বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হলো রোহিঙ্গা গণহত্যা

মিয়ানমার থেকে চরম ভয়ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে যারা পালিয়ে এসেছেন, তারা এখন বড়ই অসহায়। তাদের দুঃখ-দুর্দশার কাহিনী অত্যন্ত করুণ। গত আগস্ট মাস থেকে ছয় লাখ ২৬ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা দেশটি থেকে পালিয়ে গেছে। এটা মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ও স্থানীয় মিলিশিয়াদের পরিকল্পিত হামলা বলে মনে করা হচ্ছে। রুয়ান্ডার গণহত্যার পর এটি হচ্ছে একটি সম্প্রদায়ের দলবদ্ধভাবে দ্রুত দেশত্যাগ তথা বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঘটনা। একটি সাহায্য সংস্থার ধারণা, গত বছরের আগস্ট মাসের শেষ থেকে সেপ্টেম্বরের শেষ পর্যন্ত এক হাজার শিশুসহ ৯ হাজার রোহিঙ্গার মৃত্যু হয়েছে। স্যাটেলাইট ডাটা থেকে দেখানো হলো, শত শত গ্রামের বাড়িঘর আগুন দিয়ে ভস্মীভূত করা হয়েছে। আর যারা পালিয়ে জীবন বাঁচানোর জন্য বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের প্রত্যেকেরই বলার মতো দুঃখ-বেদনা ও আতঙ্কের মর্মান্তিক কাহিনী রয়েছে। আলমাস খাতুন নামের একজন রোহিঙ্গা নারী সিডনি মর্নিং হেরাল্ডকে বলেছেন, ‘তারা আমার বৃদ্ধ বাবাকে গুলি করে। এরপর তারা একটি কাঠের টুকরা তার মুখে ঢুকিয়ে দিয়ে তাকে গলা কেটে হত্যা করেছে।’ আমার ছেলেমেয়েদের জন্য আমি চিন্তিত ও শোকাহত। তাদের বাঁচাতে পারিনি। তারা আমার সাত সন্তান, আমার স্বামী ও তার দুই ভাইকে হত্যা করেছে। আলমাস খাতুন লাশের সাথে পড়ে থেকে মৃতের ভান করেন এবং পরে সুযোগ বুঝে হামাগুড়ি দিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি তার গ্রামের জ্বলন্ত ধ্বংসস্তূপ এবং আত্মীয় স্বজনের অসংখ্য লাশ ফেলে পালিয়ে এসেছেন। অ্যাসোসিয়েটেড ক্রনিকেলের এক তদন্তে বেরিয়ে এসেছে : মিয়ানমার সেনাবাহিনী সেখানে গণধর্ষণ চালিয়েছে। ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ২৯ জন বালিকা ও নারীর সাক্ষাৎকার নেয়ার মাধ্যমে গণধর্ষণের বিষয়টি উন্মোচিত হয়েছে। তারা জানান, সৈন্য এবং রোহিঙ্গাবিরোধী প্রহরীরা নারীদের গণধর্ষণসহ নির্যাতন ও ডাকাতিতে লিপ্ত হয়। এপি’র রিপোর্টে বলা হয়েছে- রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বের করে দেয়ার লক্ষ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সন্ত্রাসের হাতিয়ার হিসেবে পরিকল্পিতভাবে গণধর্ষণ চালায়। নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট নিকোলাস ক্রিস্টোফ এক নিবন্ধে রোহিঙ্গা নারীর সাথে নিজের কথোপকথনের কথা উল্লেখ করেন।
