প্রাথমিকে ছুটি বৈষম্যের অবসান হোক



বিগত বছরগুলোতে প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের, এমনকি খোদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টদের মুখ্য কাজ যেন ছিল শিক্ষকদের সমস্যা জিইয়ে রাখা। সমস্যা সমাধানে আন্তরিক না হয়ে তারা এতে প্যাঁচ লাগিয়ে দেয়ার কাজে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। বর্তমান সরকারের শিক্ষায় অর্জন অসংখ্য। এগুলোকে ম্লান করে দিচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী প্রশাসনের অভ্যন্তরে ঘাপটি মেরে থাকা কিছু কর্মকর্তা। পাকিস্তান আমল থেকে চলে আসছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক ছুটি ৭৫ দিন। এ ছুটি উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজে ৮৫-৯০ দিন। এখনও ৭৫ দিন ছুটির তালিকা প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় অনুমোদন করে আসছে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ছুটির পরিমাণ উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজের সমপরিমাণ থাকা বাঞ্ছনীয়। কারণ ছোট ছোট শিশুদের কিচিরমিচির হইচই-এর মাঝে প্রাথমিক শিক্ষকদের দায়িত্ব পালন করতে হয়। তাই তাদের মস্তিষ্কের বেশি বিশ্রাম প্রয়োজন। অথচ ৭৫ দিন ছুটি নিয়েই নানা টালবাহানা করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষকরা তো বেশি ছুটি চায় না। অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর মতো ৩ বছর পরপর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা চায়। প্রত্যেক মানুষ জীবনের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য কিছু না কিছু পরিকল্পনা করে থাকেন। পেশাজীবী হিসেবে প্রাথমিক শিক্ষকরাও এর ব্যতিক্রম নন। লক্ষ্যে সফল হওয়ার মূলমন্ত্র হচ্ছে পরিকল্পিত কাজ। মানবজাতি তার কাজের মাধ্যমেই গুহাজীবন ত্যাগ করে আজকের সভ্যজীবনে প্রবেশ করেছে। এর পেছনে কি শুধুই কাজের ভূমিকা ছিল? বিশ্রামও কিন্তু ভূমিকা রেখেছে। কাজের পাশাপাশি মানুষ তার চিত্তকে বিকশিত করতে নানা সময় নানাভাবে বিশ্রামের সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কারণ পর্যাপ্ত বিশ্রাম পরবর্তী কার্য সম্পাদনকে সহজ করে এবং সৃজনশীলতার নতুন মাত্রা যোগ করে। কবি যথার্থই বলেছেন- ‘বিশ্রাম কাজের অঙ্গ একসাথে গাঁথা, নয়নের অঙ্গ যেন নয়নের পাতা।’ বিশ্রাম কর্ম পরিকল্পনাকে নষ্ট করে না বরং কর্মস্পৃহাকে বহুগুণ বাড়িয়ে দেয়। শিশু শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠগ্রহণকে সহজসাধ্য ও আনন্দদায়ক করতে এবং নবোদ্যমে বিদ্যার্জনে ব্রতী হতে বিদ্যালয়গুলোতে ছুটির বিধান রাখা হয়েছে। কাজের গুণগত মান বিকাশে বিশ্রামের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতি বছরের মতো এ বছরও প্রাথমিকে ছুটির তালিকায় জাতীয় দিবসগুলোকে ছুটি দেখিয়ে বিদ্যালয়ে জাতীয় দিবস পালন করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ছুটি দেখানোর ফলে শিক্ষকরা দায়সারাভাবে উক্ত দিবসগুলো পালন করে থাকেন। যার ফলে আগামী প্রজন্ম দেশ তথা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে যথাযথভাবে জানতে পারছে না। দেশের ইতিহাস-সংস্কৃতি সঠিকভাবে জানতে না দেয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এ প্রেক্ষাপটে একুশে ফেব্র“য়ারি, শহীদ দিবস, জাতির জনকের জন্মদিবস, স্বাধীনতা দিবস, বাংলা নববর্ষ, জাতীয় শোক দিবস, বিজয় দিবসকে কর্ম দিবস হিসেবে দেখানো হোক।
এতে সব শিক্ষার্থী বাধ্যতামূলকভাবে বিদ্যালয়ে উপস্থিত হয়ে বাঙালি জাতির ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। এতে শিক্ষকদেরও জাতীয় দিবসে বাধ্যতামূলক উপস্থিত হয়ে দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করার সুযোগ থাকবে না। প্রতিবছরই ছুটির তালিকা নিয়ে শিক্ষকদের মাঝে চরম অসন্তোষ বিরাজ করে থাকে। অনলাইন, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় এ ব্যাপারে লেখালেখি ও আলোচনার পরও এক্ষেত্রে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। সংশ্লিষ্টরা প্রাথমিক শিক্ষকদের অন্যান্য সরকারি কর্মচারীদের মতো ৩ বছর