদের প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু ২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচন হওয়ায় তারা কোনো পর্যবেক্ষক পাঠায়নি। এবারও পাঠাবে কি না, তা নির্ভর করছে নির্বাচন কী রকম হয়, তার ওপর। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদার সঙ্গে বৈঠকে ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধিদল জানতে চায় জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় বর্তমানে কারাবন্দী খালেদা জিয়া আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন কি না। জবাবে সিইসি বলেছেন, এ ব্যাপারে আদালতই সিদ্ধান্ত নেবেন, ইসির কিছু করার নেই। আমরাও মনে করি, খালেদা জিয়ার আইনি লড়াইকে কোনোভাবে রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত করা ঠিক হবে না। অতীতে নিম্ন আদালতে দণ্ডিত হওয়ার পর সরকারি দলের অনেক নেতা উচ্চ আদালতে আপিল করে নির্বাচন করেছেন, মন্ত্রী-সাংসদ হয়েছেন। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রে কী হয়, তা দেখার জন্য আমাদের আরও কিছু সময় অপেক্ষা করতে হবে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তথা মাঠ সমতল করার দায়িত্ব সরকার ও নির্বাচন কমিশনের। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, সরকারি দলের নেতারা নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিলেও বিরোধী দলের নেতা-কর্মীরা গ্রেপ্তারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। বিএনপির কেন্দ্রীয় ও জেলা পর্যায়ের অনেক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তাঁদের সভা-সমাবেশ করতেও দেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় তফসিল ঘোষণার পর কমিশন তার ভূমিকা পালন করবে—এমন দোহাই দিয়ে ইসি নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করতে পারে না। খালেদা জিয়ার মামলার রায় ঘোষণার পর মানববন্ধন, অনশন ও স্মারকলিপি প্রদানের মধ্যেই মূলত বিএনপির কর্মসূচি সীমিত রয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায় যে প্রতিকূল পরিবেশ সত্ত্বেও দলটি নির্বাচনে যেতে প্রস্তুত, যা তারা ইউরোপীয় পার্লামেন্ট প্রতিনিধিদলকেও জানিয়েছে। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকও বলেছেন, তাঁরাও চান বিএনপি নির্বাচনে আসুক। সে ক্ষেত্রে সবারই কর্তব্য হবে নির্বাচনের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে সহায়তা করা। তবে প্রতিবার নির্বাচনের আগে বিদেশিরা এসে আমাদের সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তাগিদ দিয়ে যাবেন, আর নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন—এই বাস্তবতা পাল্টানো জরুরি হয়ে পড়েছে। এটি যেকোনো গণতান্ত্রিক ও আত্মমর্যাদাশীল জাতির জন্য লজ্জাজনক। সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের নজির স্থাপন করে আমরা এই পরিস্থিতি পাল্টাতে পারি। আশা করি, আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বোধোদয় হবে এবং তাঁরা আরেকটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন করে জাতিকে ফের লজ্জায় ফেলবেন না।

No comments

Powered by Blogger.