তুরস্কের হামলার ফল ভালো হবে না by গ্যারেথ স্ট্যান্সফিল্ড

যে রাষ্ট্রেই থাকুক না কেন, কুর্দিদের ঝুঁকিপূর্ণ জীবন যাপন করতে হয়। ইরানের পশ্চিমাঞ্চলের কুর্দিরা ইসলামিক রিপাবলিকের সেনাদের হাতে ব্যাপক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। অন্যদিকে ইরাকের উত্তরাঞ্চলের কুর্দিরা সুপরিকল্পিত সামরিক অভিযানের মুখে পড়েছে। তারা আবার এক কূটনৈতিক উদ্যোগের সম্মুখীনও হয়েছে। এতে বোঝা যায়, মধ্যপ্রাচ্যের দ্বন্দ্বমুখর রাজনীতিতে কুর্দিদের আকাঙ্ক্ষার কারণে ইরাক, ইরান ও তুরস্ক একজোট হতে পারে। স্বাধীনতার লক্ষ্যে তারা যে গণভোটের আয়োজন করল, তারপর এটা বাস্তব হয়ে উঠেছে। আরও লক্ষণীয় ব্যাপার হলো পশ্চিমা শক্তিগুলো তাদের ইরাকি কুর্দি মিত্রদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে গেছে। অথচ আইএসবিরোধী যুদ্ধে এরা যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। পশ্চিমা সরকারের চিন্তায় যুক্তি ছিল, তাতে ছিল শীতল বস্তুনিষ্ঠা। কারণ, তারা ইরাকের ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষার অঙ্গীকার করেছিল। কিন্তু কুর্দিদের পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে বলতে হয়, তাদের প্রয়োজন অনুসারে প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। সিরিয়ার দূর উত্তরের আফরিনেও এমনটি ঘটেছে, যে অঞ্চলটি ইয়েকিনেয়েন পারাস্তিনা জেল (ওয়াইপিজি) ও তাদের রাজনৈতিক সহযোগী ডেমোক্রেটিক ইউনিয়ন পার্টি (পিওয়াইডি) কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হয়। তুরস্ক মনে করে, এই গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তুরস্ক ও পশ্চিমে নিষিদ্ধঘোষিত পিকেকের পার্থক্য নেই। এর বিপরীতে এই গোষ্ঠীগুলো দাবি করে, তারা পুরোপুরি সিরীয় রাষ্ট্রের প্রতি অনুগত এবং ফেডারেল সিরিয়ার অধীনে তারা স্বায়ত্তশাসিত থাকতে চায়। আইএসবিরোধী যুদ্ধে তারা পশ্চিমাদের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ মিত্র। এই যুক্তিগুলোর সমস্যা হলো এসবের মধ্যে সত্যের উপাদান আছে। পিওয়াইডির নেতারা যত জোর দিয়েই বলুন না কেন তাঁরা পিকেকের অংশীদার নন, পারিপার্শ্বিক প্রমাণে হয়তো অন্য কিছু মনে হবে। এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। পিকেকে এর আগে সিরিয়াভিত্তিক ছিল। আর সিরিয়ার সরকার বহু বছর ধরে কুর্দিদের পিকেকেতে যোগ দিতে উৎসাহিত করার নীতি গ্রহণ করেছিল। একদিন এই যোদ্ধাদের ঘরে ফিরতে হতো।
এর মানে যেহেতু এটা নয় যে ওয়াইপিজি মানেই পিকেকে, সেহেতু আঙ্কারা কেন এই দাবি করবে, তা বোধগম্য। তবে কুর্দি গোষ্ঠীগুলো নিজেদের রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বশীল প্রমাণ করেছে। ২০১১ সালে সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা নিজেদের অধিকৃত অঞ্চল পরিচালনা করেছে। আর সামরিক দিক থেকে ওয়াইপিজি মধ্যপ্রাচ্যে স্পার্টানদের সমতুল্য। সীমিত অস্ত্রে দারুণ শৃঙ্খলা ও অমিত বিশ্বাস নিয়ে লড়াই করে তারা কোবান রক্ষা করেছে। ইতিহাস বলবে, তখন থেকেই হাওয়া আইএসের বিরুদ্ধে ঘুরে যেতে শুরু করে, যার আগ পর্যন্ত তাদের অদম্য মনে হচ্ছিল। এরপর সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সের মূল সেনা হিসেবে তারা আইএসকে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে হটিয়ে দিয়েছে। শুধু সিরিয়ার উত্তর-পূর্বাঞ্চলেই নয়, ইরাকের সীমান্তে দিয়ের-এজর প্রদেশ পর্যন্ত তারা আইএসকে হটিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমা শক্তি, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাজ করে কুর্দিরা অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা অর্জন করেছে। এতে তাদের আরও