শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত ছয় ঘণ্টা

গেল বছরের ১ জুলাই সকালে রাজধানীর গুলশানে হলি আর্টিজানের দৃশ্য ছিল আতঙ্ক আর উদ্বেগে ভরা। রাস্তায় ছিল সেনাবাহিনীসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাঁজোয়া যান। ক্ষণে ক্ষণে গুলি-গ্রেনেডের শব্দ ভেসে আসছিল। সেসময় বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে খুন করে জঙ্গিরা। এক বছর পর শনিবার একই এলাকায় নামে শোকের ছায়া। নিহতদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানাতে ফুল হাতে সকাল থেকেই ভিড় করেন সব বয়সী মানুষ। সকাল ৭টায় হলি আর্টিজানে গিয়ে দেখা যায়, শোকাহত মানুষ দল বেঁধে সেখানে আসছেন। সবার হাতে ফুল। সকাল ১০টায় বেকারিটির প্রধান গেট খোলার কথা থাকলেও সাধারণ মানুষ সেখানে ভোর থেকেই উপস্থিত হতে থাকেন। তবে তারা তখনই ফুলেল শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ পাননি। তাদের অপেক্ষা করতে হয়েছিল আরও কয়েক ঘণ্টা।
৭টা ২০ মিনিটের দিকে পুলিশ পাহারায় বেকারিতে প্রবেশ করেন ঢাকায় নিযুক্ত জাপানি রাষ্ট্রদূত মাসাতো ওয়াতানাবি। তখনও রাস্তায় সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছিলেন ফুল হাতে নিয়ে। ৭টা ২৯ মিনিটে জাপানি রাষ্ট্রদূতসহ অন্যরা শ্রদ্ধা জানিয়ে বেরিয়ে যান। রাস্তায় মানুষের ভিড় ক্রমেই বাড়তে থাকায় পুলিশ সকাল ৮টার দিকেই সাধারণ মানুষকে শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ দেয়। এরপর মানুষ দলে দলে এসে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শ্রদ্ধা জানানোর বেদিটি ছিল হলি আর্টিজানের বারান্দাতেই। পেছনে টানানো ব্যানারে লেখা ছিল ‘হলি আর্টিজানে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন’। একটি সাজানো টেবিলের ওপর সাদা কাপড়ে ঢাকা ছিল বেদিটি। ৮টা ৫ মিনিটের দিকে ফুল হাতে ভালোবাসা জানাতে আসেন নিহত ইশরাত আখন্দের বান্ধবী আয়শা। শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বেদির কোণে দাঁড়িয়ে মাথা নিচু করে কাঁদছিলেন। জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, ‘ইশরাতের কথা খুব মনে পড়ছে। ১৪ বছরের বন্ধুকে নিমিষেই হারিয়ে ফেললাম। শুধু শ্রদ্ধা নয়, তার কাছে ক্ষমাও চাইতে এসেছি, কারণ তাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি।’ সাড়ে ৯টার দিকে বনানী থেকে আসা দুই তরুণী ফায়জা ও কাকলী কালো পোশাক পরে বেদির পাশে এসে দাঁড়ান। দু’জনেই হাতে থাকা ফুল বেদিতে রেখে নীরবে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করতেই কাকলী বললেন, ঘটনার রাতে আমরা সারা রাত ঘুমাতে পারিনি। সারাক্ষণ ভয়-আতঙ্কে ছিলাম। প্রার্থনা করছিলাম কারোর যেন মৃত্যু না হয়। কিন্তু সকালে হতাহতের খবরে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। তখন ইচ্ছে থাকলেও আসতে পারিনি। আজ এলাম তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। এদিকে হলি আর্টিজানের কেয়ারটেকার ইমরান হোসেন ও কামাল হোসেন বেকারির ভেতর এদিক-ওদিক ঘুরছিলেন। সকাল ১০টার দিকে ইমরান হোসেন জানান, তিনিসহ আরও ৩ জন রোজার শুরু থেকে এ বেকারিতে কাজ করছেন। শুরুতে রাতে ভয় হতো,
