শরণার্থীশিবিরের মায়েরা by গওহার নঈম ওয়ারা

রোহিঙ্গাদের না-বলা কথা ৩
নতুন মাঝি আকরামের স্ত্রী সুফিয়া এখন হাফ মাঝি—একটা আন্তর্জাতিক সংস্থার মাঠকর্মী। দশটা মাঠদলের দেখাশোনা করেন। মাসিক বেতন আট হাজার টাকা। মায়েদের দলে (দশ-বারোজন মাকে নিয়ে একেকটা দল) সকাল দশটা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত মা ও শিশুর স্বাস্থ্য নিয়ে, ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা নিয়ে তথ্য আদান-প্রদান করেন। সংস্থার ক্যাম্প অফিসে সকালে একবার, বিকেল আরেকবার যেতে হয়। মাঝেমধ্যে ঢাকা-কক্সবাজারের কর্মকর্তারা এসে প্রশিক্ষণ দেন। তাঁর বড় মেয়ে আমিনার বয়স নয় বছর। সে তার আর তিন ভাইবোনের দেখাশোনা করে। সুফিয়ার দ্বিতীয় সন্তান ছেলে—আট বছরের হবে। সে চাকরি করে তিন-চার ঘণ্টা, একটা সংস্থায়। প্রতিদিন পলিথিনে করে ভাত-তরকারি বিতরণ করে। সুফিয়ার ছেলে হালিম গরম ভাত পলিথিনের ঠোঙায় ঢোকায়। সকাল ১০টা থেকে তার এই কাজ। চার ব্যাগ খাবার পায় পরিশ্রমের মূল্য হিসেবে। নগদ টাকা কি কিছু পায়? সুফিয়ার কাছে সে প্রশ্নের কোনো জবাব আমরা পাই না। সুফিয়া নারীদলের নাম দিয়েছে দলের নেতার নামে। দলের নেতার ছাউনিতেই গুটিসুটি হয়ে বসে অন্যরা। তারপর সুফিয়া কাকাতুয়ার মতো বলেন চলে শেখানো বুলি: সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, নিয়মিত গোসল করবে, মশা-মাছি থেকে দূরে থাকবে। মাসিকের সময় এগুলো ব্যবহার করবে, শিশুদের সর্দিকাশি, গলা ফোলা হলে চিকিৎসাকেন্দ্রে যাবে, কার্ড সঙ্গে রাখবে, ঝগড়া মারামারি করবে না, পানি ঢেকে রাখবে ইত্যাদি ইত্যাদি। সুফিয়ার কাছে জানতে চাই, এর মধ্যে নতুন কথা কোনটা? যেটা এখানে আসার আগে মায়েরা জানতেন না। মায়েরা একসঙ্গে হেসে ওঠেন।
আমি সমস্যার কথা জানতে চাই। অসুবিধা কী? কেমন চলে তাঁদের দিন। সন্ধ্যায় কী হয় শিবিরে। দীর্ঘ রাত কাটে কীভাবে। বাড়ি যাবে কবে? অসুখ-বিসুখের খবর কী? টেকনাফের মাথিনের কূপই বলে দেয় এই অঞ্চলের জলসংকটের কথা। পাতকুয়ায় সারা রাতের চুঁইয়ে আসা জল জমা হয় সকালের ব্যবহারের জন্য। একটা বড় কুয়ায় বড়জোর ১০ থেকে ১২ লিটার পানি পাওয়া যায়। তারপর আবার চার-পাঁচ ঘণ্টার বিরতি দিলে বিকেল নাগাদ আরও সাত-আট লিটার পানি মেলে। এই যেখানে মাটির নিচের পানির ব্যবস্থা, যেখানে লক্ষÿমানুষের তৃষ্ণা মেটানো যে সময়ের সঙ্গে প্রতিযোগিতা, তা কারও অজানা নয়। পানিপ্রকৌশলীদের কাছে এটা একটা বড় মাথাব্যথার বিষয়। দ্বিতীয় বিকল্প হচ্ছে ছড়ার পানি ধরে সেটা পানযোগ্য করে বিতরণ করা। এর জন্য দরকার ছড়াগুলোর প্রবাহ ঠিক রাখা এবং এগুলো ইটখামারিদের হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখা। ছড়ার পানির সঠিক আর সুসম ব্যবস্থা করলে পুরো টেকনাফ আর উখিয়া জলকষ্ট থেকে রক্ষা পাবে। এখন অনেক সংস্থা তাদের নতুন যৌথ পরিকল্পনা বা জয়েন্ট অ্যাকশন প্ল্যানিংয়ে টেকনাফ আর উখিয়ার অধিবাসী স্থানীয় মানুষের জন্য উন্নয়ন আর আয়-রোজগারের জন্য নানা প্রকল্পের নকশা আঁকছে। এসব পরিকল্পনা টেকনাফ-উখিয়ার ছড়ার পানি ব্যবস্থাপনা ও ন্যায্য পানিবণ্টনে দীর্ঘমেয়াদি আর টেকসই উন্নয়নের দরজা খুলে দিতে পারে। টেকনাফ উখিয়ায় কোটি টাকা খরচ করে জাতিসংঘের এক সংস্থা বিদেশ থেকে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে এসে মাটির নিচে পানি অনুসন্ধানের যে ব্যায়াম সম্প্রতি শেষ করেছেন, তা সর্বনাশের সূচনামাত্র। টেকনাফ আর দক্ষিণ উখিয়ার মাটির নিচে যেটুকু পানি আছে, তা কোনোভাবেই ওঠানো ঠিক হবে না। এসব স্তরে রিচার্জ বা পুনরায় পানি জমা হওয়ার প্রক্রিয়া এত ধীরলয়ে চলে যে তা হিসাবের মধ্যে ধরা যায় না। ছড়া ব্যবস্থাপনা মাটির ওপরে হলেও এখানেও হাল, নকশা, গবেষণা, মাপজোক খুবই সতর্কতার সঙ্গে করতে হবে। সামান্য ভুলচুকে কাড়ি কাড়ি টাকা অপচয়ের হাটে গড়াগড়ি খেতে পারে। সদ্য সমাপ্ত জলকপাটের (স্লুইস গেট) অবস্থা দেখলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। আমরা ফিরে আসি মায়েদের আলোচনায়—ডিফথেরিয়া এখনো বিদায় হয়নি ক্যাম্প থেকে; নারীদলের আট-নয়জনের মধ্যে ছয়জনের কোলেই দুধের শিশু, তিনজনের গলা ফোলা। আমি একটু চেপে বসি, মুখের সস্তা মাস্কটায় মনের অজান্তে হাত চলে যায়, নাকের কাছে আরেকটু শক্ত করে ধরি। বলি, টিকা দেন নাই? মায়েরা যেন একটু অপ্রস্তুত হয়। আমার গলার আওয়াজে বোধ হয় বিরক্তির আলামত ছিল। সবচেয়ে কম বয়সী মা মরিয়ম বিবি প্রতিবাদী কণ্ঠে জবাব দেন, ‘টিকা মারগিতো গলা ফুলে।’ টিকা দেওয়ার পরেও গলাফুলা রোগ ডিফথেরিয়া হচ্ছে। এটাতো রীতিমতো আতঙ্কজনক কথা। এটা লেখা কি ঠিক হবে? কিন্তু মায়েরা যে বলছেন মরিয়মের সঙ্গে সব মা একমত। হতে পারে টিকার গুণগত মান ঠিক ছিল না, কিংবা ঠান্ডায় রাখার কৌশলে কোনো গিঁট পড়েছিল। চিকিৎসক বন্ধু জানালেন, হতেই পারে, ১০০ ভাগ নিশ্চয়তা বলে কিছু নেই। তা ছাড়া টিকা নেওয়ার আগেই যদি অসুখের বীজ শরীরে ঢুকে ডালপালা মেলতে শুরু করে, তাহলে টিকা দিয়ে তাকে সব সময় ঠেকানো সম্ভব হয় না। এসব কথা মায়েদের বৈঠকে আলাপ করা উচিত; না হলে টিকার প্রতি তার কার্যকারিতার প্রতি মায়েদের আস্থা নষ্ট হয়ে যাবে। যেকোনো টিকাকে বা প্রতিষেধককে তাঁরা আর গুরুত্ব দেবেন না। শিশুদের চিকিৎসা, ওষুধপথ্যের ব্যবস্থা কী? চিকিৎসাকেন্দ্রে