বলবৃদ্ধি ঘটবে। সংক্ষেপে বললে পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে ন্যাটোর মিত্র তুরস্কের যুক্তি আছে। একইভাবে কুর্দিদের আইএসবিরোধী জোটেরও সেই যুক্তি আছে। যখন তাদের প্রায় অসম্ভব বিকল্প বেছে নিতে হয়, তখন সম্ভবত একদম ন্যূনতমটাই করা সহজ। কিন্তু আফরিনে যে যুদ্ধ হয়ে গেল, তা পশ্চিমা সরকারগুলো ইরাকে কুর্দিদের গণভোটের মতো সহজে উপেক্ষা করতে পারবে না। তাৎক্ষণিক কৌশলগত পর্যায়ে যুদ্ধ অভ্যস্ত কুর্দিরা ইতিমধ্যে তুরস্কের প্রক্সি সেনাদের মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে। তুরস্কের সেনারা কি আরও সফলতা অর্জন করবে? এটার সম্ভাবনা কম, তবে যদি তারা সফল হয়ও, তাহলে অনেক ত্যাগের বিনিময়ে তা পেতে হবে। তুরস্কের সেনাবাহিনী এখনো ২০১৬ সালের জুলাই মাসে ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ধাক্কা সামলে উঠতে পারেনি। এখন তুর্কি সেনা বা তাদের প্রক্সিরা যদি আফরিনে রক্তাক্ত যুদ্ধে পরাজিত হয়, তাহলে এরদোয়ানের বিচার-বুদ্ধি সেই জনগোষ্ঠীর প্রশ্নের মুখে পড়তে পারে, যারা তাঁর কারণেই আরও জাতীয়তাবাদী ও কুর্দিবিরোধী হয়ে উঠেছে। এ ছাড়া কুর্দিরা আরও জঙ্গি হয়ে উঠলে তুরস্কের কুর্দিরা তা থেকে সুবিধা নিতে পারে এবং আন্দোলনের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে পারে। ইরাক ও ইরানেও কুর্দিদের এই তর্জন-গর্জন দেখা যেতে পারে। আফরিনের প্রতিরক্ষায় কুর্দিরা সফল হোক বা না হোক, স্বাগতিক রাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে তাদের বৃহত্তর বিদ্রোহ সংঘটিত হওয়ার সুযোগ আছে। এই সম্ভাব্য কুর্দি বিদ্রোহ যেমন অনেক কিছু বদলে দিতে পারে, তেমনি তা নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণীও করা সম্ভব নয়। এমনকি তারা মধ্যপ্রাচ্যের রাষ্ট্রের সীমানা নিয়েও খেলতে পারে। অন্যদিকে ন্যাটোর সংহতির ওপরও এর প্রভাব পড়তে পারে। রাশিয়া সিরিয়ায় হস্তক্ষেপ করায় তার পক্ষে ন্যাটোর অখণ্ডতা খাটো করার সুযোগ এসেছে। অন্যদিকে পূর্ব ইউরোপ, বাল্টিকসহ সম্ভবত তার বাইরেও রাশিয়ার স্বার্থের বিস্তার ঘটানোর সুযোগ এসেছে। রাশিয়া দৃশ্যত আফরিনে তুর্কি অভিযানে সহায়তা দিচ্ছে। তারা সিরিয়াকে বিমানঘাঁটি ব্যবহারের সুযোগ দিচ্ছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের এককভাবে ওয়াইপিজিকে রসদ দেওয়ার নীতির প্রকাশ্য সমালোচনা করেছে রাশিয়া। মস্কো অন্তত আংশিকভাবে সুন্দর একটি পরিকল্পনা করেছে। এতে ন্যাটোর দুই সদস্য যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক অত্যন্ত রক্তাক্ত ও দীর্ঘ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। ফলে আফরিনে যা ঘটছে, তা কেবল সিরিয়ার উত্তরে কুর্দিদের ভবিষ্যৎ নিয়ে নয়, এর মাজেজা আরও বড়। এতে এই অঞ্চল বদলে যেতে পারে, বিশেষ করে তুরস্ক, ইরান ও ইরাক। অন্যদিকে পশ্চিমের জন্যও তা গভীর প্রভাব বয়ে আনতে পারে। কারণ, তখন তাকে অধিকতর শক্তিশালী, গতিশীল ও সক্ষম রাশিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। সময় এসেছে পশ্চিমকে এখন শেষমেশ এক অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে। সেটা হলো মধ্যপ্রাচ্যে তারা কী অর্জন করতে চায়। শান্তি ও স্থিতিশীলতা রক্ষার মতো শুধু ভাসা–ভাসা বিবৃতি দিলেই চলবে না। এটা খুবই কঠিন এক প্রশ্ন তা ঠিক, কিন্তু এর উত্তর দিতে হবে। উত্তর না থাকলে আফরিনে যা ঘটছে এবং আগামী দিনে যা ঘটতে পারে, তাতে কেবল অন্যদের স্বার্থই সংরক্ষিত হতে পারে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া।
গ্যারেথ স্ট্যান্সফিল্ড: ইনস্টিটিউট অব আরব অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিসের অধ্যাপক, এক্সেটার।

No comments

Powered by Blogger.