বাধা আসবে পেরিয়ে যেতে হবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, নারীদের বর্তমান অবস্থানের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়া। চলার পথে নানা বাধা থাকে, বাধা আসবেই সেই বাধা অতিক্রম করে আমাদের নারীদের এগিয়ে যেতে হবে। নিজেদের অধিকার আদায় করে নিতে হবে। শনিবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এসব কথা বলেন। এদিকে আজ বেলা সাড়ে ১১টায় গণভবন থেকে যশোরে ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি’ পার্কের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রোকেয়া দিবসের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়। নারী উন্নয়নে অবদান রাখার জন্য এ বছর পাঁচ নারী রোকেয়া পদক পেয়েছেন। তাদের হাতে রোকেয়া পদক তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এবার বেগম রোকেয়া পদক পেয়েছেন চিত্রশিল্পী সুরাইয়া রহমান, লেখক শোভা রাণী ত্রিপুরা, সাংবাদিক মাহফুজা খাতুন বেবী মওদুদ (মরণোত্তর), সংগঠক মাজেদা শওকত আলী ও সমাজকর্মী মাসুদা ফারুক। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীদের মেধা নিজেদেরই প্রকাশ করতে হবে, কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকলে হবে না। নিজ গুণেই নারীরা সব ক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান তৈরি করে নিচ্ছে। তিনি বলেন, সমাজে বেগম রোকেয়ার আদর্শের পথ ধরে আমরা আলোর যুগে প্রবেশ করেছি। তার স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথেই আমরা এগিয়ে চলছি। সমাজে নারী-পুরুষের অবদান সমান উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, নারী-পুরুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার মধ্য দিয়েই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে হবে। শেখ হাসিনা বলেন, নারী-পুরুষ একে অপরের পরিপূরক। নারী ছাড়া সমাজ কখনও পরিপূর্ণ নয়। খোঁড়া পা দিয়ে সমাজ কতদূর যেতে পারবে? সবাইকে সমানভাবে এগোতে হবে। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে রাজনৈতিক সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে সরকার প্রধানের আসনে আসীন শেখ হাসিনা অন্য নারীদেরও সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার চরণ ‘বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’ উদ্ধৃত করে বলেন, কথাটা তো বাস্তব। এ ক্ষেত্রে বেগম রোকেয়ার কাজে তার স্বামীর উৎসাহ দেয়া এবং বঙ্গবন্ধুর আন্দোলন-সংগ্রামে পাশে থেকে তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের সহযোগিতার কথাও উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী বলেন, নারীরা পাশে না থাকলে পরে শুধু পুরুষরা সমাজকে গড়ে তুলবে এটা কখনও হয় না। কারণ যে সমাজে নারী-পুরুষ অর্ধেক, সেখানে একটা সমাজকে গড়ে তোলা ও উন্নত করার জন্য সবাইকে সমানভাবে প্রয়োজন। এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।
কিন্তু সেই বাস্তবতাটা স্বীকার করতে অনেক সময় লেগেছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বহু নারীর আত্মত্যাগ, সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করার কথাও বলেন তিনি। নারীদের উচ্চপদে যাওয়ার জন্য রোকেয়ার স্বপ্নের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের জগতে কিন্তু আমরা সেই অন্ধকারের অচলায়তন ভেদ করে আলোর যুগে প্রবেশ করেছি এবং বেগম রোকেয়ার স্বপ্ন পূরণের পথে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এটাই হচ্ছে সব থেকে বড় কথা। বেগম রোকেয়া স্বপ্ন দেখেছিলেন বলেই কিন্তু আজ আমরা এগিয়ে যেতে পেরেছি।প্রধানমন্ত্রী তার জীবনের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরে তার মা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের দৃঢ়চেতা এবং দূরদর্শী চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে আলোকপাত করেন। এ সময় একটি ঘটনা বলতে গিয়ে অশ্রুসজল হয়ে উঠেন তিনি। সেটি ’৭৫-এর ১৫ আগস্টের সেই কালোরাতের ঘটনা। সিঁড়ির ওপর বঙ্গবন্ধুর নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখে তিনি সেখানে দাঁড়িয়ে যান এবং সৈনিকরা তখন তাকে অন্যত্র নিয়ে যাওয়ার উদ্যোগ নিলে তিনি বলেন, তিনি জাতির পিতাকে এখানে ফেলে রেখে কোথাও যাবেন না। প্রধানমন্ত্রী বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে বলেন, তার মা বলেছিলেন- ‘তোমরা তাকে (বঙ্গবন্ধু) গুলি করে মেরেছ, আমাকেও গুলি করে মার, আমি কোথাও যাব না।’ জাতির জনকের কন্যা ও প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মা অন্য সবার মতো সেদিন কিন্তু নিজেকে বাঁচাবার চেষ্টা করেননি।