রাজশাহীতে পুলিশ অফিসার্স মেসে এসির লাশ

রাজশাহী মহানগর পুলিশ (আরএমপি) অফিসার্স মেসে শনিবার এক সহকারী কমিশনারের (এসি) লাশ পাওয়া গেছে। তখন জানালার গ্রিলের সঙ্গে গলায় দড়ি বাঁধা, শরীর ঝুলন্ত, তবে সোফায় পিঠের কিছু অংশ ঠেকানো অবস্থায় ছিলেন তিনি। তার নাম সাব্বির আহমেদ সরফরাজ। তিনি রাজপাড়া জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনারের দায়িত্ব পালন করছিলেন। সরফরাজ আত্মহত্যা করেছেন বলে ধারণা করছে পুলিশ। শনিবার ভোর সাড়ে ৫টা পর্যন্ত এসি সরফরাজ ডিউটিতে ছিলেন। ডিউটি শেষে পদ্মাতীরের ওই মেসে ফেরেন। সকাল পৌনে ১০টার দিকে সহকর্মীরা তার খোঁজে দরজায় কড়া নাড়া দিলেও কোনো সাড়াশব্দ পাননি। নিচতলার কক্ষটির জানালা দিয়ে তারা দেখতে পান গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় সরফরাজের দেহ গ্রিলের সঙ্গে আটকে আছে। সরফরাজের বাবা পুলিশের সাবেক ডিআইজি এম ওবাইদুল্লাহ বিকালে ঢাকা থেকে ফেরার পর লাশ সেখান থেকে নামানো হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ময়নাতদন্তের জন্য লাশ রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক বিভাগে নেয়া হয়। সন্ধ্যায় ঘটনাস্থল থেকে বের হয়ে এম ওবাইদুল্লাহ বলেন, ছেলের আত্মহত্যা করার মতো কোনো ঘটনা ছিল না। আরএমপির মুখপাত্র সিনিয়র সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতে খায়ের আলম সন্ধ্যায় যুগান্তরকে বলেন, ময়নাতদন্ত শেষে লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হবে। এ ব্যাপারে আপাতত রাজপাড়া থানায় একটি অপমৃত্যু মামলা হবে। লাশ কিভাবে ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেন, শরীরের তিন ভাগের দুই ভাগ ঝুলানো ছিল নাইনলের দড়িতে।
তবে শরীরের একটি অংশ ছিল সোফার একাংশে। পায়ের কিছু অংশ মাটিতে ঠেকানো ছিল। তবে সেটিকে আত্মহত্যাই মনে হচ্ছে। বাইরে থেকে কেউ তার গলায় দড়ি লাগিয়ে হত্যা করতে পারে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, তার কক্ষের অবস্থান তেমন নয়। আরএমপি সূত্র জানায়, ৩১তম বিসিএস ব্যাচে উত্তীর্ণ হয়ে সাব্বির আহমেদ সরফরাজ এএসপি পদে যোগ দেন। তার গ্রামের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার বাবুপুর গ্রামে। বাবা এম ওবাইদুল্লাহ আরএমপির কমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে দুই বছর আগে অবসরে যান। সূত্র জানায়, এসি সরফরাজের দেহ গ্রিলের সঙ্গে আটকা দেখে সংশ্লিষ্ট সবখানে খবর দেয়া হয়। তাৎক্ষণিকভাবে ছুটে আসেন আরএমপির কমিশনার এম শফিকুল ইসলামসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। তারা লাশ নামানোর প্রস্তুতি নেন। তবে সরফরাজের বাবা পুলিশ কর্মকর্তাদের অনুরোধ করেন, তিনি না পৌঁছানো পর্যন্ত লাশ যেন নামানো না হয়। তিনি প্রকৃত অবস্থায় ছেলেকে দেখতে চান। এরপর দিনভর সরফরাজের লাশ সেভাবেই ছিল। এর মধ্যে রাজশাহী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক দুই বিশেষজ্ঞ ও পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। অন্যদিকে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ অফিসার্স মেসের ভেতরে কোনো সাংবাদিককে যেতে দেয়া হয়নি। প্রধান ফটকের বাইরে দিনভর অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের বিভিন্ন তথ্য দেন আরএমপির মুখপাত্র ইফতে খায়ের আলম। তিনি বলেন, ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর আরএমপির পক্ষ থেকে এসি সরফরাজের মৃত্যু সম্পর্কে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। বিকাল ৫টার দিকে সরফরাজের বাবা ঢাকা থেকে রাজশাহীতে পৌঁছান। তিনি সরাসরি ওই মেসে যান। সঙ্গে পরিবারের সদস্যরাও ছিলেন।
এ সময় এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। ছেলেকে গলায় ফাঁস লাগানো অবস্থায় দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন সরফরাজের বাবা ওবাইদুল্লাহ ও মা ফাতেমা বেগম। পরে আসেন সরফরাজের স্ত্রী সূচনাসহ আত্মীয়স্বজন। সন্ধ্যা ৬টায় লাশ নামানো হয়। সেখানে রাজশাহী জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আশিক ও সিআইডির একটি দলের উপস্থিতিতে সুরতহাল করেন রাজপাড়া থানার ওসি (তদন্ত) গোলাম মোস্তফা। পরে ময়নাতদন্তের জন্য রামেকে নেয়া হয় লাশ। মেস থেকে বের হওয়ার সময় বাবা এম ওবাইদুল্লাহ সাংবাদিকদের সঙ্গে প্রথমে কোনো কথা বলতে রাজি হননি। পরে তিনি বলেন, ‘সরফরাজ অত্যন্ত মেধাবী আর মনোবলসম্পন্ন ছিল। তার আত্মহত্যার কোনো কারণই দেখছি না। তবে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ছাড়া এ ব্যাপারে আর কিছু বলব না।’ সরফরাজের মা ফাতেমা বেগম রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের সাবেক জিএম। তিনি বলেন, ‘আমার সোনার টুকরা এভাবে কেন যাবে- ভাবতে পারছি না। স্ত্রী সূচনাকে দুপুরের পর লাশ দেখতে নিয়ে আসেন আত্মীয়স্বজন।’ তিনি শুধু কেঁদেই গেছেন। কোনো মন্তব্য করেননি। পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে, দুই ভাইয়ের মধ্যে সরফরাজের ছোট ভাই ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তা। সরফরাজ চাকরিজীবনে বগুড়া, জয়পুরহাট ও রাজশাহী মহানগর পুলিশে বিভিন্ন পদে দায়িত্ব পালন করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর করা সরফরাজ বছর চারেক আগে সহপাঠী সূচনাকে বিয়ে করেন। আরিয়া নামে তাদের চার বছরের একটি মেয়ে রয়েছে। সূচনা মেয়েকে নিয়ে রাজশাহী উপশহরে সরফরাজের পরিবারের সঙ্গে থাকেন। সরফরাজ মাঝেমধ্যে ডিউটি শেষে পুলিশ অফিসার্স মেসে গিয়ে বিশ্রাম নিতেন। শনিবারও রাত্রিকালীন ডিউটি শেষে ভোরে পুলিশ অফিসার্স মেসে যান। পারিবারিক সূত্র জানায়, সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে রাজশাহীতেই সরফরাজকে দাফন করা হবে।

No comments

Powered by Blogger.