আমাদের সাহিত্যের কালপুরুষ by জাকির তালুকদার

লেখকের মুখের ওপর সব সময় আলোকসম্পাত তাঁর ধ্যানে বিঘ্ন ঘটায়। সব স্রষ্টার ক্ষেত্রে একই কথা প্রযোজ্য। ধ্যানস্থ হতে না পারলে মৌলিক ও গভীরতাসম্পন্ন সৃষ্টি অসম্ভব। তাই মিডিয়া বা অনুষ্ঠানের ফোকাসে বেশি সময় থাকাটা সত্যিকারের লেখকের জন্য স্বস্তিকর নয়। কাম্যও নয়। আগেকার যুগের সাধক-মুনিঋষিরা লোকালয় ছেড়ে দূরে থাকতেন মাঝে মাঝে। মুনিঋষি মানেই কেবল ধর্মচিন্তক ঈশ্বরসন্ধানী নন।
তাঁরা অনেকেই ছিলেন দার্শনিক, কবি, গণিতবিদও। আজকের যুগের লেখক-কবিদের লোকালয় ছেড়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। তাঁদের বাস করতে হয় পারিবারিক গণ্ডির মধ্যেই। জীবিকার জন্য জমা দিতে হয় আট-দশ কর্মঘণ্টা। পড়তে হয় ট্র্যাফিক জ্যাম ও অবরোধের কবলে। পরিবারের ব্যয়ভার সামলাতে হয়, বাজেট করতে হয় আয়-ব্যয়ের। এই সবকিছু সামাল দেওয়ার পর কেবল জোটে ধ্যানস্থ হওয়ার বা লেখালেখির অবকাশ। সেটুকুও অন্য খাতে ব্যয় করে ফেললে লেখকের জন্য সময় থাকে কোথায়! শওকত আলীর মতো বড় লেখক এ কথা জানতেন ভালোভাবেই। মানতেন আরও বেশি ভালোভাবে। লেখক পাঠকের সামনে উপস্থিত হবেন তাঁর রচনার মাধ্যমে। তাঁর হয়ে কথা বলবে রচনাকর্ম। অন্য অনেক সেলিব্রেটি লেখক-কবির সঙ্গে শওকত আলীর একটা পার্থক্য এই জায়গায়। তিনি নিজের ছায়ায় আড়াল করে ফেলেননি তাঁর সাহিত্যকর্মগুলোকে। বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা ও অবয়ব নির্মাণ করেছেন যে কজন কবি-সাহিত্যিক, তাঁদের মধ্যে শওকত আলী একজন। বাংলাদেশের সাহিত্য মানে ১৯৪৭ সালের ভারতভাগ ও বাংলাভাগের পরবর্তী সময়ের সাহিত্য। সত্য বটে, ১৯৪৭-এর আগেও ঢাকাকেন্দ্রিক একটি সাহিত্য ও চিন্তাচর্চার ক্ষীণ ধারা গড়ে উঠতে শুরু করেছিল। সোমেন চন্দ, রণেশ দাশগুপ্ত, কিরণশঙ্কর সেনগুপ্ত আর মুসলিম সাহিত্যসমাজ বা শিখাগোষ্ঠীর নাম বলা যায়। কিন্তু সেগুলো ছিল নিতান্তই অবস্থানগত কারণে। তাঁদেরও মূল দৃষ্টি ছিল কলকাতার দিকেই। ১৯৪৭-এর অনেক ওলোট-পালোটের পরে এই সত্য সবাইকে মেনে নিতে হলো যে অন্য সবকিছুর মতো ঢাকাকেই গড়ে-পিটে নিতে হবে পূর্ববঙ্গের সাহিত্যের কেন্দ্র হিসেবে। এই কাজটি যাঁরা করেছেন, শওকত আলী তাঁদের একজন। কাজটি সহজ ছিল না। প্রকাশনার ও বিপণনের অবকাঠামো বলতে কিছুই ছিল না আমাদের এই ভূখণ্ডে। তার চাইতেও বড় বিপদ ছিল অন্যখানে। তা হচ্ছে একটি বড় লেখকগোষ্ঠীর পাকিস্তানি জজবা। পাকিস্তান তাদের কাছে ছিল পঞ্চম খোলাফায়ে রাশেদিনের স্বপ্ন। অবিভক্ত বাংলায় কলকাতাকেন্দ্রিক লেখকদের প্রতাপ ও প্রতিভার কাছে নতমুখ থাকতে হয়েছে তাদের। মীর মশাররফ ও নজরুলের আবির্ভাবের পরেও বাংলা সাহিত্য মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দু লেখক-কবির একাধিপত্য মেনে চলেছে একটানা। পাকিস্তান পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটি বিরাট লেখকগোষ্ঠী এ দেশের সাহিত্যকে কলকাতার সাহিত্য থেকে আলাদা করার উপায় হিসেবে খুঁজে পেল আরবি-ফারসি শব্দ আর আরবজাহানের মিথগুলোকে। সংগত কারণেই তারা সহযোগিতা পাচ্ছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর। সেই বিহ্বল বছরগুলোতে বাংলাদেশের সাহিত্যের ভাষা ও অবয়ব নির্মাণের মতো দুরূহ কাজটি করতে হয়েছে কয়েকজন প্রতিভাবান লেখক-কবিকেই। কথাসাহিত্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং কবিতায় আহসান হাবীব সাহিত্যবলয়ের স্বীকৃতি পেয়েছিলেন কলকাতাতেই। মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন তাঁর সওগাত পত্রিকা স্থানান্তর করলেন কলকাতা থেকে ঢাকায়।
পূর্বাপর যে লেখক-কবি-প্রাবন্ধিকেরা এলেন ঢাকার সাহিত্যজগতে, তাঁদের মধ্যে একজন শওকত আলীও। বাংলাদেশের সাহিত্যের মূলধারার নির্মাতা তাঁরা। চলতি স্রোতে গা না ভাসানোর আরও দুটি পরীক্ষায় শওকত আলী পাস করলেন ষাটের দশকে। প্রথমটি ছিল কলাকৈবল্যবাদের ফাঁদ। সেই সময় ঢাকায় এল সৌন্দর্যবাদী সাহিত্যের প্রবণতা। প্রভাবশালী সাহিত্য পত্রিকাগুলো এবং তৎকালীন তরুণদের লিটল ম্যাগাজিনগুলো এই ধারাকে ব্যাপকভাবে এগিয়ে দিয়েছিল। সেই সময় এমন একটি অবস্থা হয়েছিল যে এসব পত্রিকার লিখিত-অলিখিত নির্দেশনা মোতাবেক না লিখলে সাহিত্যজগতের বাইরে ছিটকে পড়তে হবে। এখন শুনতে অবিশ্বাস্য মনে হলেও সত্য যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও ছিলেন এই নিরীক্ষাসর্বস্ব কলাকৈবল্যবাদী ধারার প্রবল অনুসারী ও প্রচারকদের একজন। ইলিয়াসের নতুন জন্ম ঘটিয়েছিল উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। শওকত আলীর মতো লেখককে তখন ‘সেকেলে লেখক’-এর তকমা না দিলেও সৌন্দর্যবাদীদের চোখে তিনি ‘যথেষ্ট আধুনিক নন’ বলেই বিবেচিত হতেন। শওকত আলী সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। নিজের মতো করে লিখে গেছেন। এই ‘নিজের মতো করে লেখা’ই হচ্ছে লেখকের শক্তিমানতার পরিচয়। দ্বিতীয় বিপত্তিটি ছিল বামপন্থী সাহিত্যের যান্ত্রিক ধারা। পাশাপাশি ষাট ও সত্তরের দশকে এ দেশে বাম চিন্তা অনেকটাই পরিব্যাপ্ত হয়েছিল শিক্ষিত মধ্যবিত্তের মধ্যে। শওকত আলী বরাবরই বামপন্থী হিসেবে চিহ্নিত। ইতিহাস বলে, বামপন্থী সাহিত্যের নামেও অসংখ্য জঞ্জাল সৃষ্টি হয়েছে। শওকত আলী বামপন্থী হয়েও সেই যান্ত্রিকতার জঞ্জাল থেকে আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন আত্মস্থ সাহিত্যবোধের মাধ্যমে। বড় লেখকেরা কেউ কোনো নির্দিষ্ট ধারার সাহিত্য সৃষ্টি করার জন্য লিখতে বসেন না। শওকত আলীও কখনোই বাম সাহিত্য বা মার্কসবাদী সাহিত্য লিখতে বসেননি। তিনি গল্প ও উপন্যাস লিখেছেন। কোনো সাহিত্যই সাহিত্য পদবাচ্য হয় না, যদি তা শিল্পের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হয়। লেখকের সাহিত্যিক সততা, প্রতিভা ও শিল্পবোধই সাহিত্যকে সাহিত্য করে তোলে। সৎসাহিত্যই শওকত আলীর চোখে ছিল মার্কসবাদী সাহিত্য।