গেলে ওষুধ দেয়, কিন্তু বড় অসুখ হলে হাসপাতালে যেতে বলে। হাসপাতালে যাওয়াটা সহজ নয়; সব সময় যাওয়া হয় না। বাসে-টেম্পোতে চেপে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যেতে পারে। রাস্তার খরচ হাতে না থাকলে যাওয়া যায় না। আনসার-বিজিবির তল্লাশিতে তখন চিকিৎসার কাগজপত্র দেখাতে হয়। কোনো কোনো সংস্থা গাড়ি ভাড়া দেয়, কিন্তু গাড়িভাড়া ছাড়াও খরচ আছে। সেই খরচ, নগদ টাকা কোথা থেকে আসে। টাকা ধার দেওয়ার লোক আছে। যারা বিভিন্ন সংস্থায় চাকরিবাকরি করে, তাদের কেউ স্থানীয় মানুষ আর দোকানদার। রেশন পেলে রেশনের মাল দিয়ে সেসব ধারদেনা শোধ করে। আবারও মরিয়ম অন্য কথা বলেন, ‘মলোয় ওকল আইরো টিয়া দিতো।’ অর্থাৎ মোল্লা ধরনের লোকজন নগদ টাকা দিয়ে যেত। ঢাকার নানা মসজিদে চাঁদা উঠিয়ে কক্সবাজারে নিয়ে যেত মসজিদের লোকজন।
মায়েরা জানান, সেসব এখন কমে এসেছে; প্রায় বন্ধ। কিন্তু তাঁদের এখন নগদ টাকা দরকার। সংসারের নানা টুকিটাকি কেনা, মাছ-তরকারির ব্যবস্থা নগদ টাকা ছাড়া সম্ভব নয়। শরণার্থী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত নানা সংস্থা নগদ সাহায্যের পথ খুঁজছে। কেউ কেউ নানাভাবে শুরু করেছে ছোটখাটো কাজ দিয়ে। কিন্তু প্রশাসন এ বিষয়ে আরও ভাবার কথা ভাবছে। নগদ দিলে কী বিপদ হবে, আর না দিলে এখন যেসব আপদবিপদ হচ্ছে, সেটা নিয়ে খোলাখুলি আলাপ-আলোচনা হওয়া উচিত। নগদ না দেওয়ার পক্ষে এক এনজিও কর্মকর্তা নানা যুক্তি দেখালেন। আমি তাঁকে একটা প্রস্তাব দিই: ধরেন, আপনি এখন যত বেতন পান, তার দ্বিগুণ বেতন আপনাকে সামনের মাস থেকে দেওয়া হবে। তবে নগদে নয়, চাল, ডাল, তেল, নুন, সাবান, গুড়, পাউডার, চিনি দিয়ে। আপনি নেবেন? তাঁর মুখে আর রা নেই। শেষে মায়েদের সঙ্গে আবার ঘরে ফেরার কথায় ফিরে যাই। নারীরা ‘হোম মেকার’। তাঁরা আবার ঘর বানাতে চান, ফিরতে চান নিজ নিজ গ্রামে—কোনো বন্দীখানায় নয়। আসলে এসব বিষয়ে তাঁদের কাছে কোনো তথ্য নেই। কোনো শর্তে তাঁরা ফিরবেন, কবে ফিরবেন, কেমন করে ফিরবেন, তাঁদের প‌ক্ষে কারা কোন কাগজে সই করছে, তাঁরা তা জানেন না। জানে না বলেই নানা গুজব ডানা মেলছে ছাউনিতে ছাউনিতে; গুজবের গজব বন্ধ করতে হলে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে, জানাতে হবে আসল তথ্য। একজন মা বললেন, তিনি শুনেছেন, শুধু নারীদের নেওয়া হবে। বলেন, ‘বার্মায় নিয়ে আমাদের মেরে আমাদের হাড়গোড় দিয়ে বেড়া দেবে।’ সত্য না জানালে গুজবের জয় হয়। আমাদের সত্য বলতে হবে।
গওহার নঈম ওয়ারা: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ এবং শিক্ষক।

No comments

Powered by Blogger.