ওরাডেক্সনের ব্যবহার বন্ধ করা জরুরি

বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন বা পরিচিত কাউকে দেখলে আমরা কুশল বিনিময় করি এবং জিজ্ঞেস করি- কেমন আছেন? ভালো আছেন? উত্তর হয় বিভিন্ন রকম। ভালো আছি, মোটামুটি আছি, না ভাই ভালো নেই, শরীর খারাপ, মানসিক অশান্তিতে আছি, দেশের যে অবস্থা তাতে কী ভালো থাকার উপায় আছে ইত্যাদি। দেশের অবস্থার জন্য কেউ যদি খারাপ থাকেন, তার প্রতিকার কী হবে আমার জানা নেই। ওটা একটি জটিল প্রক্রিয়া; কিন্তু শরীর খারাপ হলে আমরা কী করি? বেশিরভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসকের কাছে যাই, ওষুধ গ্রহণ করি। অসুস্থ হলে সুস্থ হওয়ার জন্য ওষুধ গ্রহণ অতি সহজ কাজ, বিশেষ করে আমাদের মতো দেশে। কোন রোগের জন্য কোন সময় কোন ওষুধ গ্রহণ করতে হয় তা জানার জন্য এ দেশে কাউকে চিকিৎসক বা ফার্মাসিস্ট হতে হয় না। আমরা নিজেরা রোগী, নিজেরাই চিকিৎসক। নিজেরা চিকিৎসক না হলেও পাড়া-প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব বা শুভাকাক্সক্ষীদের মধ্যে কাউকে না কাউকে পাওয়া যাবে যিনি চিকিৎসকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে আপনাকে অবশ্যই উদ্ধার করবেন। ঠাণ্ডা লাগার কারণে সর্দি, কাশি ও জ্বর নিয়ে কেউ চিকিৎসকের কাছে গেলে অবশ্যই চিকিৎসক রোগীকে সর্দির জন্য অ্যান্টিহিস্টামিন, কাশির জন্য কফ সিরাপ ও একটি ব্রোড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে দিবেন চোখ বন্ধ করে। চিকিৎসক বুদ্ধিমান হলে সঙ্গে একটি ভিটামিন এ টু জেডও দিয়ে দিতে পারেন।
এসব ছোটখাটো রোগের চিকিৎসার জন্য আজকাল আর কেউ সচরাচর চিকিৎসকের কাছে যায় না। আমাদের দেশে এসব সাধারণ রোগের চিকিৎসা আমরা নিজেরাই করতে জানি। আমি নিজেও এসব রোগে মাঝে-মধ্যে আক্রান্ত হই। কিন্তু কোনো ওষুধ গ্রহণ করি না। কারণ এসব রোগের মূল কারণ ভাইরাস। ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো অ্যান্টিবায়োটিক কাজ করে না। উল্টো অর্থদণ্ড হয়, শরীরের ক্ষতি হয়। কাশির বিরুদ্ধে কফ সিরাপ কার্যকর নয়। সাময়িক স্বস্তি মেলে, উপকার এতটুকুই। অ্যান্টিহিস্টামিন খেলে নাকের পানি ঝরা বন্ধ হবে। কিন্তু অ্যান্টিহিস্টামিনের উপকারের চেয়ে অপকারিতাই বেশি। অ্যান্টিহিস্টামিন কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রকে অবদমিত করে, তন্দ্রাচ্ছন্নতা বা ঘুম ঘুমভাব আনে, কাজকর্মে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। এছাড়া অ্যান্টিহিস্টামিন প্রচণ্ড ক্ষুধা বাড়ায়। অ্যান্টিহিস্টামিন খেয়ে গাড়ি চালানোর সময় সাবধান থাকতে হয়। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, অনেক সময় আমরা শুনে শুনেই রোগের চিকিৎসা করি। আমি এমন কয়েকজনকে জানি, যাদের চিকিৎসাশাস্ত্র সম্পর্কে বিন্দুমাত্র জ্ঞান না থাকা সত্ত্বেও মানুষকে সর্দি, কাশি, জ্বর বা সংক্রামক রোগে সেফেক্সিম, সেফ্রাডিন, সিপ্রোফ্লক্সাসিন, সেফট্রিয়াক্সনের মতো ব্রোড-স্পেকট্রাম অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। বহু মানুষ এসব পরামর্শ গ্রহণ করে ওষুধ সেবন শুরু করেন। