নতুন রোগ ইসকিমিয়া : কতটা চিন্তার?

গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় এই রোগের দাপট ক্রমশ বেড়েই চলেছে। আক্রান্ত হচ্ছে হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, পা, ফুসফুস এবং পাচন নালির মতো অঙ্গগুলো। সঠিক সময়ে চিকিৎসা না হলে ঘটে যেতে পারে বড়সড় শারীরিক বিপত্তি। তবে কয়েকটি বিষয়ে সতর্ক থাকলেই এই রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব বলে জানাচ্ছেন ভারতের পিয়ারলেস হসপিটাল অ্যান্ড বি কে রয় রিসার্চ ইনস্টিটিউটের কার্ডিওলজি বিভাগের ক্লিনিক্যাল ডিরেক্টর ডাঃ অঞ্জনলাল দত্ত।
 ইসকিমিয়া কী?
 আমাদের শরীরে বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সঠিকভাবে কাজ করে যাওয়ার জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়। আসলে রক্তের মাধ্যমে প্রত্যেকটি অঙ্গ তাদের প্রয়োজনীয় খাদ্য, অর্থাৎ অক্সিজেন এবং গ্লুকোজ গ্রহণ করে। এবার কোনো কারণে একটি নির্দিষ্ট অঙ্গে রক্ত সঞ্চালন কমে গিয়ে রক্তাল্পতার সৃষ্টি হতে পারে। সহজে বললে, ওই নির্দিষ্ট অঙ্গে রক্ত কম পৌঁছয়। চিকিৎসা পরিভাষায় এমন অবস্থাকেই ইসকিমিয়া বলা হয়ে থাকে। পর্যাপ্ত রক্তের ঘাটতি হওয়ায় ওই অঙ্গের বিভিন্ন জটিলতার সৃষ্টি হয়। মূলত হৃদপিণ্ড, মস্তিষ্ক, পা, ফুসফুস এবং পাচন নালি ইত্যাদি অঙ্গগুলি এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
 কেন হয়?
 এই রোগের মূল কারণ হিসাবে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসের কথা বলতে হয়। এবার অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিসকে সহজে বুঝতে গেলে একটু রক্ত সংবহণ সম্বন্ধে জেনে নেয়া দরকার। আসলে যেমনটা প্রথমেই বলেছিলাম যে আমাদের দেহের প্রতিটি অঙ্গের রক্তের প্রয়োজন হয়। এবার রক্ত দেহের অঙ্গগুলিতে পৌঁছানোর সময় বিভিন্ন ধমনির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। তাই অনায়াসে ধমনিকে রক্ত পরিবহণের রাস্তা হিসাবে দেখা যেতে পারে। এবার অনেক সময় চর্বি জাতীয় পদার্থ এবং কিছু অন্যান্য পদার্থ ধমনির ভিতরের দেয়ালে জমাট বেঁধে উঁচু ঢিপির মতো তৈরি হয়। একে বলে ‘প্লাক’। ধমনির অভ্যন্তরে প্লাক গঠনের ফলে স্বভাবতই অপর্যাপ্ত রক্ত পরিবাহিত হয়। একেই বলে অ্যাথেরোস্ক্লেরোসিস। আর ধমনির পথে বাধা থাকায় অঙ্গের চাহিদা অনুযায়ী রক্তের যোগান না পাওয়ার ফল হল ইসকিময়া।
 কী কী সমস্যা হয়?
