চকলেটের ঊর্ধ্বে উঠতে হবে

বস্তুতে যেমন কোনো দোষ থাকে না, প্রয়োগের দোষে অথবা মাথার দোষ-গুণ বিচারের অক্ষমতায় তা দোষী সাব্যস্ত হয়, ঠিক তেমন কিছু কিছু নির্দোষ শব্দও হরহামেশাই নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করে থাকি আমরা। উদাহরণগুলো দিয়ে নিই আগে। ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ শব্দটি কেন শুধু মন্দার্থেই ব্যবহার করা হয় বুঝে আসে না। প্রতিক্রিয়া মানে ক্রিয়ার বিপরীতে যে ক্রিয়া। তাই যদি হয়, তাহলে তো প্রশ্ন ওঠেই, ক্রিয়ার বিপরীতে কি শুধুই খারাপ ক্রিয়া হয়, ভালো ক্রিয়া কেউ কখনও দেখায়নি বা দেখায় না? আবার সম্পূরক ক্রিয়াও তো প্রতিক্রিয়াই, সেটা ভালো ও খারাপ দুটোই হতে পারে নিশ্চয়ই। অথচ আমরা যখন বলি ‘প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতি’, ‘প্রতিক্রিয়াশীল বুদ্ধিজীবী’- তখন তা দ্বারা যথাক্রমে অপরাজনীতি এবং প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট কিংবা অপ্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীই বুঝিয়ে থাকি। হ্যাঁ, ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ মন্দার্থক শব্দ বটে, যখন তা বিপরীত ক্রিয়া দ্বারা প্রগতিকে আটকাতে চায়। অর্থাৎ শব্দটি সদা-সর্বদাই মন্দার্থক নয়; ভালোকে আটকাতে অথবা তার গতিকে ভুলপথে পরিচালিত করতে যে ক্রিয়া সংঘটিত হয়, সেই প্রতিক্রিয়ার ক্ষেত্রে শব্দটি পৌনঃপুনিকভাবে ব্যবহৃত হওয়াতেই তা শুধুই মন্দার্থক চরিত্র ধারণ করেছে। এমন আরও আছে। যেমন, আরবি রাজাকার বা ইংরেজি collaborator শব্দের অর্থ সহযোগী। এই সহযোগিতা ভালো কাজের প্রতি হতে পারে, খারাপ কাজেরও।
কিন্তু ’৭১-এ পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগী একটি সংগঠনের নাম ছিল যেহেতু রাজাকার বাহিনী এবং এই সংগঠনের সদস্যরা খুন-ধর্ষণ-লুট ইত্যাদিতে লিপ্ত ছিল, তাই শব্দটি একটি গালি হিসেবেই ঢুকে গেছে বাঙালির অভিধানে, এটি এখন নিয়তই মন্দার্থক শব্দ। এটা এমন এক গালি যে, হুমায়ূন আহমেদ তার এক নাটকে মন্দ চরিত্রগুলোকে গালিটি খাইয়েছিলেন একটি তোতা পাখির মুখ থেকে। পাখিটি অনবরত বলতে থাকে- তুই রাজাকার! collaborator বলতেও এখন আমরা তাকেই বুঝি, যিনি বা যারা সহযোগিতা করেছিলেন পাকিস্তানি সেনাদের। আসলে আমরা সবাই প্রতিক্রিয়াশীল এবং রাজাকারও; কোন্ কর্মের কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছি এবং কাকে সহযোগিতা দিচ্ছি, তার ওপর নির্ভর করছে কাজটা ভালো, না খারাপ। সমালোচনা শব্দটিরও সন্ধি বিচ্ছেদ করলে দাঁড়ায়- সম+আলোচনা অর্থাৎ বিষয়টির ভালো ও মন্দ দুটোই আলোচনা করতে হবে। অথচ আমাদের অনেকে সমালোচনা বলতে বুঝি শুধু নিন্দাই। এখন আমরা যে শব্দটি নিয়ে খেলা করব, সেটিও এক অসহায় শব্দ- ‘সাম্প্রদায়িক’। জাগতিক মানে যেমন জগৎ-সম্পর্কিত যাবতীয় কিছু, ব্যাকরণে ভুল না করলে সাম্প্রদায়িকের অর্থ তেমন সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যাবতীয় কিছু অথবা সম্প্রদায়ভুক্ত। আমরা সবাই কিন্তু কোনো না কোনোভাবে সম্প্রদায়ভুক্ত, সেটা ধর্মীয়, জাতিগত কিংবা অন্য যে কোনো