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ ছাড়া কেউ গায়ের ব্যথা বা মাথাব্যথার জন্য প্যারাসিটামল গ্রহণ করতে পারেন, কিন্তু একান্ত প্রয়োজন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বা অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী ওষুধ গ্রহণ করতে পারেন না। বহুদিন ধরে অ্যান্টিবায়োটিকের বিবর্তন চলে আসছে। একসময় সালফাড্রাগের বহুল প্রচলন ছিল। পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া তীব্র হওয়ার কারণে এবং আরও উন্নতমানের অ্যান্টিবায়োটিক বাজারে চলে আসার কারণে সালফাড্রাগ জনপ্রিয়তা হারায়। এর পরে এলো টেট্রাসাইক্লিন। বেশ কয়েক বছর টেট্রাসাইক্লিন বাজার মাত করে রেখেছিল। তারপর এলো পেনিসিলিন গ্রুপের অ্যাম্পিসিলিন, অ্যামোক্সিসিলিনজাতীয় অ্যান্টিবায়োটিক। নির্বিচার ও অযৌক্তিক ব্যবহারের কারণে টেট্রাসাইক্লিন, পেনিসিলিন গ্রুপের ওষুধগুলো অল্প সময়ের মধ্যে রেজিস্ট্যান্ট হয়ে গেল। এরপর এলো কুইনোলন ও ফ্লুরোকুইনোলন (Fluoroquinolone) গ্রুপের ওষুধ, সিপ্রোফ্লক্সাসিন ও ল্যাভফ্লক্সাসিনজাতীয় ওষুধ। কিছুদিন ম্যাজিক বুলেটের মতো কাজ করল এসব ওষুধ। ইদানীং শোনা যাচ্ছে, সিপ্রো গ্রুপের ওষুধ কাজ করছে না। এসব ওষুধও আস্তে আস্তে জীবাণুর প্রতি রেজিস্ট্যান্ট হয়ে পড়ছে। সম্প্রতি বাজার মাত করে রেখেছে সেফালোস্পোরিন গ্রুপের কিছু নামিদামি ওষুধ।
এসব ওষুধের মধ্যে সাধারণ মানুষ পর্যন্ত যেসবের নাম জানে, তার মধ্যে রয়েছে সেফালেক্সিন, সেফ্রাডিন, সেফাক্লোর, সেফেক্সিম, সেফিওরক্সিম, সেফট্রিয়াক্সন ইত্যাদি। আমি আতঙ্কে আছি কখন শুনব এসব ওষুধও একদম অকার্যকর হয়ে পড়ছে। এসব ওষুধ অকার্যকর হয়ে গেলে সংক্রামক রোগের চিকিৎসকরা কী করবেন? মানুষের একটি বদ্ধমূল ধারণা রয়েছে এক জেনারেশনের ওষুধ অকার্যকর হয়ে গেলে অন্য কার্যকর ও উন্নতমানের ওষুধ আবিষ্কৃত হবে এবং বাজারে আসবে। এ রকম ভাবার মধ্যে যুক্তি আছে। এতদিন তা-ই হয়ে আসছে। একদিকে অ্যান্টিবায়োটিক অকার্যকর হয়ে পড়লেও অন্যদিকে নতুন নতুন ওষুধ বাজারে এসেছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। দুর্ভাগ্যক্রমে এখন যে হারে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট হয়ে যাচ্ছে, সে হারে নতুন কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হচ্ছে না এবং বাজারেও আসছে না। কিছুদিন আগে আমার এক প্রবন্ধে লিখেছিলাম, আগামী দুই থেকে তিন দশকের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক জীবাণুর বিরুদ্ধে কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। কার্যকর অ্যান্টিবায়োটিক উদ্ভাবিত না হলে সংক্রামক রোগে মানুষ মারা যাবে এবং চিকিৎসকদের অসহায়ভাবে তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার থাকবে না। বিশ্বের ২৬ জন খ্যাতনামা চিকিৎসা বিজ্ঞানী ‘ল্যানসেট জার্নালে’ এ ধরনের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। কে জানত তখন এর চেয়েও আরও ভয়ঙ্কর বিপদবার্তা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। গত বছরের ৩০ এপ্রিল বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাদের গ্লোবাল রিপোর্টে উল্লেখ করেছে, অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স এখন আর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কোনো ব্যাপার নয়। বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি অঞ্চলে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাপক হারে কার্যকারিতা হারাচ্ছে। এই অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্সের শিকার হতে পারে যে কোনো দেশের যে কোনো অঞ্চলের যে কোনো বয়সের যে কোনো মানুষ। আমরা হয়তো আবার অ্যান্টিবায়োটিকপূর্ব সেই যুগে ফিরে যাচ্ছি, যখন এই জীবনরক্ষাকারী ওষুধের অভাবে লাখো-কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করেছিল। ঠিক এই মুহূর্তে যদি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, সংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও প্রতিহত না করা যায়, নতুন নতুন কার্যকর ওষুধ আবিষ্কৃত না হয়, অ্যান্টিবায়োটিকের নির্বিচার অপব্যবহার বন্ধ না করা যায়, তাহলে আসন্ন মহাবিপর্যয় থেকে কাউকে রক্ষা করা যাবে না। আজকের এই লেখায় অন্য একটি ওষুধের অপব্যবহার বা নির্বিচার ব্যবহার সম্পর্কে একটু আলোচনা করতে চাই।
ওষুধটির নাম ওরাডেক্সন। জেনেরিক নাম ডেক্সামেথাসন। এটি একটি স্টেরয়েড ওষুধ, যার ভয়ঙ্কর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। ওষুধটি ক্রমাগত গ্রহণ করলে শরীরে চর্বি জমে যায়, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, গায়ের চামড়া রুক্ষ হয়ে যাওয়া, মাথাধরা ছাড়াও অল্প বয়সে কিডনি বিকল হওয়ার কারণে অকালমৃত্যু ঘটে। ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বহু দেশের পতিতালয়ের যৌনকর্মীরা নিয়মিত ওরাডেক্সন গ্রহণ করে থাকে। ব্যাপারটি আমি প্রথম জানতে পারি বিবিসি থেকে প্রচারিত এক সচিত্র প্রতিবেদনের মাধ্যমে। বাংলাদেশে ২০টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত পতিতালয় রয়েছে। প্রতিবেদনে রাজবাড়ী জেলার দৌলতদিয়া গ্রামের বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ পতিতালয় ও ফরিদপুরের একটি পতিতালয়ের বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের যৌনকর্মী হিসেবে নিয়োজিত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু দালালরা সচরাচর অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের সংগ্রহ করে বিভিন্ন পতিতালয়ে সরবরাহ করে। পতিতালয়ে এসব অল্পবয়সী ভগ্নস্বাস্থ্য ও শীর্ণকায় মেয়েদের নিয়মিত ওরাডেক্সন সেবন করতে দেয়া হয়। নিয়মিত ওরাডেক্সন গ্রহণ করলে