‘এই নির্বাচন কমিশন লইয়া আমরা কী করিব?’ by সোহরাব হাসান

সংবিধানের ৫৯ ধারার (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, ‘আইনানুযায়ী নির্বাচিত ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ওপর প্রজাতন্ত্রের প্রত্যেক প্রশাসনিক একাংশের স্থানীয় শাসনের ভার প্রদান করা হইবে।’ এই আইনের আলোকে আমরা ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের দিকে তাকালে কী দেখতে পাই। দেখতে পাই, সেখানে পৌনে দুই মাস ধরে মেয়র পদটি শূন্য থাকলেও নির্বাচনের সম্ভাবনা আপাতত ক্ষীণ। নির্বাচন কমিশন ২৬ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন হবে বলে যে তফসিল ঘোষণা করেছিল, উচ্চ আদালত তিন মাসের জন্য তার কার্যকারিতা স্থগিত করে দিয়েছেন। তাহলে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন কে চালাবেন-প্যানেল মেয়র। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, প্যানেল মেয়র দিয়ে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানটি বেশি দিন চলতে পারে না। তাহলে কি অনির্বাচিত প্রশাসক বসানো হবে? প্রশাসক কত দিন থাকবেন? অতীতের নজির খুবই খারাপ। ছয় মাসের জন্য প্রশাসক নিয়োগের বিধান থাকলেও ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে প্রশাসক থেকেছেন বছরের পর বছর। জেলা পরিষদেও একই ঘটনা ঘটেছে। ঢাকা উত্তরের বিষয়ে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে খুব একটা দোষ দেওয়া যায় না। তারা যথাসময়ে মেয়রের পদটি শূন্য ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনকে জানিয়েছে। কিন্তু কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন রংপুরের নির্বাচনের পর আপন কৃতিত্বে এতটাই বিভোর ছিল যে, ঢাকা উত্তরের তফসিল ঘোষণার পূর্বশর্তটুকুও মানেনি। পত্রিকার খবর অনুযায়ী, ৯ জানুয়ারি তফসিল ঘোষণার আগে এই নির্বাচন নিয়ে বৈঠকে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ভোটার তালিকা, নতুন ওয়ার্ডের সীমানা নির্ধারণ, নতুন ওয়ার্ডের কাউন্সিলরদের মেয়াদ-সম্পর্কিত জটিলতাসহ ছয়টি বিষয় বিবেচনা করার কথা বলেছিলেন লিখিত আকারে। কিন্তু সেসব বৈঠকে এ বিষয়গুলো পুরোপুরি উপেক্ষা করা হয়েছে।
অবশ্য দুর্মুখেরা বলেন, ইসি ইচ্ছাকৃতভাবেই এই কাজ করেছে; যাতে নির্বাচনটি ভন্ডুল হয়ে যায়। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ। আমরা পাঁচজন বিজ্ঞ কমিশনার দ্বারা পরিচালিত নির্বাচন কমিশনের ওপর পুরোপুরি বিশ্বাস হারাতে চাই না। হাইকোর্ট তিন মাসের জন্য নির্বাচন স্থগিত করেছেন। আশা করতে পারি, তিন মাসের মধ্যে আইনি জটিলতা কাটিয়ে উঠে নতুন তফসিল ঘোষণা করা হবে। কিন্তু ঢাকা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের যে ঐতিহ্য, তাতে খুব একটা ভরসা পাই না। এর আগেও নানা বাহানায় নির্বাচন ঠেকিয়ে রাখার নানা কসরত চলেছে। আমাদের গণতন্ত্র সামনে এগোনোর পথ দেখায় না। পেছনে যাওয়ার সুড়ঙ্গ তৈরি করে। পৃথিবীর আর কোনো দেশে নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্ক, এত মারামারি, হানাহানির ঘটনা ঘটেনি। আদালতের আদেশের পর ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘নির্বাচন করা ইসির দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার থেকে এসব নির্বাচন করার জন্য অনুরোধ পেয়েছে ইসি। সেভাবেই প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। আইনি বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনো বাধা নেই। এর পরিপ্রেক্ষিতেই তফসিল ঘোষণা করা হয়।’ তাহলে বাধা এল কেন? সংবিধানের ১২৫ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা সত্ত্বেও (গ) কোন আদালত, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হইয়াছে এইরূপ কোন নির্বাচনের বিষয়ে, নির্বাচন কমিশনকে যুক্তিসংগত নোটিশ ও শুনানির সুযোগ প্রদান না করিয়া, অন্তর্বর্তী বা অন্য কোনরূপে কোন আদেশ বা নির্দেশ প্রদান করিবেন না।’ সরকারের বা সরকারি দলের নেতাদের মনে যা-ই থাকুক না কেন, এখানে মূল ভিলেন নির্বাচন কমিশনই। এখন তাকে ভিলেনের পোশাক বদলে নায়কের চরিত্র পেতে হলে নির্বাচনটি করে দেখাতে হবে। কিন্তু শুরু থেকে তাদের আচরণে গা ছাড়া ভাব লক্ষ করা গেছে। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ পাওয়ার পরও তারা এ বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন বোধ করেনি। নির্বাচন কমিশন কি আইন জানত না? তাদের আইনজীবী প্যানেলে কি এমন কেউ ছিলেন না যে আগে থাকতে সজাগ করে দিতে পারতেন? আদালতে নির্বাচন কমিশনের পক্ষে যে আইনজীবী ছিলেন, তিনি বলতে পারেননি আদালতের নোটিশ নির্বাচন কমিশনে পৌঁছেছে কি না? ‘এ রকম আইনজীবী ও নির্বাচন কমিশন লইয়া আমরা কী করিব?’ ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর জাতীয় সংসদে স্থানীয় সরকার (সিটি করপোরেশন) (সংশোধনী) বিল, ২০১১ পাসের মাধ্যমে ঢাকা শহর দ্বিখণ্ডিত হলেও বিভক্ত সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয় ২০১৫ সালের এপ্রিলে। পাঁচ বছর অন্তর সরাসরি ভোটের মাধ্যমে একজন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার কথা। কিন্তু প্রায় নয় বছর মেয়র পদে ছিলেন সাদেক হোসেন। মোহাম্মদ হানিফ ছিলেন সাড়ে সাত বছর। এসব উদাহরণ প্রমাণ করে না যে গণতান্ত্রিক সরকারগুলো মেয়াদ শেষে নির্বাচন দিতে সব সময় উদ্‌গ্রীব থাকেন। তারা তখনই নির্বাচন দেন, যখন নিজেদের জয়ের বিষয়ে নিশ্চিত হন। ১৮৬৪ সালের ১ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটি বা পৌরসভা সিটি করপোরেশনে রূপ নেয় ১৯৭৮ সালে। কিন্তু মেয়র পদে প্রথম ভোট হয় ১৯৯৪ সালে, খালেদা জিয়ার আমলে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী মোহাম্মদ হানিফ তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী মির্জা আব্বাসকে হারিয়ে জয়ী হন। নিয়ম অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে নতুন নির্বাচন দেওয়ার কথা ছিল।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে সেই নির্বাচন আর হয়নি। বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর ২০০২ সালের মার্চে দ্বিতীয়বারের মতো ঢাকা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ প্রার্থী দেয়নি। ফলে বিএনপির নেতা সাদেক হোসেন কার্যত বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যান। এরপর ২০০৭ সালের মার্চে নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ২০০৮ সালে মেয়র নির্বাচনের উদ্যোগ নিয়েও সফল হয়নি আওয়ামী লীগের বিরোধিতার কারণে। এমনকি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ আসন পেলেও ঢাকা সিটি করপোরেশনে নির্বাচন দিতে সাহস পায়নি। শেষ পর্যন্ত ২০১১ সালের ২৯ নভেম্বর ঢাকা শহর দ্বিখণ্ডিত করে সাদেক হোসেনের মেয়রত্বের অবসান ঘটানো হয়। ২০১৫ সালের ৩০ এপ্রিল বিভক্ত দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচন হয় বিশেষ পরিস্থিতিতে। এর আগে তিন মাস ধরে বিএনপি জোটের জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন চলছিল। অনেকের ধারণা ছিল, বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেবে না। কিন্তু তারা নির্বাচনে অংশ নেয় এবং মির্জা আব্বাস ও তাবিথ আউয়াল