ক্ষমতাধর দৈত্য নয়, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছিলেন পূর্বপুরুষেরা

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করা রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা বলেছেন, আমাদের দেশে রাজনীতি এখন আর মুক্ত নয়। এটা এখন অতি মাত্রায় বাণিজ্যিক বিষয়ে পরিণত হয়েছে। রাজনীতির চালকের আসনে রয়েছে অর্থ। আর এ অর্থই নির্ধারণ করছে রাজনীতির কর্মধারা ও গন্তব্য। এখন মেধা নয়, ক্ষমতাই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, অদম্য আকাঙ্ক্ষা আর দুর্বার স্পৃহা নিয়ে আমরা একটি সুপার পাওয়ার সেনাবাহিনীর হাত থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিলাম। কিন্তু নির্মম ইতিহাস হলো- আমরা স্বাধীন দেশে নিজেরা নিজেদেরকে নির্মমভাবে পরাজিত করেছি। স্বাধীনতার ৪৬ বছর পরও আমরা কোনো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ করতে পারিনি। নাই কোনো চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স বা ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা। ফলে মানুষ লিপ্ত হচ্ছে ক্ষমতার অপব্যবহারে। নির্বিচারে ক্ষমতার অপব্যবহারের ঔদ্ধত্য দেখিয়ে চলছে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা এখন কুক্ষিগত হয়ে পড়েছে গুটি কয়েক লোকের হাতে। আর ক্ষমতা সংহত করার এই আত্মঘাতী প্রবণতা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ক্ষমতার লোভ প্লেগের মতো। একবার এ রোগ পেয়ে বসলে সব গ্রাস করতে চেষ্টা করে। এরপর প্রধান বিচারপতি লিখেছেন, বলার অপেক্ষা রাখে না এটা আমাদের স্বাধীনতার যুদ্ধের আদৌ কোনো লক্ষ্য বা দর্শন ছিল না। আমাদের পূর্বপুরুষেরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই করেছিলেন, কোনো ক্ষমতাবান দৈত্য তৈরির জন্য নয়। প্রধান বিচারপতি রায়ে লিখেছেন, দেশের মানবাধিকার আজ বিপন্ন, দুর্নীতি বাধাহীন, সংসদ অকার্যকর, কোটি কোটি মানুষ স্বাস্থ্যসেবা থেকে বঞ্চিত। প্রশাসনে অব্যবস্থাপনা চরম আকার ধারণ করেছে। উন্নত প্রযুক্তির কারণে দ্রুত পাল্টাচ্ছে অপরাধের ধরন। জনসাধারণের জীবন ও নিরাপত্তা ক্রমেই হুমকির মুখোমুখি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম নয়। আর এসবের শেষ ফল হলো- সমাজ পঙ্গুত্বের দিকে ধাবিত হওয়া যেখানে ভালো মানুষ আর ভালো স্বপ্ন দেখে না, কিন্তু খারাপ লোকেরা আরো লুটপাটের জন্য বেপরোয়া। এ অবস্থায় নির্বাহী ক্ষমতার অধিকারীরা হয়ে ওঠে দাম্ভিক আর বেপরোয়া। আর আমলাতন্ত্র কখনোই দক্ষতা অর্জনে সচেষ্ট হবে না। ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দাম্ভিকতা দেখানোর ক্ষেত্রে বাধা দেয়ার মতো কোনো নজরদারি বা তদারককারী প্রতিষ্ঠান নেই। এমন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠেনি। নাই ক্ষমতার ভারসাম্য রক্ষার ব্যবস্থা। প্রধান বিচারপতি লিখেছেন এই সীমাহীন চ্যালেঞ্জের মুখেও বিচার বিভাগ তুলনামূলকভাবে স্বাধীন অঙ্গ হিসেবে কোনোমতে পানিতে ডুবতে থাকা অবস্থায় নাক উঁচু করে রাখার লড়াই করে যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে বিচার বিভাগও বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। বিচার বিভাগকে শক্তিশালী না করে বরং নির্বাহী বিভাগ বিচার বিভাগ পঙ্গু করার চেষ্টা করছে। আর এটা হলে ধ্বংসাত্মক পরিণতি ডেকে আনতে পারে। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনও এখনো প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়নি বলে রায়ে উল্লেখ করেছেন প্রধান বিচারপতি।
সংশোধনী : ষোড়শ সংশোধনী-বিষয়ক গতকালের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে- প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ৫২২ পৃষ্ঠার রায় লিখেছেন। এখানে ‘৫২২ পৃষ্ঠা’র স্থলে ‘৩৯৫ পৃষ্ঠা’ হবে।

No comments

Powered by Blogger.