কিছুদিনের মধ্যে এসব মেয়ের স্বাস্থ্যে পরিবর্তন আসে। ভগ্নস্বাস্থ্য ও শীর্ণকায় অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েদের আকার-আকৃতি বাড়ে, মোটা-তাজা হয়, শরীরে চর্বি জমার কারণে লাবণ্য আসে। এ কারণে অপ্রাপ্তবয়স্ক হওয়া সত্ত্বেও তাদের দেখলে প্রাপ্তবয়স্ক বলে মনে হয়। এসব যৌনকর্মী এবং পতিতালয়ে তাদের মালিকরা ওরাডেক্সন ব্যবহারের অপূরণীয় ক্ষতির কথা জানে বলে বিবিসি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও ব্যবসার স্বার্থে এসব অসহায় মেয়েদের ওরাডেক্সনের মতো একটি ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার ওষুধ সেবনে বাধ্য করা হচ্ছে। প্রতিবেদনে গোপনে ধারণকৃত ভিডিওতে দেখা যায় অপ্রাপ্তবয়স্ক অসংখ্য মেয়ে লাইন দিয়ে ওরাডেক্সন কিনে নিয়ে যাচ্ছে। পতিতালয়ের ভেতরে ও আশপাশের ওষুধের দোকানগুলো প্রেসক্রিপশন ছাড়াই দেদার ওরাডেক্সনসহ আরও অসংখ্য ভয়ঙ্কর ওষুধ বিক্রি করছে। পুলিশ জানা সত্ত্বেও কিছু করছে না। উল্লিখিত পতিতালয় ছাড়াও বাংলাদেশের প্রতিটি পতিতালয়ে নির্বিচারে ওরাডেক্সনের ব্যবহার চলে আসছে। সাক্ষাৎকারে পতিতারা বলেছে, অনিয়ন্ত্রিত ওরাডেক্সন সেবনের কারণে কিডনি ধ্বংস হয়ে অনেক মেয়ে মারা গেছে। তারা এও বলেছে, যে কোনো সময় তাদেরও মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু তারা অসহায়, করার কিছু নেই। আমি জানি না, এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি সম্পর্কে সরকার কতটুকু ওয়াকেবহাল, আর ওয়াকেবহাল হলে তারা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন বা করছেন। আমি মনে করি ওরাডেক্সনের এই নির্বিচার ব্যবহার বন্ধ হওয়া দরকার।
আরও একটি কথা। একটি মুসলমানপ্রধান দেশে যেখানে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, সে দেশে ২০টি লাইসেন্সপ্রাপ্ত পতিতালয়ই বা থাকে কী করে! এসব পতিতালয়ে অবাধ মাদকের ব্যবহার ছাড়াও সব ধরনের অসামাজিক কর্মকাণ্ড চলে আসছে। সমাজ ও দেশকে বিপথগামী ও ধ্বংস করার জন্য এর চেয়ে উত্তম স্থান আর কী হতে পারে! এ ব্যাপারে সরকার কী করবে জানি না। তবে কিছু একটা করা দরকার। আমরা অনেকেই হয়তো জানি না, কোরবানির আগে আমরা বাজারে যেসব নাদুসনুদুস বিশাল আকৃতির ষাঁড় দেখে মুগ্ধ হই, ওসব পশুকে বিক্রির কয়েক মাস আগ থেকে নিয়মিত ওরাডেক্সন খাওয়ানো হয়। মনে রাখবেন, ষাঁড়ের মাংসের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ওরাডেক্সনও খাচ্ছি। আমি মাঝে মধ্যে কৌতূহলবশত ওষুধের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওষুধ ক্রেতা-বিক্রেতাদের আরচরণ লক্ষ করি। আগে বলে নিই, বাংলাদেশে ওটিসি (ওভার দা কাউন্টার) ড্রাগ ও প্রেসক্রিপশন ড্রাগের মধ্যে ২০১৬ সালের ওষুধনীতি হওয়ার পরও এখনও কোনো পার্থক্য নেই। ওটিসি ড্রাগ হল সেসব ওষুধ যা কিনতে প্রেসক্রিপশন লাগে না। যেমন অ্যাসপিরিন, প্যারাসিটামল, অ্যান্টাসিড, ভিটামিন, কফ সিরাপ, অ্যান্টিহিস্টামিন