প্রার্থী হিসেবে সরকারি দলের প্রার্থীদের শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতার মধ্যে ফেলেন। ভোটের মাঝামাঝি প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে না দাঁড়ালে কী হতো, বলা কঠিন। তবে নির্বাচনটি যেমনই হোক না কেন, আনিসুল হক নাগরিকদের কিছুটা হলেও স্বস্তি দিয়েছেন। বিশেষ করে, সাত রাস্তার মোড়ের রাস্তা দখল করে ট্রাকস্ট্যান্ড, গাবতলীতে বাসস্ট্যান্ড দখলমুক্ত করার ক্ষেত্রে তাঁর সাহসী ভূমিকা সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। তাঁর ক্লিন ঢাকা গ্রিন ঢাকা স্লোগান পুরোপুরি বাস্তবায়িত না হলেও নগরবাসীর মধ্যে আশা জাগিয়েছিলেন। কিন্তু সোয়া দুই বছরের মাথায় তাঁর অকালমৃত্যু ঢাকা উত্তরের অনেক কাজকেই থামিয়ে দিয়েছে। নির্বাচনের কথা যখন এলই, তখন আরেকটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতারা কথায় কথায় নিজেদের সাচ্চা গণতান্ত্রিক দল বলে দাবি করেন, কিন্তু তাঁরা এক কোটি মানুষ-অধ্যুষিত ঢাকা উত্তরে এমন একজন নেতা তৈরি করতে পারেননি, যাঁকে মেয়র হিসেবে মনোনয়ন দিতে পারেন। ২০১৫ সালেও তাঁরা প্রার্থী ধার করেছিলেন চৌকস ব্যবসায়ী নেতা ও টিভি ব্যক্তিত্ব আনিসুল হককে। আর এ বছর দল মনোনয়ন দিয়েছে ব্যবসায়ী নেতা আতিকুল ইসলামকে। তুলনায় বিএনপির প্রার্থীসংকট কম। মামলার কারণে সাদেক হোসেন প্রার্থী হতে না পারলেও দক্ষিণে মির্জা আব্বাস প্রার্থী হন। উত্তরে ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়ালের প্রার্থিতা বাতিল হলে তাঁর স্থলে পুত্র তাবিথ আউয়াল প্রার্থী হন। এবারেও তাবিথকে মনোনয়ন দিয়েছে বিএনপি। ব্যবসায়ী নেতা আবদুল আউয়াল এখন বিএনপি করলেও একসময় আওয়ামী রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক মহলে নানা জল্পনা চলছে। বিরোধী দল বলেছে, নির্বাচন হলে সরকারি দল হেরে যাবে। এ কারণে নির্বাচন কমিশন ইচ্ছাকৃতভাবেই ত্রুটিপূর্ণ তফসিল ঘোষণা করেছে, যাতে নির্বাচনটি না হয়। আর ক্ষমতাসীন দল বলছে, আদালতের ওপর তাদের কোনো হাত নেই। তারা নির্বাচনের জন্য প্রস্তুত। তাদের প্রার্থীও পরিচ্ছন্ন ইমেজের। এখন নির্বাচন কমিশনকেই প্রমাণ করতে হবে, তারা কারও ইচ্ছা পূরণ করেনি। এবং সেটি সম্ভব তিন মাসের মধ্যে আইনি জটিলতা দূর করে নির্বাচনের নতুন তফসিল ঘোষণা করে। সেই কাজ করতে পারলে তাদের বাহবা দেবে, ঢাকা উত্তরও নির্বাচিত প্রতিনিধি পাবে। আর যদি বাকি মেয়াদে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে কোনো নির্বাচন না করতে পারে, তাহলে বুঝতে হবে কমিশন নিজেকে যতই স্বাধীন ঘোষণা করুক না কেন, আসলে তারা সরকারের অধীন। তবে এ প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে উপনির্বাচনের ইতিহাস বড় নির্মম। পাকিস্তানের সূচনাপর্বে পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের উপনির্বাচনে তরুণ নেতা শামসুল হকের কাছে মুসলিম লীগের প্রার্থীর পরাজয় ঘটলে নূরুল আমীন সরকার আর কোনো উপনির্বাচন দিতে সাহস পায়নি। ১৯৯৪ সালে মাগুরা উপনির্বাচনে বিএনপির জবরদস্তি ক্ষমতাসীনদের আত্মবিনাশের পথে নিয়ে গিয়েছিল। ১৯৯৯ সালে উপনির্বাচনে কাদের সিদ্দিকীকে জোর করে হারানো হয়েছিল বলে তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মদ আবু হেনা সেই নির্বাচনের গেজেট প্রকাশ করেননি। তিনি ছুটিতে যাওয়ার পর গেজেট প্রকাশিত হয়েছিল। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনটি এখন আদালত আর নির্বাচন কমিশনের মাঝখানে ঝুলছে। সেই সঙ্গে উত্তর সিটি করপোরেশনের এক কোটি মানুষের ভাগ্যও।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.