পরপর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাওয়ার অধিকার হরণ করে যাচ্ছে। অথচ ছুটির তালিকায় গ্রীষ্মের ছুটি ১৫ দিন না থাকায় প্রাথমিক শিক্ষকরা ৩ বছর পরপর শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাওয়ার অধিকার রাখে। কারণ, সরকারি কর্মচারীরা ৩ বছর পরপর ১৫ দিনের ছুটিসহ ভাতা পান। এক্ষেত্রে ৭৫ দিনের ছুটির মধ্যে ১৫ দিনের গ্রীষ্মের ছুটি রাখা কী অযৌক্তিক? প্রাথমিক শিক্ষকরা তো ৭৫ দিনের বেশি ছুটি দাবি করেন না। অন্যান্য বছরের মতো এ বছরও প্রাথমিক শিক্ষকদের গ্রীষ্মের ছুটি রাখা হয়েছে ৫ দিন। এটা শিক্ষা ও শিক্ষকবান্ধব সরকারের সঙ্গে প্রাথমিক শিক্ষকদের দূরত্ব তৈরি করে রাখার চক্রান্ত কিনা, খতিয়ে দেখা দরকার। এ প্রেক্ষাপটে গ্রীষ্মকালীন ছুটি ১৫ দিন রাখার লক্ষ্যে ৬টি জাতীয় দিবসকে কর্মদিবস দেখিয়ে ৬ দিন যোগ করা হলে ১১ দিন হবে। তার সঙ্গে শীতকালীন অবকাশসহ যে কোনো গুরুত্বহীন ছুটি থেকে ৪ দিন ছুটি সমন্বয় করা যেতে পারে। প্রাথমিক শিক্ষকদের যথাসময়ে শ্রান্তি বিনোদন ভাতা প্রাপ্তির অধিকারও লংঘন হয় না। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালকের ১ম গণশুনানিতে বিস্তারিত উপস্থাপন করা হয়। প্রধান শিক্ষকদের হাতে বিগত বছরগুলোতে ৩ দিন সংরক্ষিত ছুটি রাখা হতো। এ বছর রাখা হয়েছে ১ দিন। তাও ছুটির তালিকায় প্রধান শিক্ষকদের হাতে লিখে, নিচে থানা ও উপজেলা শিক্ষা অফিসারের অনুমোদন নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়। সংরক্ষিত ছুটি প্রধান শিক্ষকদের হাতে রাখার উদ্দেশ্য তাৎক্ষণিক আকস্মিক কোনো ঘটনার কারণে যাতে প্রধান শিক্ষক ছুটি দিতে পারে। অনুমোদন নিতে হলে প্রধান শিক্ষকের হাতে সে ছুটি কার্যকর করা সম্ভব নয়। তাৎক্ষণিক টেলিফোনে বা পরে অবহিত করা যেতে পারে। সংরক্ষিত ছুটি কমানো ও কেড়ে নেয়া মর্যাদা হানিকর। পূর্বের ন্যায় সংরক্ষিত ছুটি না রাখার কারণ বোধগম্য নয়। সরকারি কর্মচারীদের মতো প্রাথমিক শিক্ষকদের ১৫ দিনের শ্রান্তি বিনোদন ছুটি, ২টি অর্জিত ছুটি, এলপিআরে পূর্ণবেতন, ল্যাম্পগ্রান্ট ও অন্যান্য সুবিধাপ্রাপ্তির জন্য সুপ্রিমকোর্টে প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম রিট আবেদন করেছে। রিটের প্রাথমিক শুনানিতে সুপ্রিমকোর্ট সরকারের ওপর রুল জারি করেছেন। কিন্তু রিটের চূড়ান্ত শুনানির সময়ক্ষেপণ দুর্ভাগ্যজনক। বর্তমানে প্রাথমিক শিক্ষকরা সরকারি কর্মচারীদের চেয়ে কম ছুটি ভোগ করে যাচ্ছেন। সরকার ঢাকা শহরসহ অন্যান্য শহরাঞ্চলের বদলির ধারা বাতিল করে শহরের শিক্ষকদের পদোন্নতি ও তাদের সন্তানদের পোষ্য কোটায় শিক্ষকতায় নিয়োগের অধিকার বিলম্বে হলেও রক্ষা করেছে। শিক্ষাবান্ধব সরকার ছুটির তালিকা সংশোধনপূর্বক সরকারের আর্থিক খরচবিহীন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকদের অধিকার সংরক্ষণ করবে, এটা প্রত্যাশিত। তাতে শিক্ষকরা পাবে সরকারি কর্মচারীদের মতো বিধিমোতাবেক শ্রান্তি বিনোদন ভাতা পাওয়ার অধিকার। আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে জাতীয় সংস্কৃতি ও দেশের ইতিহাস সম্পর্কে। শিক্ষকদের অধিকারের প্রশ্নে যাদের ন্যূনতম শ্রদ্ধাবোধ আছে, এক্ষেত্রে অধিকার আদায়ে তাদের সবার এগিয়ে আসা উচিত। তবেই শিক্ষাবান্ধব সরকারের উচ্চমহলে বিষয়টি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। মনে রাখা দরকার, প্রাথমিকের ছুটির তালিকা প্রতিবছরই শিক্ষকদের মাঝে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরি করে। এ ক্ষোভ প্রশমিত না করলে লাভবান হবে মুক্তিযুদ্ধের পরাজিত শক্তির দোসররা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আবেদন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী চক্রান্ত্র থেকে প্রাথমিক শিক্ষাকে রক্ষা করুন। শিক্ষায় বর্তমান সরকারের বিশাল অর্জন জনগণের মাঝে আন্তরিকভাবে প্রচারের সুযোগ দিন প্রাথমিক শিক্ষকদের। প্রাথমিক শিক্ষকদের ভালোবাসা গ্রহণ করুন। সঠিক পথে এগিয়ে যাক শিক্ষাবান্ধব শেখ হাসিনার স্বপ্ন। এ প্রত্যাশায়।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : আহ্বায়ক, প্রাথমিক শিক্ষক অধিকার সুরক্ষা ফোরাম
siddiqsir54@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.