ইত্যাদি। প্রেসক্রিপশন ছাড়া যেসব ওষুধ কেনা যায় না তাদের বলা হয় প্রেসক্রিপশন ড্রাগ। অ্যান্টিবায়োটিক, ঘুমের বড়ি, হৃদরোগ ও স্ট্রোকের ওষুধ, ডায়াবেটিসের ওষুধ, ওরাডেক্সনের মতো স্টেরয়েড, মানসিক রোগের ওষুধ এই গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে সব ওষুধই ওটিসি ওষুধ। এখানে কোনো ওষুধ কিনতেই প্রেসক্রিপশন লাগে না, যদিও ওষুধ প্রশাসন আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে ওষুধ বিক্রি নিয়ন্ত্রণ করতে। কিন্তু পারছে না। তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ পতিতালয়ে ওরাডেক্সন ও অন্যান্য প্রেসক্রিপশন ড্রাগের অবাধ বিক্রি ও ব্যবহার। নিজস্ব গবেষণার মাধ্যমে আমি দেখতে পেয়েছি, বাংলাদেশের ওষুধের দোকানগুলো হল ওষুধের নির্বিচার অপপ্রয়োগ ও অপব্যবহারের প্রধান কেন্দ্রস্থল। বহু দোকানে কোনো ফার্মাসিস্ট নেই।
অথচ লাইসেন্সপ্রাপ্ত ফার্মাসিস্ট ছাড়া কোনো ওষুধের দোকান লাইসেন্স পেতে পারে না। দ্বিতীয়ত, বেশিরভাগ ক্রেতা ওষুধের দোকান থেকে প্রেসক্রিপশন ছাড়াই ওষুধ কেনাকাটা করছে। আমি প্রায়ই দেখি, স্বচিকিৎসা বা আত্মচিকিৎসার মাধ্যমে বহু মানুষ অসংখ্য প্রেসক্রিপশন ড্রাগ কিনে নিয়ে যাচ্ছে, যার গুরুতর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। আমাশয়ের এক রোগীকে ৪০০ মি. গ্রামের চারটি মেট্রোনিডাজল ট্যাবলেট কিনে নিয়ে যেতে দেখে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি মোট কয়টি ট্যাবলেট খেতে হবে তা জানেন কিনা। তিনি মনে করেন চারটি ট্যাবলেটেই তার আমাশয় সেরে যাবে, যা কোনোদিন সম্ভব নয়। অ্যান্টাসিড ছাড়া ব্যথা ও প্রদাহের ওষুধ ডাইক্লোফেনাক, আসেক্লোফেনাক, আইবোপ্রোফেনজাতীয় ওষুধ খেলে যে আলসার, রক্তরক্ষণ ছাড়াও অন্ত্র ফুটো হয়ে যেতে পারে, তা বহু মানুষ জানে না। মানসিক রোগের ওষুধ বা ভায়েগ্রা কিনে নিয়ে যাচ্ছে কোনো রেসট্রিকশন ছাড়াই। নাইট্রোগ্লিসারিনের সঙ্গে ভায়েগ্রা সেবন করলে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে এ কথাটি ক্রেতাকে কে বোঝাবে? ওটিসি ড্রাগের ক্ষেত্রে আত্মচিকিৎসা গ্রহণযোগ্য হলেও সম্ভাব্য পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার দিকে নজর রাখতে হবে। আত্মচিকিৎসা যদি অনিয়ন্ত্রিত ও অযৌক্তিক হয়, তবে তা আমাদের জন্য বিপদ ডেকে আনতে পারে। বিশেষ করে প্রেসক্রিপশন ড্রাগগুলো সম্পর্কে আমাদের ভীষণ সতর্ক থাকতে হবে। প্রেসক্রিপশন ড্রাগের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে বিশ্বজুড়ে লাখ লাখ মানুষ অসুস্থ হওয়া ছাড়াও মৃত্যুবরণ করে প্রতি বছর। তাই যে কোনো ওষুধ গ্রহণের আগে ওষুধ সম্পর্কে সম্পূর্ণ ধারণা নিন, তারপর ওষুধ গ্রহণ করুন। তাহলেই শুধু আপনি নিরাপদ থাকবেন।
ড. মুনীরউদ্দিন আহমদ : অধ্যাপক, ফার্মেসি অনুষদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
drmuniruddin@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.