একজন আইভীর গল্প

সেলিনা হায়াৎ আইভী একজন ব্যতিক্রমধর্মী রাজনীতিবিদ। এখন তার পরিচয় নারায়ণগঞ্জের সীমারেখা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। উত্তরাধিকার সূত্রে তিনি তার বাবা আলী আহমেদ চুনকার প্রতিবাদী রাজনীতি ধারণ করেন। গোড়ার দিকে যেসব ভালো মানুষ আওয়ামী লীগকে ধারণ করতেন, তিনি তাদের একজন। যারা বয়সী মানুষ তাদের মনে থাকার কথা আওয়ামী লীগ আজ তার সাথে যা করছে, তার বাবার সাথে তাই করেছিল। আরো মজার ব্যাপার ঘটেছিল একই রকম ঘটনা। নির্বাচনী প্রতিযোগিতায় ‘মানি, মাসল ও মিডিয়া’ যখন আওয়ামী লীগের সঙ্গী হয়ে ওঠে, তখন চুনকা সরকারি নমিনেশন পেতে ব্যর্থ হন। জনশ্রুতি এ রকম তিনি বঙ্গবন্ধুকে বলেছিলেন, ‘আপনি আমাকে দোয়া করে দিন। নির্বাচনে জিতে যেন আপনার গলায় জয়ের মালা পরাতে পারি।’ প্রায় সাত বছর আগে ৩০ অক্টোবর, ২০১১ আইভী একইভাবে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীকে হারিয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। পরবর্তী নির্বাচনে অবশ্য ক্ষমতাসীন দল ঝুঁকি নিতে চায়নি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাথে কোথাও যেন আইভীর একটি স্বাতন্ত্র্য ফুটে ওঠে। গত নির্বাচনে সর্বস্তরের সাধারণ মানুষ অসাধারণদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে আইভীকে ভোট দেন। কিন্তু ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলতেই থাকে। নারায়ণগঞ্জ যেন রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের একটি নমুনা হয়ে উঠেছে। সেখানে এ সময়ের বহুল আলোচিত সাত খুনের ঘটনা ঘটে। পরে মেধাবী কিশোর ত্বকী হত্যাকাণ্ড ঘটে।
একজন প্রবীণ শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে কান ধরে ওঠবস করতে হয়। এবার ঘটল আইভীর ওপর সশস্ত্র হামলা। সব অঘটনের ইশারা একই পরিবারের দিকে। অতীতের রাজনীতিতে এই পরিবারের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা আছে। আর সে জন্যই হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওই পরিবারের অভিভাবকত্বের কথা বলেছিলেন। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা সেই অভিভাবকত্বের অসম্মান করছে। খবর বেরিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী মেয়রের ওপর সশস্ত্র হামলায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন। দৃশ্যত এতে ক্ষমতাসীন সরকারের ভাবমর্যাদার যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। ঘটনার তাৎক্ষণিক বিবরণীতে জানা যায়, মেয়র আইভী হকারমুক্ত ফুটপাথ চেয়েছিলেন। তার এই চাওয়া অন্যায় কিছু নয়। এই পদক্ষেপের আগে মেয়র আইভী ২০০৭ সালে হকারদের জন্য ৬০০ দোকান করে দিয়েছিলেন। হকারদের পুনর্বাসনের জন্য তার আরো পরিকল্পনা রয়েছে। ২০০৭ সালে সব হকারকে দোকান বরাদ্দ দেয়া যেমন সম্ভব হয়নি, তেমনি সব বরাদ্দ যথার্থ ব্যক্তি পায়নি- এ অভিযোগও রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিতরণ করা ৬০০ দোকানের মধ্যে এখন ২৫৫ জন যথার্থ মালিকানা ধারণ করছেন। বাংলাদেশের মানুষের সুবিধাবাদী এবং অপেশাদার স্বভাবের কারণে বণ্টনে দলীয়করণ হয়েছে এবং অনেকে দোকান বিক্রি করে আবার ফুটপাথে চলে এসেছে। এ পরিস্থিতিতে আইভী ফুটপাথকে যখন হকারমুক্ত করার প্রচেষ্টা নিলেন, তখন তার প্রতিপক্ষ ওই সস্তা জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগালেন। আর