এখনও হয় তবে কম। পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন অপর একজন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি জানান, তিনিই এ বেকারিটির নকশা তৈরি করেছিলেন। ধ্বংসপ্রাপ্ত অংশগুলো এখন তিনিই মেরামত করছেন। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে পাশের এক বাসার নূরজাহান নামে এক গৃহকর্মী বেদির খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন। নূরহাজান জানান, ঘটনার রাত ও দিনে তিনি ঘটনাস্থল থেকে বেশ কয়েকটা দূরের বাসায় ছিলেন। সকালে পুলিশের সহযোগিতায় অন্যত্র চলে যান। গুলির শব্দ আর গ্রেনেডের শব্দে বারবার চিৎকার দিয়ে উঠছিলেন তিনি। বললেন, ‘কেমন মায়ের সন্তান তারা, যে মানুষকে মেরে আনন্দ করে। তারা দোজখেও স্থান পাবে না।’ বেলা পৌনে ১১টার দিকে বেদির পাশে নূর হোসেন রাজিব নামে এক ব্যক্তিকে কাঁদতে দেখা যায়। তিনি জানান, টঙ্গী থেকে স্ত্রী শারমীন হোসেন ও এক সন্তান নিয়ে এসেছেন নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। গুলশান এলাকার রিকশাচালক হারুন মিয়ার হাতে ফুল নেই, তবে মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে ছিলেন বেদির খানিকটা দূরে। বললেন, ‘মারামারি ভালো লাগে না। দেশটাকে জঙ্গিরা কী পাইছে। জঙ্গিদের মা-বাবাকেও আটক করা দরকার। জঙ্গিদের চিরতরে শেষ করা দরকার।’ একটু পরে অভিনেতা নাদের চৌধুরীসহ ১০-১২ জন নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। পরে নাদের চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তিনি বেশ কিছুক্ষণ মন খরাপ করে দাঁড়িয়ে থাকেন। ওই সময় তার চোখের কোণে অশ্রু টলমল করছিল। অভিনেত্রী শমী কায়সার হলি আর্টিজান বেকারির দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছিলেন।
জিজ্ঞেস করতেই বললেন, আমরা এমন বাংলাদেশ দেখতে চাই না। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত দেশে কোনো জঙ্গিবাদ-সন্ত্রাসবাদ থাকতে পারে না। দুপুর ১টা ১০ মিনিটে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে আসেন সাবেক তত্ত্বাবধারক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী। তিনি বলেন, শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যেই তো ভূত। মাঝেমধ্যে অনাকাক্সিক্ষতভাবে শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন করা হচ্ছে। কিন্তু এর দ্বারা অসাম্প্রদায়িকতা ও নৈতিকতার শিক্ষা এবং ধর্মান্ধবিরোধী শিক্ষা পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। একইভাবে রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী ও গবেষক ড. চঞ্চল চৌধুরীও বলেন, পরিবর্তন আনতে হবে সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায়। নতুবা জঙ্গি নতুন করে জন্মাবেই। এদিকে দুপুর ১টা ১৩ মিনিটে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টি উপেক্ষা করেই মানুষের ঢল নামে হলি আর্টিজানে। মা-বাবারা তাদের ছোট্ট শিশুকে নিয়ে এসেছিলেন সেখানে। অনেক কিশোর-কিশোরীও এসেছিলেন নিহতদের প্রতি ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা জানাতে। অনেকে এসেছেন কোথায় এ বিভীষিকাময় ঘটনাটি ঘটেছিল, সেটি স্বচক্ষে দেখার জন্য। দুপুর পৌনে ২টায় বৃষ্টি উপেক্ষা করে ২ সন্তানকে নিয়ে মোহাম্মদপুর থেকে আসেন ব্যবসায়ী জিয়াউল করিম। তিনি বলেন, তার বড় বোনের বাসা হলি আর্টিজানের পাশের গলিতে। ঘটনার রাতে বোন ভয়-আতঙ্কে বাসা ছেড়ে তার বাসায় গিয়ে উঠেছিলেন। আজ তিনি সেই স্থানটি দেখতে এসেছেন সন্তানদের নিয়ে। দুপুর ২টায় পুলিশ প্রশাসন হলি আর্টিজনের প্রধান ফটকটি বন্ধ করে দেন। তখনও অনেক মানুষ ফুল হাতে বাইরে অপেক্ষা করছিলেন। ওই সময় ভেতরে বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল লাইভ সংবাদ প্রচার করছিল।

No comments

Powered by Blogger.