এসব রোহিঙ্গা নারী কিভাবে ধর্ষিত হয়েছেন এবং তাদের নিকটাত্মীয় ও আপনজনরা কিভাবে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন; তিনি এর মর্মান্তিক বর্ণনা দেন। তিনি মিয়ানমারের সর্বোচ্চ বেসামরিক নেত্রী ও নোবেল বিজয়ী অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানান ২১ বছর বয়সী হাসিনা বেগমের কাহিনী শোনার জন্য। হাসিনা দেখেছেন, তার গ্রামের পুরুষ লোক এবং বালক ও কিশোরদের হত্যা করে তাদের লাশ সারিবদ্ধ ফেলে রাখা হয়েছিল এবং পরে তাতে পেট্রল ঢেলে অগ্নিসংযোগ করে সব লাশ পুড়িয়ে দেয়া হয়। হাসিনা ক্রিস্টোফকে বলেন, ‘আমার সন্তানকে আমার স্কার্ফের নিচে লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা ওর পা দেখে ফেলে। তারা হঠাৎ আমার সন্তানের পা চেপে ধরে। এরপর তাকে আগুনে নিক্ষেপ করে।’ হাসিনা বলেন, এ দৃশ্যে তীব্র আর্তনাদ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে বেহুঁশ হয়ে যাই।’ নিষ্ঠুর সেনারা এরপর তাকে পেটাতে থাকে। পেটানো ও মারধর করার বিভিন্ন আঘাতের চিহ্ন ক্রিস্টোফ তাকে দেখান। এরপর তারা তাকে ননদ আসমা বেগমসহ একটি কুঁড়েঘরে আটকে রাখে। তিনি বলেন, সেনারা নারীদের বেত্রাঘাত ও তাদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে ধর্ষণ করেছে। সব শেষে সেনারা ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে তাতে আগুন ধরিয়ে দেয়।’ বিবস্ত্র অবস্থায় দুই নারী কুঁড়েঘরটির একটি গর্ত দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হন। তারা কাদা দিয়ে তাদের জখমের স্থান ঢেকে দেন এবং ময়লা-আবর্জনাকে আচ্ছাদন হিসেবে ব্যবহার করে তিনদিন ধরে হেঁটে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে পৌঁছেন। হাসিনা ক্রিস্টোফকে বলেন, ‘যখন আমি ঘুমাতে যাই- তখন সন্তানকে খুঁজতে থাকি। আর, জেগে উঠে আর্তনাদ করে কাঁদতে থাকি।’ এ সহিংসতার মাধ্যমে অনেক মর্মস্পর্শী কাহিনীর জন্ম হয়েছে। তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যাপক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করেছে। মার্কিন হলোকাস্ট মিউজিয়াম দুই বছর আগেই মিয়ানমারে গণহত্যার পটভূমি তৈরি হতে যাচ্ছে বলে হুঁশিয়ার করে দিয়েছিল। গত নভেম্বর মাসে এ সংক্রান্ত একটি রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। একই সাথে আঞ্চলিক একটি মানবাধিকার গ্রুপ জানায়, মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছে, সে ব্যাপারে ব্যাপক প্রমাণ রয়েছে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হচ্ছে সেটাকে ‘গোষ্ঠীগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করেন। জাতিসঙ্ঘের আরো বহু সিনিয়র কর্মকর্তা একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত মিয়ানমারের এই বর্বরতার বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি। যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তুরস্ক থেকে মালয়েশিয়া পর্যন্ত মুসলিম নেতারা এ ট্র্যাজেডির ব্যাপারে সোচ্চার। এখনো তারা প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। রোহিঙ্গাদের জন্য ভারতের সহানুভূতি থাকলেও মিয়ানমারের ওপর তারা কোনো চাপ দিচ্ছে না। বরং তারা রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে অভ্যন্তরীণভাবে রাজনীতি করছে। ভারতের বর্তমান উগ্রহিন্দুত্ববাদী সরকার সে দেশে আশ্রয় নেয়া কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে জোর করে বের করে দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। সরকার