সম্প্রদায়। অর্থাৎ অসাম্প্রদায়িক মানুষের অস্তিত্বই নেই। অথচ আমরা বলে থাকি- লোকটির অনেক ভালো গুণের একটি হল তিনি অসাম্প্রদায়িক! আসলে আমরা এ ক্ষেত্রে বোঝাতে চাই লোকটি অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করেন না, বরং উদারনীতি অবলম্বন করে থাকেন। বলতেই হবে, এই ভাবটি প্রকাশের জন্য অসাম্প্রদায়িক শব্দটি খাটে না। কারণ তিনি তো একটি সম্প্রদায়ভুক্ত হয়েই আরেকটির প্রতি সহনশীল।
তবে কি আমরা শব্দটি দ্বারা এটাই বোঝাতে চাই যে, লোকটি তার সম্প্রদায়ের পরিচয়ে পরিচিত হতে চান না? কথা হল, এই পরিচয় তিনি মুছে ফেলতে পারবেন না কখনই। তিনি বড়জোর বলতে পারবেন- সম্প্রদায়ভিত্তিক যত হীনমন্যতা, তিনি তার সবকিছুরই ঊর্ধ্বে। আরেকটি ঠেস দিয়ে কথাটা পাকাপোক্ত করে দাঁড় করানো যায়। শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ উপন্যাসটি পড়েছিলাম ক্লাস নাইনে থাকতে। বইটি হাতে নিতেই খটকা লেগেছিল। বিজ্ঞান ক্লাসের পড়াগুলো থেকে জেনেছি- পৃথিবীতে এমন কিছুই নেই যার কোনো ধর্ম বা বৈশিষ্ট্য নেই; অর্থাৎ চরিত্র নেই। তো চরিত্র ছাড়া মানব-মানবী হয় নাকি? সে যদি দুশ্চরিত্র হয়ে থাকে, সেটা তো চরিত্রই। সেটা খারাপ চরিত্র বটে। কী আর করি! শরৎবাবুকে মাফ করে দিয়েই ‘চরিত্রহীন’ পড়া শুরু করে দুশ্চরিত্র খুঁজতে থাকলাম। তো চরিত্রহীন বলে যেমন কিছু নেই, অসাম্প্রদায়িকও তেমন। এখন আমরা আসল কথায় ঢুকব। হ্যাঁ, আমরা সবাই সাম্প্রদায়িক। শব্দটির ব্যবহার যে ব্যাকরণ ছাড়িয়ে গেল, তার কারণ সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষদের অনেকেই কিংবা কেউ কেউ শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ পোষণ করতে করতে আমাদের ইতিহাসকে এমন এক জায়গায় নিয়ে এসেছে যে, এখন সাম্প্রদায়িক বললেই বুঝতে হয় লোকটি অন্য সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষপরায়ণ। পাল্টে গেছে যেমন রাজাকার শব্দের অর্থ। খুব জোর দিয়েই বলতে পারি, সম্প্রদায়ভুক্ত কিছু লোকের হীনমন্যতার দায় পুরো সম্প্রদায় নিতে পারে না আর তাই সাম্প্রদায়িক শব্দটি নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা সমীচীন নয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের এই উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক কথাটি শুধু ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, তা-ও সেটা আবার শুধু মুসলমান অথবা হিন্দু; অথচ সম্প্রদায় শুধু ধর্মভেদেই হয় না, অন্য অনেক প্রকারেই এর বিভাজন হয়ে থাকে। হ্যাঁ, সাধারণভাবে শুধু মুসলমান ও হিন্দুর মধ্যেই সাম্প্রদায়িকতা সীমাবদ্ধ। রোহিঙ্গাদের যদি বৌদ্ধের পরিবর্তে হিন্দুরা বিতাড়িত করত এবং জেরুজালেমকে একজন হিন্দু প্রেসিডেন্ট ইসরায়েলের রাজধানী ঘোষণা করতেন, তাহলে এদেশে রায়ট লেগে যেত। স্মর্তব্য, বাবরি মসজিদ ভেঙে ফেলার আধ ঘণ্টার মধ্যে কলকাতার মুসলমানরা শহরটির অসংখ্য মন্দির চুরমার করেছিল। আপনি বিদেশ থেকে হিন্দু ব্যতিরেকে অন্য কোনো বিধর্মীকে বিয়ে করে নিয়ে এলেন, তো কেউ আপনাকে গালমন্দ করবে না। বরং বলবে- ব্যাডা একখান, ম্যাম বিয়া কইরা আনছে! সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের কবিতা খুব প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবে তখন- ‘জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে, সে জাতির নাম মানুষজাতি।’ কিন্তু একজন মুসলমান হয়ে যখনই কোনো হিন্দুকে বিয়ে করলেন- দুই পক্ষেরই জাত যাবে। নিজ নিজ সম্প্রদায়ের থুথু পড়তেই থাকবে আপনার গায়ে আমৃত্যু। এই সংকট থেকে উত্তরণের একটাই উপায় আছে আর তা হল একজনকে ধর্মান্তরিত হয়ে সমান সমান হতে হবে। তবে মুসলমান যেহেতু হিন্দু হতে পারে না, তাই হিন্দুকেই, তিনি জায়া অথবা পতি- মুসলমান হতে হবে।
তাতেও অবশ্য দুই কুল রক্ষা হবে না- মুসলমানরা ঠাণ্ডা হয়ে যাবে, হিন্দুরা হয়ে উঠবে আরও উত্তপ্ত। যা হোক, এখন থেকে আমরা সাম্প্রদায়িক ও অসাম্প্রদায়িক শব্দ দুটোকে প্রচলিত অর্থেই ব্যবহার করব। হ্যাঁ, হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত কিছু মানুষের পরস্পরের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ ছড়ানোর ইতিহাস অনেক পুরনো। লম্বা উদ্ধৃতি দিলে নিজের কথা ছোট হয়ে আসে। তবু খুব যুৎসই বলে দিচ্ছি। নজরুলের ‘হিন্দু-মুসলমান’ থেকে নেয়া। কিছু পাঠকের জ্ঞাতার্থে বলে নিই, উদ্ধৃতিটিতে ‘ন্যাজ’ শব্দটি ‘লেজ’-এর সেই আমলের কথ্যরূপ। নজরুল লিখছেন- ‘একদিন গুরুদেব রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছিল আমার, হিন্দু-মুসলমান সমস্যা নিয়ে। গুরুদেব বললেন : দেখ, যে ন্যাজ বাইরের, তাকে কাটা যায়, কিন্তু ভিতরের ন্যাজকে কাটবে কে? হিন্দু-মুসলমানের কথা উঠলে আমার বারে বারে গুরুদেবের ঐ কথাটাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে এ প্রশ্নও উদয় হয় মনে যে, এ ন্যাজ গজালো কি করে? এর আদি উদ্ভব কোথায়? একইসঙ্গে এটাও মনে হয়, ন্যাজ যাদেরই গজায়- তা ভিতরের হোক আর বাইরেই হোক- তারাই হয়ে ওঠে পশু। যেসব ন্যাজওয়ালা পশুর হিংস্রতা সরল হয়ে বেরিয়ে আসে বাইরে- শৃঙ্গরূপে, তাদের ততো ভয়ের কারণ নেই, যত ভয় হয় সেই সব পশুদের দেখে- যাদের হিংস্রতা ভিতরে, যাদের শিং মাথা ফুটে বেরোয়নি। শিংওয়ালা গোরু-মহিষের চেয়ে শৃঙ্গবিহীন ব্যাঘ্র-ভল্লুক জাতীয় পশুগুলো বেশি হিংস্র- বেশি ভীষণ, এ হিসেবে মানুষও পড়ে ওই শৃঙ্গহীন বাঘ-ভালুকের দলে। কিন্তু বাঘ-ভালুকের তবু ন্যাজটা বাইরে, তাই হয়তো রক্ষে। কেননা, ন্যাজ আর শিং দুইই ভিতরে থাকলে কী রকম হিংস্র হয়ে উঠতে হয়, তা হিন্দু-মুসলমানের ছোরা-মারা না দেখলে কেউ বুঝতে পারবে না।’ নজরুল ‘বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা, শির উঁচু করি মুসলমান’ এবং এমন আরও কিছু কবিতা ও গান লিখেছেন বলে অনেকে তাকে সাম্প্রদায়িক বলেন। তারা বুঝতেই পারেন না, উপরের কবিতাটিতে তিনি একটি সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ আর তারও উপরে যে উদ্ধৃতিটি দিয়েছি, সেখানে তিনি অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের অধিকারী। এ-দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। একটি জাত্যাভিমান, আরেকটি অন্য জাতির প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান। রবীন্দ্র-নজরুলের যুগ গত হয়েছে অনেক আগেই।
