সুশাসন ছাড়া মুক্তি নেই

সাধারণ নির্বাচনের যদিও এক বছরের বেশি সময় বাকি; কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ইতিমধ্যে নির্বাচন নিয়ে দলীয় রাজনীতিতে ব্যস্ততা শুরু হয়ে গেছে। নিজ দলকে ক্ষমতায় রেখে নির্বাচন করতে সরকারের কোনো দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়। শুধু আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ঠিক থাকলেই হল। নির্বাচনে বিজয় তো তাদের জন্য নিশ্চিত। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন করে উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা যাচ্ছে। তারা নির্বাচনযুদ্ধে নামবেন এবং মাঠ ছাড়বেন না। নেতারা তো সবাই নির্বাচন চাচ্ছেন। কিন্তু সুশাসনের কথা তারা কেউ বলছেন না। অথচ দেশে সুশাসনের রাজনীতিই নেই। বাংলাদেশ আজ ভয়-ভীতি ও নিরাপত্তাহীনতার এক অশুভ দৃষ্টান্তের দেশ। জনগণের নিরাপত্তা নিয়ে না ভাবছে রাজনৈতিক নেতৃত্ব, না তারা পাচ্ছে আইনের শাসনের নিরাপত্তা।
সাধারণ মানুষ আজ সবচেয়ে অসহায় পুলিশের কাছে। এতদিন পর র‌্যাব ও পুলিশের উদ্দেশে সরকার বলছে মানুষ যেন অত্যাচার ও নির্যাতনের শিকার না হয়। যত দোষ নন্দ ঘোষের বললেই হবে না। আমরা দেখতে পাচ্ছি, সরকারকে সম্পূর্ণভাবে পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল থাকতে হচ্ছে। বিচারবহির্ভূত হত্যার শেষ নেই। জনজীবন আতঙ্কিত, কাকে কখন ধরে নিয়ে যাবে। বোঝানো হচ্ছে, সন্ত্রাসীরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে নিজেরাই আত্মহত্যা করে জীবন দিচ্ছে। এরা কোন্ ধরনের সন্ত্রাসী যারা অন্যকে না মেরে ভয়ে নিজে জীবন দিচ্ছে? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, তা যেভাবেই হোক, যদি সহজভাবে গ্রহণ করা হয় তাহলে তো বিচার ব্যবস্থার গুরুত্ব থাকে না। এসব দেখে নিজেদের বিবেক ও দায়িত্ববোধ সম্পর্কেই সন্দেহ হচ্ছে। সুস্থ চিন্তাভাবনারও গুরুত্ব নেই। বিচার বিভাগের প্রতি সরকারের বৈরীভাব সম্পর্কে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বারবার সতর্ক করে দিচ্ছেন। বিনা জামিনে এবং বিনা বিচারে যে কাউকে আটক রাখা এখন স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসিক ব্যাংকের বিরুদ্ধে আনীত ৫৬টি দুর্নীতি মামলার একটিরও বিচার সম্পন্ন হয়নি। এ জন্য বিচার বিভাগও দায়ী। কারণ বিনা জামিনে জেল খাটাতে পারলে দোষী প্রমাণের ঝামেলা গ্রহণের তাগিদ থাকে না। জামিন না দেয়ায় দুর্নীতির মামলার মাধ্যমে কোর্টের সাহায্যে মানুষকে নির্যাতনের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দেশে জনগণের সরকার না থাকলে যে জনগণের দুর্ভোগ অবশ্যম্ভাবী হতে বাধ্য, সেটিই দেখা যাচ্ছে। দূরদর্শিতার অভাব না হলে সরকারই সমাধানের পথ খুঁজত। শান্তিপূর্ণ সমাধান অসম্ভব হতো না। সৎ ও সুযোগ্য নেতৃত্ব পেলে আমরা সবাই মিলে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠন করতে পারতাম এবং সুখ ও শান্তিতে বসবাস করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন তার সবকিছু আমাদের আছে। এ দেশে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ ছিল না, এখনও নেই- এটাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর যদি সত্যিই তার উদ্ভব ঘটে থাকে, রাজনীতির পথেই তা দমন করতে হবে- পুলিশের অস্ত্রশক্তি প্রয়োগ করে নয়। কারণ তারা বিদেশি নয়, এ দেশের সন্তান।
যে কঠিন সত্যটি কিছু লোকের বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে বা তারা বুঝতে চাইছেন না, তা হল ‘এক সাগর রক্তের’ বিনিময়ে আমরা তো পতাকার স্বাধীনতা চাইনি। আমরা চেয়েছি দেশের স্বাধীনতা, দেশের মানুষের স্বাধীনতা। এ স্বাধীনতার জন্য যারা রক্ত দিয়েছে, যারা জীবন দিয়েছে তারা এ দেশের সাধারণ মানুষ এবং তারা শুধু শাসক পরিবর্তন বা পতাকা পরিবর্তনের জন্য রক্ত দেয়নি। রাজা কিংবা সম্রাটরা রাজ্যজয়ের জন্য যে যুদ্ধ করেন, সে যুদ্ধ তো স্বাধীনতা যুদ্ধ নয়। আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধ করেছি স্বাধীনভাবে পরিপূর্ণ বিকাশের জন্য; অধিকার নিয়ে, স্বকীয়তা নিয়ে বাঁচার জন্য। আমাদের লক্ষ্য ছিল গণতান্ত্রিক সুশাসন। জনগণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে গঠন করবে সরকার। আর সেই সরকার প্রতিষ্ঠা করবে আইনের শাসন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাই গণতান্ত্রিক চেতনা। আমাদের নেতানেত্রীদের কাউকেই বুঝতে দেয়া হচ্ছে না দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে শাসনতন্ত্র প্রদত্ত সরকারি ব্যবস্থার গুরুত্ব কী। স্বাধীনতার পরপরই যে শাসনতন্ত্র জনগণের শাসনতন্ত্ররূপে বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন সেটিই তো মুক্তিযুদ্ধের শাসনব্যবস্থার সনদ। এর পবিত্রতা না বুঝে এবং রক্ষা না করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কোথা থেকে বা কাদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে তা-ও আমার বোধগম্য নয়। ভারতে বসে কে কী করেছেন তা আমাদের যতটুকু জানার দরকার ততটুকু জানলেই হল। মুক্তিযুদ্ধে ভারতে যারা ছিলেন, তাদের কারও কারও জ্ঞান-বুদ্ধির চেতনা মুক্তিযুদ্ধের বিষয় হতে পারে না। যারা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন তারা জনগণের নির্বাচিত সরকার মেনেই করেছেন। গণতন্ত্র সুশাসনের পরীক্ষিত একটি ব্যবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্র সেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার দলিল। সেই ঐতিহাসিক শাসনতন্ত্রকে ভেঙেচুরে সম্পূর্ণভাবে বিরাজনীতির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠায় যারা পেছন থেকে মদদ জুগিয়েছেন, তারাই বিরাজনীতিকরণের কাজটি করেছেন। কাউকে দোষারোপ করার জন্য বলছি না।
একনায়কত্বে রাজনীতি থাকে না। ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যভিত্তিক ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা চলে। দেশে রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট তৈরি করে সবাই মিলে দুর্নীতির বাজার বসাবেন, সরকারের কোনো বৈধতা দরকার হবে না, জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা থাকবে না- তাহলেই প্রতিষ্ঠিত হবে উন্নয়নের গণতন্ত্র। আদতে এটিই হচ্ছে, জনগণের গণতন্ত্র হত্যার রাজনীতি বা বিরাজনীতিকরণ। মনে হচ্ছে সরকার উন্নয়নের কাজ নিয়ে এত ব্যস্ত যে পানি উন্নয়ন বোর্ডের গাফিলতি ও দুর্নীতির কারণে সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলের তিন লাখ কৃষক পরিবার পথে বসেছে। ফসল রক্ষার বিভিন্ন প্রজেক্টের বাঁধগুলো একেবারে ভেঙে গেছে লাগামহীন দুর্নীতির কারণে ও জবাবদিহিতার অভাবে। মেট্রোরেল প্রজেক্ট তো এগোতে পারছে না। পদ্মা সেতু পানির নিচে না গেলেই হল। সঠিক নেতৃত্বের অভাবে তদারকিতে অবহেলা রয়েছে। দুর্নীতি তো আছেই। কোনো কোনো অর্থনীতিবিদ টেলিভিশনের টকশোতে বর্তমান সরকারের উন্নয়ন সূচক সম্পর্কে ভুল ধারণা দিয়ে উন্নয়নের আশাবাদ প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন। হাওয়া বদল শুরু হয়েছে। এখন অর্থনীতিবিদরা বলছেন, সঠিক রাজনীতি ছাড়া অর্থনৈতিক উন্নয়ন ফাঁকা বুলি। একজন খ্যাতনামা রাজনীতিবিদ বলেন, ডিসি-১০-এর পাইলট দিয়ে জেট বিমান চালানো যায় না। আসলে এসব শ্রদ্ধেয় জ্ঞানী ব্যক্তি রাজনৈতিক নেতৃত্বের যোগ্যতার কথা ইতিপূর্বে বলেননি। রাজনৈতিক নেতার যোগ্যতা ছাড়াই উন্নতি সাধন করা যায়, তাই তো বলেছেন আগে। নানা ধরনের উন্নয়নের সূচক বানিয়ে দাবি করেছেন দ্রুতগতিতে অর্থনৈতিক উন্নয়ন চলছে। অন্যেরা আমাদের রোল মডেল হিসেবে দেখছে। কেউ আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে পারবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু মূল শাসনতন্ত্রকে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অনুমোদন নিয়ে জনগণের সনদ হিসেবে সংরক্ষিত করে রেখে গেছেন। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে বিজয়ী করে ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রের প্রতি জনগণ পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছে। তাই ১৯৭২ সালের মূল শাসনতন্ত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। সুশাসনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করার শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে।