একটি দুঃখের বিষয়- বাম ধারার রাজনীতিকেরা ঘটনার ভালো-মন্দ দায়িত্বশীলতার সাথে বিবেচনা না করে পরোক্ষভাবে গডফাদারের হাতকে শক্তিশালী করলেন। ফুটপাথ হকারমুক্ত করা একটি অজনপ্রিয় কিন্তু প্রয়োজনীয় কাজ। ঘটনাক্রমে মনে পড়ছে, ঢাকা মহানগরে মির্জা আব্বাস এই প্রয়োজনীয় কাজটি করে নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলেন। তাই সচেতন নাগরিকরা ভাবেন, ‘আমাদের দেশে সেই রাজনীতি হবে কবে, যখন কথা বড় না হয়ে কাজ বড় হবে।’ দৃশ্যত হকার উচ্ছেদের পক্ষে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি থাকাটা স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হচ্ছে- অসৎ উদ্দেশ্যের হুঙ্কার। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নারায়ণগঞ্জের গডফাদার আগের দিন তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, এটা অনুরোধ না নির্দেশ। নারায়ণগঞ্জের ফুটপাথে হকার বসবে।... যারা আমাদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, তাদের জবাব দিতে দুই মিনিটও লাগবে না।’ মেয়র সেলিনা হায়াৎ ঘটনাপরবর্তী সংবাদ সম্মেলনে সুস্পষ্টভাবে তার প্রতিপক্ষের নাম উচ্চারণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার দুই গজ সামনেই পিস্তল বের করেছে। বৃষ্টির মতো ইটপাটকেল নিক্ষেপ করা হয়েছে।... এটা পারিবারিক কোনো দ্বন্দ্ব নয়। আমি কোনো দিন আগ বাড়িয়ে কারো সাথে লাগতে যাই না।
এখানে তো একপক্ষ মারল, আরেক পক্ষ মার খেল। তিনি তো আগের দিনই ঘোষণা দিয়েছেন।’ অপর দিকে, তার প্রতিপক্ষ সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেছে, ঘটনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে অথবা প্রকৃত সত্য না জেনেই অনেক গণমাধ্যম সংঘর্ষকে দু’জনের সংঘর্ষ বানানোর চেষ্টা করেছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো- হকার বনাম আইভীর দ্বন্দ্ব। গরিব বনাম গরিবের বিপক্ষের দ্বন্দ্ব। বস্তুত আইভীর ওপর হামলা একটি প্রকাশ্য সন্ত্রাস। শোনা যায়, পিস্তলধারী ব্যক্তিটি গডফাদারের দীর্ঘ দিনের সন্ত্রাসের সহযোগী। দৃশ্যত তিনি তার ক্যাডারকে রক্ষা করতে চেয়েছেন। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘নিয়াজুলের অস্ত্রটি খোয়া গেছে। সেটি ফেরত পাওয়া যায়নি। নিয়াজুল মামলা করলেও পুলিশ মামলা নেয়নি।’ শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত পুলিশ তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। শাসক দলের ক্যাডারদের এ ধরনের অস্ত্রবাজি নতুন নয়। বেশ কয়েক মাস আগে বায়তুল মোকাররমে হকার উচ্ছেদে পুলিশের সহযোগী হিসেবে অস্ত্রহাতে সোনার ছেলেদের দেখা গেছে। অবশ্য জনরোষে এবং গণমাধ্যমের কারণে তাকে পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে। হয়তোবা সে ইতোমধ্যে জামিনও পেয়ে গেছে। তার কারণ- সে সোনার ছেলে। এখানে তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় এই, নারায়ণগঞ্জের এবং বায়তুল মোকাররম উভয় ক্ষেত্রেই পুলিশের সামনেই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে এবং পুলিশের সহযোগী শক্তি হিসেবে এরা সাধারণত ব্যবহৃত হয়ে থাকে। নারায়ণগঞ্জের ব্যাপারে বিস্ময়ের ব্যাপার যে, পুলিশ তথা আইনশৃঙ্খলা কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে। পত্রিকার