কিন্তু ছোরা মারামারি বন্ধ তো হয়ইনি, বরং হাতে উঠে এসেছে অধিকতর তীক্ষ্ণ মারণাস্ত্র। প্রকৃতপক্ষে ভারত ও বাংলাদেশ- দু’দেশেই সাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটে চলেছে দু’ভাবে- একটি সরব, অন্যটি নীরব। ভারতেরটা ভারতীয়রা বললেই ভালো, আমাদেরটা আমরা বলব। এখানে সরব সাম্প্রদায়িকতা হল পিরিওডিক্যাল, ওটা মাসিক, ষন্মাসিক অথবা বাৎসরিক; নীরব সাম্প্রদায়িকতা নৈমিত্তিক এবং এর পরিমাণ ও মাত্রা এত বেশি যে, রিপোর্টারের অভাবে সেই খবর দৈনিকগুলো প্রতিদিন প্রকাশ করতে পারে না। অন্যদিকে সরব সাম্প্রদায়িকতা ভিন্ন সম্প্রদায়ের শরীরে আঘাত করে বলে সর্বসাধারণের দৃশ্যপটেই থাকে তা, যেমনটা আমরা দেখেছি রামু, নাসিরনগর ও নীলফামারীর জলঢাকায়। নীরব সাম্প্রদায়িকতার মানসিক পীড়ন থেকে যায় অগোচরে। এই পীড়ন ভুক্তভোগীরা ছাড়া আর কারও পক্ষেই অনুভব করা সম্ভব নয়। যেমন, নবনীতা কিংবা নীহারিকা নামের চমৎকার মেয়েটিকে যখন তার স্যার ধমকের স্বরে বলেন- তোমার এই হিন্দু নাম কে রেখেছে- তখন সেই মর্মযাতনা হয়ে পড়ে এক, অদ্বিতীয়। প্রয়াত হুমায়ুন ফরীদির মেয়ের নাম দেবযানী। না জানি কত গঞ্জনা সইতে সইতে বড় হয়েছে সে! শব্দ, তা সেটা বাংলা, ইংরেজি, আরবি কিংবা অন্য যে কোনো ভাষার- কীভাবে শ্রেণীচরিত্র ধারণ করে বোঝা মুশকিল। বাংলা ভাষার প্রথম বৈয়াকরণিক রামমোহন রায়ও কি বুঝতেন? এই দেশে, হ্যাঁ এই বাংলাদেশেই এমন মা অথবা বাবা পাওয়া যাবে, যিনি তার সন্তানকে উপদেশ দেন, সে যেন তার হিন্দু সহপাঠীর বোতল থেকে পানি না খায়। আবার দেখুন, আমরা যখন হিন্দু বন্ধুটিকে, সে ঘনিষ্ঠও বটে, ইয়ার্কি করে মালাউন বলি, তখনও সেটা সাম্প্রদায়িকতা বৈ অন্য কিছু নয়।
মানুষের প্রতিটি কথা অথবা পদক্ষেপ কোনো না কোনো পূর্ব-নির্ধারিত সিদ্ধান্ত দ্বারা পরিচালিত কিংবা প্রভাবিত- সেটা হয় চেতন, না হয় অবচেতন অথবা অচেতন মানসিক স্তরের ভাবনা। কলম ওয়ার্নিং দিচ্ছে এই বলে যে, তোমার লেখার স্পেস ছোট হয়ে আসছে। অতঃপর সরব ও নীরব- দুই প্রকারের সাম্প্রদায়িকতার বিস্তারিত বর্ণনা না দিয়ে আর দু’-এক কথা লিখেই আমরা সাম্প্রদায়িকতামুক্ত থাকার একটা উপায় খুঁজে দেখার চেষ্টা করব। এক কথায় বললে এ দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ, তা তিনি যত সৎ ও সুনাগরিকতার জীবনই যাপন করুন না কেন, সাধারণভাবে এক ধরনের ভয়ের সংস্কৃতির মধ্যে বাস করছেন। এই সংকট এত গভীর যে, এককভাবে কোনো তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের পক্ষে এর সমাধান দেয়া সম্ভব নয়। শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের যে আপ্তবাক্যটি আমরা আওড়াই, তা আসলে বহিঃস্রোত; অন্তঃস্রোতগুলো হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি অবজ্ঞা ও উপেক্ষার। কখনও আবার তা সহিংসতায় ফেনিয়ে ওঠে। মনস্তত্ত্বের ওপর কোথায় যেন একটি লেখায় পড়েছিলাম- সংখ্যালঘু অথবা দুর্বল কিংবা দ্বিতীয় লিঙ্গের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রচার একধরনের