চার সুবিধা ও দুই ঝুঁকি

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশে (ডিসি) উত্তরণের পর বাংলাদেশের জন্য চারটি বড় সুবিধা এবং দুটি ঝুঁকি অপেক্ষা করছে। অর্থনীতিবিদ, গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি সংস্থার তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে মোটা দাগে এসব সুবিধা ও ঝুঁকির কথা উঠে এসেছে।
তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সম্ভাব্য সুবিধাগুলো সঠিকভাবে কাজে লাগানো গেলে ঝুঁকির বাস্তবতা মোকাবেলা খুব একটা কঠিন হবে না। এলডিসি থেকে উত্তরণের প্রভাবে যেসব সুবিধা ধরা দিতে পারে সেগুলো হচ্ছে- ১. উদ্যোক্তার মধ্যে সৃষ্ট মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব। এর ফলে দেশে ছোট-বড় লক্ষাধিক উদ্যোক্তার মধ্যে সনাতনী চেতনার পরিবর্তন ঘটবে এবং সেটি বিশ্বায়নের ঝুঁকি মোকাবেলায় নিরাপদ ক্ষেত্র প্রস্তুত করবে। এ মনস্তাত্ত্বিক পরিবর্তনের প্রভাব মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) গতি সঞ্চার করবে। ২. আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। ইতিবাচক ভাবমূর্তি বিশ্বের যে কোনো দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ঘটায়। ৩. বিশ্বায়নের অবাধ প্রতিযোগিতায় উদ্যোক্তাদের টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়বে। এর কারণ উন্নয়নশীল দেশে প্রবেশের আগে হাতে থাকা ১০ বছর সময়ে বাংলাদেশের শিল্পপণ্য উৎপাদনে বৈচিত্র্য আসবে। এতে শিল্পের আধুনিকায়নের পাশাপাশি উৎপাদিত পণ্যের বহুমুখীকরণ ঘটবে এবং সার্বিক উৎপাদন বাড়বে। একই কর্মসূচির আওতায় উদ্যোক্তা এবং শ্রমিক উভয়ের দক্ষতার উন্নয়ন ঘটবে। ৪. উল্লিখিত তিন কারণে দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রস্তুত হবে। এর ফলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্ট হবে- যা উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামো তৈরির পথ সুগম হবে। অন্যদিকে সম্ভাব্য ঝুঁকির প্রথম প্রভাব পড়বে দেশের রফতানি খাতে। উত্তরণের সীমা শেষ হওয়া মাত্র উন্নত দেশগুলো থেকে এলডিসির চলমান সুবিধা বাংলাদেশের জন্য স্থগিত হয়ে যাবে। এর সরাসরি প্রভাব রফতানি বাণিজ্যে পড়বে- যা বাংলাদেশকে বিশ্ব বাণিজ্যে কঠিন প্রতিযোগিতার মুখে ঠেলে দেবে।
এতে এলডিসির দেশগুলোর তুলনায় প্রতি ১০০ টাকার রফতানিতে ৬ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি শুল্ক পরিশোধ করতে হবে। এ বিষয়ে ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আঙ্কটাড) সাম্প্রতিক এক জরিপে দাবি করা হয়, এতে রফতানি আয় ৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। দ্বিতীয় ঝুঁকিটি হচ্ছে- বিশ্বের উন্নত দেশ ও দাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে বাংলাদেশের সহজ শর্তে ও নমনীয় সুদে ঋণ পাওয়ার পথ স্থগিত হয়ে যাবে। ঋণের বিপরীতে উচ্চহারের সুদ দিতে হবে বিধায় ভবিষ্যতে দেশের যে কোনো বিদেশি ঋণের প্রকল্পে খরচ বেড়ে যাবে- যা বাংলাদেশের জন্য অতিরিক্ত আর্থিক ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াবে। বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ রফতানিতে ঝুঁকি তৈরি হওয়ার বিষয়টিতে একমত প্রকাশ করেননি। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এলডিসি থেকে বাংলাদেশ বের হয়ে গেলে রফতানি বাণিজ্যের ওপর একটা চাপ তৈরি হবে, এটা সত্যি। কিন্তু সেই চাপ মোকাবেলার সক্ষমতা উদ্যোক্তাদের তৈরি হয়েছে। আগামীতে এ সক্ষমতা আরও বাড়বে। এ নিয়ে শঙ্কার কোনো কারণ নেই। তাছাড়া রফতানি না করেও বিশ্বের অনেক উন্নয়নশীল দেশ ভালো করছে। রফতানির পরিবর্তে তারা বিকল্প আয়ের উৎস নিয়ে কাজ করছে। এক্ষেত্রে আমরাও সেই বিকল্প উৎসগুলো কাজে লাগাতে পারব। রফতানি আয় বাংলাদেশের জন্য হবে বাড়তি বোনাস। এলডিসি থেকে বের হলে ইইউতে জিএসপির পরিবর্তে জিএসপি প্লাসে কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্টে (এফটিএ) এবং আঞ্চলিক জোটগুলোয় (আরটিএ) বাংলাদেশের অংশগ্রহণ আরও জোরালো করার প্রস্তুতির কথাও জানান। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর অর্থনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা ড. মশিউর রহমান এলডিসিবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে জানান, বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সহজ ভিত্তি ও উপায় আছে। সেটি হচ্ছে দেশের বৃহৎ জনসংখ্যার বোনাসকাল ধরে অগ্রসর হওয়া। ১৫-৩৭ বছর বয়সের তরুণ প্রজন্ম এ বোনাসকালের অংশ। এ সংখ্যা সাড়ে ৫ কোটির বেশি। এরা খুবই উদ্ভাবনশীল। শিক্ষা, তথ্যপ্রযুক্তি ও দক্ষতার দিক থেকে তারা জনসংখ্যার অন্যান্য অংশের চেয়ে এগিয়ে।
সরকার এ তরুণ প্রজন্মের দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে মানবসম্পদে রূপ দেয়ার কার্যক্রম শুরু করেছে। এদের কাজে লাগানোর পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীদের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে পারলে এলডিসির উত্তরণ প্রক্রিয়া খুব একটা কঠিন হবে না। বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন যুগান্তরকে বলেন, এলডিসি থেকে বের হওয়ার ঘোষণা আসার পর বাংলাদেশ প্রায় ১০ বছর সময় পাবে। এ সময়ে উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি শ্রমিকের দক্ষতা ও উৎপাদনশীলতা- দুটোই বাড়ানোর সুযোগ থাকবে। পণ্যের বৈচিত্র্য ও গুণগত মান বৃদ্ধিরও সুযোগ থাকবে। ফলে সম্ভাব্য বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। পলিসি রিসার্চ ইন্সটিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ ঘটলে অনেকগুলো সুবিধা বাংলাদেশের কাছে ধরা দেবে। বিশেষ করে উদ্যোক্তাদের মধ্যে তখন একটা মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব কাজ করবে। এটি অনেক বড় শক্তি, যে কোনো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সবচেয়ে কার্যকরী হবে। বাংলাদেশ রফতানিকারক সমিতির সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী যুগান্তরকে বলেন, এলডিসি উত্তরণের পর তলাবিহীন ঝুড়ির বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে নিজেদের যোগ্যতা ও অর্জন দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে। এতে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি বাড়বে। এ স্বচ্ছ ভাবমূর্তি বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। বিজিএমইএ’র সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান দাবি করেন, এলডিসি থেকে বের হলেও এর নেতিবাচক প্রভাব খুব একটা আমাদের রফতানিতে পড়বে না। কারণ প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ বেশ লম্বা সময় পাবে। এ সময়ে নিশ্চয়ই আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প-কারখানার আধুনিকায়ন এবং সম্প্রসারণ হবে। উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপনা পর্যায় এবং শ্রমিকের দক্ষতা ও সক্ষমতা আরও বাড়বে। মালিক-শ্রমিকের মধ্যে সম্পর্কের উন্নতি ঘটবে। এর ফলে কারখানার অসন্তোষ দূর হবে এবং উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে। একই সঙ্গে তৈরি পোশাকের উৎপাদনেও অনেক বৈচিত্র্য আসবে। পাশাপাশি অন্যান্য রফতানি পণ্যেরও বহুমুখীকরণ হবে। এতে আমাদের বাজার বাড়বে ও বিদেশে বাংলাদেশি পণ্যের চাহিদা তৈরি হবে। ফলে আমরা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারব। আমরা তো মনে করি, উত্তরণ-পরবর্তী সময়ে আমাদের রফতানির পরিমাণ আরও বাড়বে এবং আয়ও বাড়বে।

No comments

Powered by Blogger.