 রোগ যে অঙ্গে হয়, তার উপর নির্ভর করে সমস্যা তৈরি হয়। এবার একে একে সেই সকল অঙ্গের সমস্যা সম্বন্ধে জানা যাক।
 হৃদপিণ্ড—হৃদপিণ্ডের করোনারি ধমনির মধ্যে বাধার সৃষ্টি হলে ইসকিমিয়া রোগ হয়। একে বলে ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ। এক্ষেত্রে করোনারি ধমনিতে রক্তপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি হয়। এই কোনো কোনো ক্ষেত্রে করোনারি আর্টারি সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ারও আশঙ্কা থাকে। প্লাকের কারণে করোনারি আর্টারি আংশিক বন্ধ হয়ে গেলে অ্যানজাইনা হয়। অর্থাৎ একটু হাঁটলেই বুকে ব্যথা লাগে, চাপ বোধ হয়, শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা হয়। এক্ষেত্রে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিলে শারীরিক অস্বস্তিবোধ কমে।
করোনারি আর্টারি সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্রামরত অবস্থাতেই বুকে ব্যথা, প্রবল চাপবোধ এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দেখা দিতে পারে। এমনকী হার্ট অ্যাটাক হওয়ার আশঙ্কাও অনেকগুণ বেড়ে যায়। চিকিৎসা পরিভাষায় এমন অবস্থাকে মায়ো কার্ডিয়াল ইনফার্কশন বলে।
 ব্রেন— মস্তিষ্কে এই রোগের দরুন স্ট্রোক হওয়ার আশঙ্কা থাকে।
 পা— পায়ের বিভিন্ন ধমনিগুলিতে প্লাক জমা হওয়ার কারণে রক্ত পরিবহণে সমস্যা সৃষ্টি হয়। এই সমস্যাকে পেরিফেরাল আর্টারি ডিজিজ (পিএডি) বলা হয়। সমস্যা জটিল হলে ক্রিটিক্যাল লিম্ব ইসকিমিয়া হয়। এই রোগ থেকে পায়ের পেশিতে গ্যাংগ্রিন (পচন) হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে শুধু পা নয়, অনেকসময় হাতেও এই সমস্যা হতে দেখা যায়।
 ফুসফুস— ফুসফুসের আর্টারিতে এই সমস্যার দরুন বুকে ব্যথা এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে ভীষণরকম সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। কোনো কোনো সময় ফুসফুসে এই রোগ মারাত্মক আকার ধারণ করতেও সক্ষম। এই সমস্যার নাম অ্যাকিউট পালমুনারি এমবোলিজম।
 পাচননালি— অনেক সময় এই রোগের কারণে পাচননালির দুই মুখ্য অংশ ক্ষুদ্রান্ত্র এবং বৃহদান্ত্রে ছিদ্র সৃষ্টি হয়। এরফলে ক্ষুদ্রান্ত্র বা বৃহদান্ত্রের সেই বিশেষ অংশে পচন ধরার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
 এই রোগের লক্ষণগুলি কী কী?
 কোন অঙ্গে ইসকিমিয়া হয়েছে তার উপর নির্ভর করে লক্ষণ দেখা যায়—
 হৃদপিণ্ড—হার্টে এই রোগ হওয়ার প্রধান লক্ষণ হল বুকে ব্যথা। রোগের তীব্রতা কম হলে শুধুমাত্র হাঁটা-চলার সময় ব্যথা অনুভূত হয়। রোগের তীব্রতা বেশি হলে বিশ্রামরত অবস্থাতেও ব্যথা অনভূত হতে পারে। সাধারণত অ্যানজাইনা বুকের মাঝখানে হয়। মনে হয় বুকের মধে কেউ ওজন চাপিয়ে দিয়েছে। তবে প্রথম প্রথম অ্যানজাইনা হলে ব্যথা সবসময় বুকের মাঝে হয় না। অনেকসময় এই ব্যথা পেটের উপর দিক থেকে আসে, পিঠে, হাতে, চোয়ালের দিকে ছড়িয়ে যায়। তাই অনেকে এই ব্যথার সঙ্গে গ্যাসের ব্যথাকে মিলিয়ে ফেলেন। এখানে একটি সুক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। প্রারম্ভিক পর্বে অ্যানজাইনা মূলত জোরে হাঁটা বা টেনশনের সময় বেশি হয়। আবার একটু বিশ্রাম নিলেই ব্যথা তুলনামূলকভাবে কমে আসে। অন্যদিকে গ্যাসের ব্যথার ক্ষেত্রে এরকম কোনো কমে আসা বা বেড়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা যায় না। আবার হার্ট অ্যাটাক হলে ব্যথা অনেকগুণ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি রোগীর শারীরিক অবস্থারও ভীষণরকম অবনতি হয়। আবার ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্তদের অনেকসময় কোনও রকম ব্যথা ছাড়াই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যায়। এটা একটা বিশেষ সমস্যা যায়। এক্ষেত্রে সতর্ক থাকা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
তবে ব্যথা বাদেও হৃদগতি বৃদ্ধি, একটু শারীরিক কাজকর্মেই শ্বাসকষ্ট, অকারণে ঘাম, ক্লান্তি ইত্যাদি বিশেষ ইঙ্গিতবাহী।
 মস্তিষ্ক— এক্ষেত্রে সবথেকে বড় লক্ষণ হল তীব্র মাথা ব্যথা। পাশাপাশি মাথা ঘোরা, দেহের নড়াচড়ায় সমস্যা, দুর্বলতা, দেহের কোনও একটি পাশে প্যারালিসিস ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
 পা— পায়ে অসারতা, ঠান্ডাভাব, তীব্র ব্যথা, ক্ষত ঠিক না হওয়া ইত্যাদি লক্ষণ ফুটে ওঠে।
 পাচননালি— পেটজুড়ে তীব্র ব্যথা, বমি, রক্তমল, ডায়রিয়া ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।
 কাদের এই সমস্যা হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে?
 ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার, কোলেস্টেরল, স্থূলত্ব (ওবেসিটি) এবং ধূমপানের মতো বিষয়গুলি এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার মুখ্য কারণ।
বয়সের দিক থেকে ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক মানুষদের এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। তবে অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের জন্য এখন ৪০ বছর বা তার নীচের অনেকেই এই রোগে আক্রান্ত হন। আবার স্ত্রী ও পুরুষদের মধ্যে পুরুষরা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। সাধারণত মহিলাদের হরমোনজনিত কারণে মনোপজের আগে হৃদরোগে আক্রান্ত হন না। তবে ডায়াবেটিস রোগে আক্রান্ত হওয়ার দরুন এখন অনেক মহিলাই কম বয়সে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন।
আগে পশ্চিমের দেশগুলিতে এই রোগের প্রকোপ ছিল বেশি। তবে নিজেদের জীবনযাত্রার মান বদলে নিয়ে সেইসব দেশগুলিতে এখন এই রোগ অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। বর্তমানে ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশীয় দেশগুলিতে ইসকিমিক হার্ট ডিজিজের প্রবণতা সবথেকে বেশি। এর মূল কারণ হিসাবে অবশ্যই খাদ্যাভ্যাসের কথা আসবে। এই অঞ্চলের বসবাসরত মানুষ কার্বোহাইড্রেট, ফ্যাট জাতীয় খাদ্য বেশি খান। ফলে এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। পাশাপাশি ডায়াবেটিস, মেটাবলিক সিনড্রোম
(ভুঁড়ি বৃদ্ধি) ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত মানুষ এই অঞ্চলে বেশি থাকায় সমস্যা আরো বেড়ে চলেছে।
 এই রোগের চিকিৎসা কী?
 দেখুন হার্টে এই রোগ হলে চিকিৎসাকে দু’টি ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। ইসকিমিয়ার জন্য প্রাথমিকভাবে অ্যানজাইনা হলে ওষুধের মাধ্যমেই ভালো থাকা যায়। তবে হার্ট অ্যাটাক হলে তিন ঘণ্টার মধ্যে রোগীকে নিয়ে চিকিৎসাকেন্দ্রে পৌঁছাতে হয়। এই সময়টিকে বলে গোল্ডেন টাইম। এই সময়ে প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্লাস্টি করে ধমনিতে সৃষ্ট বাধা সরিয়ে দেওয়া হয়। এতে হৃদপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন নতুন করে শুরু হয়ে যায়। তবে প্রাইমারি অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি করা না গেলে ওষুধের মাধ্যমে রক্তকে গলিয়ে দেওয়া হয়। একে থ্রম্বোলাইটিস থেরাপি বলে। পায়ে এবং ফুসফুসে এই সমস্যা হলেও সেই অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টি করে আর্টারির বাধা মুক্ত করা হয়। তবে এই রোগের কারণে পায়ের সমস্যা বেড়ে গিয়ে থাকলে অনেকসময় অপারেশন করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়ে থাকে। আবার পাচননালির সমস্যার ক্ষেত্রে প্রাথমিক পর্যায়ে ওষুধ প্রয়োগ করা হলেও রোগ গড়িয়ে গেলে অপারেশন করা ছাড়া উপায় থাকে না। পাশাপাশি মস্তিষ্কের ক্ষেত্রে চিকিৎসাটা চলে ওষুধের উপর। দরকার পড়লে আবার অ্যাঞ্জিওপ্ল্যাস্টিও করা হয়ে থাকে।
 রোগ প্রতিরোধের উপায় কী?
 এই রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায় হল জীবনযাত্রায় বদল আনা। এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে খেয়াল রাখুন— খাদ্যের তালিকায় বেশি পরিমাণে ফল, শাক-সবজি রাখুন। তেল খাওয়া কমিয়ে আনুন  নিয়মিত শরীরচর্চা করুন। এতে ওজন কমার পাশাপাশি শরীর সুস্থ থাকবে  ধূমপান থেকে বিরত থাকুন  ডায়াবেটিস, হাই ব্লাডপ্রেশার, হাই কোলেস্টেরল ইত্যাদি রোগ থাকলে প্রথমেই সজাগ হোন। নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এই রোগগুলিকে নিয়ন্ত্রণে আনুন।
সূত্র : ওয়েবসাইট

No comments

Powered by Blogger.