রোগ, যার নাম sadomasochism- ধর্ষকাম ও মর্ষকামের সহযোগে সৃষ্ট এই জটিল রোগের মূলে থাকে অস্বাভাবিক আনন্দ, যৌন সুখ ও হিংসা চরিতার্থ করার বাসনা। এই আনন্দকে বলা হচ্ছে sado-masochistic pleasure, ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেডের প্রাক্কালেই নাকি এই দুর্লক্ষণ (Bad symptom) দেখা দেয়। তবে কি বাংলাদেশ সবসময়ই একটা ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছে? যদি তাই হয়, তাহলে সাধ্য কী একক সরকারের পক্ষে, থামায় মানুষের স্প্রেডিং ইনটলারেন্স বা ধর্মীয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান অসহিষ্ণুতা! হ্যাঁ, কী করে মুক্ত থাকা যাবে সাম্প্রদায়িকতা থেকে? প্রথমেই বুঝতে হবে মানুষের যাবতীয় চিন্তা- সেটা সু অথবা কু- উৎপত্তিস্থল তার মাথার মগজ। এই মগজ ঠিক করা ছাড়া তার আচরণ ঠিক হবে না, হতেই পারে না। কস্মিনকালেও না। ডায়াগনোসিস তো হল, এবার আমরা প্রেসক্রিপশন লেখা শুরু করি। এ জীবনে কত ইন্টারেস্টিং মানুষের সঙ্গেই না মিশতে হয়েছে! তাদের একজন ছিলেন আহমদ ছফা, আমাদের ছফা ভাই। এই অসাধারণ জ্ঞানদীপ্ত মানুষটি সমানুপাতিক প্রচার পেলেন না!
তো জিয়ার আমলে যখন প্রথম জেব্রা ক্রসিং চালু করা হয়েছিল, তিনি একদিন অন্যমনস্কতায় নিয়ম না মেনে রাস্তা পার হতেই পল্টন পুলিশ বক্সের এক পুলিশ তাকে কান ধরে উঠ-বস্ করতে বলে। ছফা ভাই এই রাজকর্মচারীর নির্দেশ নির্দ্বিধায় পালন করার পর এক আড্ডায় যখন এই গল্প করছিলেন, সবাই মুখ ভার করায় তিনি বলেছিলেন- তোমরা এমন করছো কেন, আমাকে তো কোনো মানুষ অপমান করেনি, করেছে পুলিশ! তো এই মনস্তত্ত্ব ছিল আমার এক বন্ধুরও। সে বলত- শোন্ তর্ক করবি জ্ঞানীর সঙ্গে, মূর্খকে ওয়াক-ওভার দিবি, দেখবি কত মজা! মূর্খের কাছে কৈফিয়ত চাইবি না। তো এই বন্ধুটির একটি আপাত সার্কাসটিক কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণ কথাই এ লেখার মূল সুর। কারও অর্বাচীনতা দেখলেই সে বলত- আমি চকলেটের ঊর্ধ্বে উঠে গেছি। অর্থাৎ যে বয়সে সে চকলেট খেত, সেই বয়স অনেক আগেই অতিক্রম করেছে সে। ঠিকই তো। চকলেট খাওয়ার বয়সে কাব্যগুণ বিচার করে নয়, নিছকই ধর্মের টানে বলতাম নজরুল রবীন্দ্রনাথের চেয়ে বড় কবি। এখন করি কাব্যগুণ বিচার। তাছাড়া কাব্যগুণ বিচার করেই বা একজনকে আরেকজনের ওপর স্থান দিতে হবে কেন? প্রত্যেকের বৃত্তই আলাদা- আলাদা তার কেন্দ্র, পরিধি, জ্যা সবই। এই প্রশ্নটা নিশ্চয়ই এক বড় গাধার- পাখির সমাজে কাক চালাক, না পশুর মধ্যে শিয়াল? অথবা ফলের রাজা আম, না ফুলের রানী গোলাপ? এ প্রশ্নটাও নিশ্চয়ই বোকারই- হিন্দুদের কাছে হিন্দুধর্ম শ্রেষ্ঠ, নাকি মুসলমানদের দৃষ্টিতে ইসলাম? সমকামিতা জেনেটিক বাস্তবতা বটে। তাই পাশ্চাত্যবাসীর চোখে এর ভালো-মন্দের ব্যাপার নেই। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতা জেনেটিক সংকট নয়। এটা রোগ এবং তা নিরাময়যোগ্য। শুধু ধর্মনির্বিশেষে ভালোবাসতে হবে মানুষ। এজন্য মাথাটা মেরামত করে ঊর্ধ্বে উঠতে হবে চকলেটের।
মাহবুব কামাল : সাংবাদিক
mahbubkamal08@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.