তাদের বিরুদ্ধে উগ্রবাদের অজুহাত দেখাচ্ছে। মিয়ানমারের জেনারেল এবং সে দেশের সাথে গভীর অর্থনৈতিক স্বার্থ জড়িত থাকায় চীন মিয়ানমারের পদস্থ কর্মকর্তা ও জেনারেলদের আন্তর্জাতিক রোষ থেকে বাঁচানোর জন্য চেষ্টা চালাচ্ছে। তারা মিয়ানমারের স্বার্থকে অটুট রেখেই কৌশলে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে ফেরত নেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের নিকোলাস বিকুলিন নিউ ইয়র্ক টাইমসে উল্লেখ করেছেন, ‘রোহিঙ্গা ইস্যুটি বেইজিংয়ের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। মিয়ানমারে ফেরত যাওয়া রোহিঙ্গাদের তাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে যাওয়ার অনুমতি দেয়া হবে না। তাদের অন্তরীণ শিবিরে রাখা হবে। তাদের বাড়িঘর আগেই পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। বৈষম্য ও পৃথকীকরণ ব্যবস্থা তাদের আরো দুর্বল ও অরক্ষিত করবে। মিয়ানমার সরকার রোহিঙ্গাদের কল্যাণে যে, কোনো কিছু করবে না- এটা নিশ্চিত। সু চি রোহিঙ্গাদের মুখের কথা ‘বিশ্বাসযোগ্য নয়’ বলে মনে করেন। তিনি বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির জন্য রোহিঙ্গাদের মধ্যকার ‘স্থানীয় সন্ত্রাসীদের’ দায়ী করেন। সু চির সমর্থকেরা যুক্তি দেখান, দেশের গৌরবতুল্য সেনাবাহিনীর সাথে তাকে নিজের ‘জটিল খেলা’ খেলতে হবে। রাখাইন রাজ্যের চরম দুর্দশার ব্যাপারে তার অবস্থান এখনো অস্পষ্ট। সাংবাদিকেরা সম্প্রতি রাখাইনের সরকারি কর্মকর্তা ফোন টিন্টকে ধর্ষণের ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘এসব মহিলা তাদের ধর্ষণ করা হয়েছে বলে দাবি করছে। কিন্তু চেহারার দিকে তাকালে তাদের কি ধর্ষণ করার মতো আকর্ষণীয় মনে হবে?’ নিউ ইয়র্ক টাইমসের হান্নাহ বিচের সাথে কথা বলতে গিয়ে রাখাইনের আরেকজন সিনিয়র কর্মকর্তা মিয়ানমারে এমনকি, রোহিঙ্গাদের অস্তিত্বকেও অস্বীকার করা সংক্রান্ত সরকারের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন জানান। অথচ বিশাল এ জাতিগোষ্ঠী, রোহিঙ্গা মুসলিমরা গত কয়েক প্রজন্ম ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। সামরিক জান্তা ১৯৮০-এর দশকে তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যেভাবে তোতা পাখির মতো ‘এটা মিথ্যা খবর বলে চালিয়ে দেন, তেমনি মিয়ানমারের এই কর্মকর্তা বলেন, রোহিঙ্গা নামে কোনো কিছু মিয়ানমারে নেই। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ হচ্ছে গোটা মানব জাতির বিরুদ্ধে একটি অপরাধ। আমাদের সবার পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে সাড়া দেয়া প্রয়োজন। ক্রিস্টোফ লিখেছেন, কিন্তু একটি বছর এত গভীরভাবে অত্যধিক খারাপ রক্ত প্রবাহিত হয়েছে যে, কোথাও এ ব্যাপারে কোনো সাড়া বা প্রতিক্রিয়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
লেখক : পররাষ্ট্র বিষয়ক লেখক। হংকংভিত্তিক ও নিউ ইয়র্কে টাইম ম্যাগাজিনের সিনিয়র সম্পাদক ও সংবাদদাতা ছিলেন
ওয়াশিংটন পোস্ট থেকে ভাষান্তর : মুহাম্মদ খায়রুল বাশার

No comments

Powered by Blogger.