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঐতিহাসিক ৬ দফা আন্দোলন থেকে শুরু করে তার বাবার কারান্তরীণ থাকার সময়ও তার মায়ের বলিষ্ঠ ভূমিকা তখন বিপন্ন জাতিকে পথ দেখিয়েছে। এ সময় শেখ হাসিনা তার সরকারের শাসনামলে দেশের নারী উন্নয়নের চিত্র এবং নারীর ক্ষমতায়নে তার সরকারের নেয়া পদক্ষেপগুলো তুলে ধরেন। দেশে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জাতীয় সংসদ, স্কুল-কলেজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, বিমানবাহিনীর পাইলট থেকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সর্বত্রই নারীদের পদচারণা এবং বিচার বিভাগ, প্রশাসন, তথ্য-প্রযুক্তি, সশস্ত্র বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ বিভিন্ন চ্যালেঞ্জিং পেশায়ও নারীদের কাজের কথা তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। এ ছাড়া জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি-২০১১ প্রণয়ন, মাতৃত্বকালীন ছুটির মেয়াদ বাড়িয়ে ৬ মাস করা, সন্তানের পরিচয়ের ক্ষেত্রে মায়ের নাম লেখা বাধ্যতামূলক করা, সংসদে সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে ৫০ করা, পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ এবং পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) বিধিমালা ২০১৩-এর খসড়া প্রণয়ন করা, বাল্যবিবাহ নিরোধ আইন, ২০১৪-এর খসড়া মন্ত্রিসভায় অনুমোদন করা, যৌতুক নিরোধ আইন-১৯৮০ সংশোধন করে যৌতুক নিরোধ আইন-২০১৫ প্রণয়ন করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।এ ছাড়া নারী উদ্যোক্তাদের স্বল্পসুদে ঋণ দেয়া, ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে (ওসিসি) সেপ্টেম্বর ২০১৫ পর্যন্ত ২৩ হাজার ৮৮৮ জন নারীকে সেবা প্রদান করার কথাও তুলে ধরেন শেখ হাসিনা। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার লক্ষ্যের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, সমাজে একেবারে নিচুস্তরের অবহেলিত যে জনগোষ্ঠী, আমাদের সবার দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো, তাদের ভেতর আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করা এবং তাদেরকে সহযোগিতা করা। সেটা সবাইলে মিলে করলে নিশ্চয়ই এ সমাজ গড়ে উঠবে। বাংলার নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার ১৩৭তম জন্ম ও ৮৫তম মৃত্যুবার্ষিকী ছিল শনিবার। বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। সে সময় সমাজ ছিল নানাবিধ কুসংস্কারে পূর্ণ। রক্ষণশীল মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করে তিনি নারী জাগরণের অগ্রদূতের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ঊনবিংশ শতাব্দীর এ খ্যাতিমান বাঙালি সাহিত্যিক ও সমাজ সংস্কারক ১৯৩২ সালের ৯ ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। রোকেয়া দিবসে নারী সংহতির শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন : রোকেয়া দিবস উপলক্ষে নারী সংহতি শনিবার সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের রোকেয়া বেদিতে শ্রদ্ধাঞ্জলি অর্পণ করেছে। এ সময় সংগঠনের সভাপতি শ্যামলী শীল ও সাধারণ সম্পাদক অপরাজিতা দেবসহ কেন্দ্রীয় নেতারা উপস্থিত ছিলেন। রোকেয়া দিবস পালনের অংশ হিসেবে নারী সংহতির কেন্দ্রীয় কমিটি একটি র‌্যালিসহ রোকেয়া হলে প্রবেশ করে। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সংগঠনের সহসাধারণ সম্পাদক রেবেকা নীলা, সাংগঠনিক সম্পাদক জান্নাতুল মরিয়ম, রাজনৈতিক শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ইকরামুন্নেসা চম্পা, দফতর সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন ডলিসহ কমিটির অন্য নেতারা। ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি’ পার্কের উদ্বোধন আজ : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ যশোরে ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি’ পার্কের উদ্বোধন করবেন। বেলা সাড়ে ১১টায় শেখ হাসিনা তার সরকারি বাসভবন গণভবন থেকে এ সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক উদ্বোধন করবেন। শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে আইসিটি শিল্পের সুষম বিকাশ ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এ পার্ক নির্মাণ করা হয়েছে। পার্কে আধুনিক সব সুযোগ-সুবিধাসহ ১৫ তলা মাল্টি-টেন্যান্ট বিল্ডিং (এমটিবি); আন্তর্জাতিক থ্রি-স্টার মানের আবাসন ও জিমনেসিয়ামের সুবিধাসহ ১২ তলা ডরমিটোরি বিল্ডিং, একটি ক্যান্টিন ও অ্যাম্ফিথিয়েটার, ৩৩ কেভিএ পাওয়ার সাব-স্টেশন; অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল সংযোগ এবং অন্যান্য ইউটিলিটি সার্ভিস রয়েছে। ইতিমধ্যে দেশি-বিদেশি ৪০টি কোম্পানিকে স্পেস বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এ পার্কে প্রায় ৫ হাজার লোকের প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।

No comments

Powered by Blogger.