প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা যায়, দৃশ্যত তারা গডফাদারের পক্ষাবলম্বন করেছে। তা ছাড়া মেয়র আইভীকে উপমন্ত্রীর মর্যাদা দেয়া হয়েছে। সেই মর্যাদাবান ব্যক্তির ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ব্যর্থ হয়েছে। কথায় বলে ‘বাঘে-মোষে লড়াই করে, উলুখাগড়া পড়ে মরে’। সংঘর্ষের পর যাদের নিয়ে লড়াই তাদের কোনো উপস্থিতি লক্ষ করা যায়নি। তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে সুস্পষ্ট নির্দেশনা এবং পরিকল্পনার কথা কোনো পক্ষই বলেনি। তবে নারায়ণগঞ্জের প্রধান সড়কসহ কয়েকটি সড়কে ফুটপাথে সাময়িকভাবে হকার বসতে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। হকাররা ফুটপাথে সর্বত্র পুলিশের চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ। সবাই জানে, হকারদের নিয়ে ক্ষমতাসীনেরা সবসময়ই লুটপাটের রাজত্ব কায়েম করে আসছে।
এরা উভয় ক্ষেত্রেই স্বার্থবাদী ভূমিকা পালন করে। চাঁদাবাজিতে অংশ নেয়। হকারদের উচ্ছেদের সময় অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী হিসেবে পুলিশের সহযোগী হয়। মূলত রাজনীতির আবরণে এরা এক ধরনের শোষক। আইভী এবং এমপির দ্বন্দ্ব নতুন কিছু নয়। দ্বন্দ্ব ব্যক্তিগত পর্যায়ের মনে হলেও এতে আদর্শ, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পার্থক্য রয়েছে। আইভী লড়ছেন নাগরিক অধিকার, আইনের শাসন ও সুশাসনের জন্য। আইভী এবং তার পরিবারের অতীত ঘাঁটলে দেখা যায়, তারা রাজনীতিকে একটি মহৎ পেশা বলে গণ্য করছেন। মানুষের সেবাই তাদের লক্ষ্য। অপর দিকে তার প্রতিপক্ষের ‘সেকেন্ড জেনারেশন’-এর রেকর্ড মহৎ রাজনীতির সাক্ষ্য প্রমাণ দেয় না। সেখানে রাজনীতির লক্ষ্য হচ্ছে অবাধ লুণ্ঠনের জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার। ক্ষমতাসীন দলের সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃত্ব সম্পর্কে যদি এসব বিষয়ে পরিসংখ্যান নেয়া যায়, তাহলে আমাদের শুধু হতাশই হতে হবে। আওয়ামী মরুভূমিতে আইভী একটি মরূদ্যান। শুধু নারায়ণগঞ্জে এই দ্বন্দ্ব সীমিত নয়। শাসককুলের মধ্যে এই দ্বন্দ্ব এখন মহামারী আকার ধারণ করেছে। মজার ব্যাপার, এখানে এবং দেশের সর্বত্র ‘সব দোষ নন্দঘোষ’-এর ঘাড়ে চাপানোর অপচেষ্টাও চলছে। আওয়ামী লীগের উচ্চপর্যায় থেকে অভিযোগ করা হয়েছে, আইভী ১৬ জানুয়ারি ‘বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিল করেছিলেন।’ একটি দেশের সর্বত্র গণমাধ্যমের সৌজন্যে এসব অভিযোগ এবং সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি ও গুণ্ডামির খবরাখবর প্রকাশিত হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই এখন বন্দরনগরীতে একটি ভীতিকর পরিবেশ বিরাজ করছে। নারায়ণগঞ্জের সিটি করপোরেশন এলাকার জনগণের শান্তি, স্বস্তি এবং নিরাপত্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ‘দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন’ রাজার ধর্ম। এত দিন ধরে সরকার দুষ্টের লালন ও শিষ্টের দমন করছিল বলে- সাধারণ্যের অভিযোগ। নারায়ণগঞ্জের এ ঘটনা এবং আইভীর অনুসৃত গণমুখী অবস্থান থেকে সরকার এবং শীর্ষ নেতৃত্ব কিছু শিখবেন বলে জনগণের প্রত্যাশা।
লেখক : অধ্যাপক, সরকার ও রাজনীতি বিভাগ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Mal55ju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.