২. সংগঠনও কি লেখকের ধ্যানবিঘ্ন সৃষ্টির কারণ? কখনো কখনো তো বটেই। তবু শওকত আলী সংগঠন করেছেন। বাংলাদেশ লেখক শিবিরের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন অনেকগুলো বছর। সংগঠন কখনো কাউকে লেখক বানাতে পারে না। তবে লেখকেরা সংগঠনে যুক্ত হন কিছু সামাজিক-রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা পালনের জন্য। সেই দায়িত্বটা তাঁরা পালন করেন রাজনীতির মধ্য দিয়ে নয়, সাহিত্যের মধ্য দিয়েই। সে কারণেই তাঁরা নিজেদের স্লোগান নির্ধারণ করেন শিল্প-সাহিত্য ও বিপ্লবকে সমান্তরালে রেখে-‘শিল্প-সাহিত্য বিপ্লবকে দিক ভাষা, আর বিপ্লব মানুষকে দিক মুক্তি’। সংগঠন মানে তো কিছু কর্মসূচিও। সেগুলোর মধ্যে আছে নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে মতবিনিময়, আলোচনা, বিতর্ক, প্রকাশনা, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজেদের বক্তব্য-বিবৃতি তুলে ধরা, এমনকি কখনো রাজপথেও নেমে পড়া। শওকত আলীও এসব কর্মসূচিতে অংশ নিয়েছেন সাধ্যমতো। কিন্তু সংগঠনের কাজ আর নিজের সাহিত্য সৃষ্টির কাজকে গুলিয়ে ফেলেননি। আমাদের দেশে কখনো এমন সরকার আসেনি, যাকে শওকত আলীর মতো লেখক সত্যিকারের জনগণের সরকার বলতে পারেন। সে কারণে কোনো সরকারের সঙ্গেই তাঁর কোনো দহরম-মহরম ছিল না। বরং সরকারি সমর্থনপুষ্ট লেখক ও তাঁদের কর্মসূচির সঙ্গে দূরত্ব বজায় রাখতেন তিনি। বিদেশে বাংলাদেশের সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করার যোগ্যতা তাঁর ছিল অন্য প্রায় সবার চাইতে বেশি। কিন্তু কখনো তা করা হয়নি তাঁর। কারণ সরকারি প্রতিনিধিদলে নাম লেখানোর জন্য যা যা করতে হয়, সেগুলো তাঁর রুচির সঙ্গে মেলেনি কোনো দিন। অন্য ভাষায় নিজের লেখা অনূদিত হোক, এমন স্বপ্ন প্রায় সব লেখক-কবিরই থাকে। কেননা, অনুবাদের মাধ্যমেই বিশ্বের অন্য ভাষার পাঠকদের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু শওকত আলী কোনো দিন এসব কথা ভেবেছেন, এমন লক্ষণ দেখা যায়নি। নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় নিয়ে আসা বা সুযোগ পেলেই নিজেকে প্রাসঙ্গিক করে তোলার সুযোগ আমরা সহজে হাতছাড়া করতে চাই না। শওকত আলীর অসাধারণ মানসিক শক্তি ও সাহিত্যিক রুচি অবলীলায় অতিক্রম করে গেছে এই দুর্বলতাকে। বাংলাদেশ লেখক শিবির বেশ কয়েক বছর বড় সেমিনার ও আলোচনা সভার মাধ্যমে পালন করে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের জন্মদিন। তারিখটি ১২ ফেব্রুয়ারি। অনেকগুলো বছর লেখক শিবিরের সভাপতি হিসেবে ওই অনুষ্ঠানেও সভাপতিত্ব করতে হয়েছে শওকত আলীকে। কিন্তু কোনো দিন কাউকে জানতে দেননি যে ওই দিনটি তাঁরও জন্মদিন। নিজেকে এইভাবে আড়ালে রাখতে পেরেছেন বলেই সাহিত্যই আজ শওকত আলীর মূল পরিচয় হয়ে উঠতে পেরেছে।
জাকির তালুকদার: কথাসাহিত্যিক।

No comments

Powered by Blogger.