বাকশাল গঠন এবং বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে জনগণের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সেই অস্বাভাবিক অতীতের গুরুত্ব দিতে আমি প্রস্তুত নই। যা ছিল ব্যতিক্রম, তা ব্যতিক্রমই থাকুক। ১৯৭২ সালের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু নির্বাচনই যথেষ্ট নয়। নির্বাচন মন্ত্রী-মিনিস্টারদের শাসনতান্ত্রিক বৈধতা দেয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায়ও এই শাসনতান্ত্রিক বৈধতা মানতে হবে। সুপ্রিমকোর্টকে শাসনতন্ত্রের রক্ষক হিসেবে গ্রহণ করতে এবং সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকার ব্যাপারে সহনশীল হতে হবে। বিরোধী দল এবং সরকারি দলের একত্রে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা ভাগাভাগির ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রসম্মত নয়। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ভোগের নিশ্চয়তা দিতে হবে। সাংবাদিকদের দলীয় কর্মী করে গণমাধ্যমকে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়া যাবে না। বিচার বিভাগ বা গণমাধ্যম দলীয়করণ করা শাসনতন্ত্রের পরিপন্থী। তাদের স্বাধীন অবস্থান শাসনতন্ত্রস্বীকৃত। জনগণকে বাদ দিয়ে দেশ চালানোর স্বপ্ন বর্তমান যুগের স্বপ্ন নয়, এটা দুঃস্বপ্ন। তাই জনগণের সার্বভৌমত্ব মেনে জনগণ প্রদত্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সফল করার চেষ্টাই হবে আমাদের সবার নাগরিক দায়িত্ব। জনজাগরণ বা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হলে সে স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলা কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। ভিন্ন কোনো রাষ্ট্রের সাহায্য-সহযোগিতায় সে স্বাধীনতা অর্জিত হলে লাভের চেয়ে লোকসানই হয় বেশি। নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকট হয়ে ধরা পড়ে। এ ব্যাপারেও শিক্ষিত সচেতন লোকজন তেমন সতর্কতা অবলম্বনে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা নেতৃত্বকে সঠিক পথে থাকতে সাহায্য করতে ব্যর্থ হয়েছেন। নেতারা শুধু প্রশংসা পেতে অভ্যস্ত হয়েছেন, দায়িত্ব পালনের ব্যর্থতা নিয়ে তাদের মাথা ঘামাতে হয়নি। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবর্তমানে আমাদের স্বাধীনতার চেতনা বাস্তবায়িত করা কঠিন হয়েছে। ভারত থেকে প্রত্যাবর্তনকারীরা নিজেদের যুদ্ধের কাহিনী ও বীরত্ব নিয়ে গর্ব ও আনন্দে বিভোর হয়ে থাকলেন। আর ভাব দেখালেন, তারা বাংলাদেশ জয় করে ফিরেছেন। তাদের জন্যই দেশ স্বাধীন হয়েছে। শুধু যদি যুদ্ধই আমাদের স্বাধীনতার মূলকথা হয়, তাহলে তো ভারতই সবচেয়ে বেশি কৃতিত্ব দাবি করবে।
সে ক্ষেত্রে জনগণের সুদীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম, লাখ লাখ লোকের জীবনদান তাৎপর্য হারাবে, অর্থহীন হয়ে পড়বে। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতা অর্জিত হতে না হতেই স্বাধীনতাকে অর্থবহ করে তোলার মতো যোগ্য ও পরীক্ষিত নেতাদের আমরা হারিয়েছি। সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে আমাদের দেশটি নির্মম ও নিষ্ঠুর রাজনৈতিক কুরুক্ষেত্রে পরিণত হয়েছিল। আর এ কুরুক্ষেত্র করে তোলার খেলায় জঘন্যতম ভূমিকা পালন করেছে পাকিস্তান। পাকিস্তানি সামরিক সরকারের সদিচ্ছা থাকলে শেষ মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথা বলে অনাকাক্সিক্ষত যুদ্ধ শেষ করা যেত। আমরাও স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও ঐতিহ্য অটুট থাকত। বঙ্গবন্ধু তো পাকিস্তানি জেলে বন্দি ছিলেন। বঙ্গবন্ধুও হয়তো এ আশাই করেছিলেন, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী অবস্থা বেগতিক দেখলে তার সঙ্গে কথা বলবে। কিন্তু পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ করা শ্রেয় মনে করল! কিছু লোকের ক্ষমতায় থাকা নিশ্চিত করার স্বার্থে একটি কথা প্রায়ই উচ্চারিত হতে শুনছি এবং আমাকেও দোষারোপ করা হয়ে থাকে যে, কেয়ারটেকার সরকারে থাকতে দুই নেত্রীকে বাদ দিয়ে আমি বিরাজনীতিকরণের রাজনীতি দেশে চালু করতে চেয়েছি। অর্থাৎ সামরিক বাহিনীর শাসন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছি। যাদের রাজনীতি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই অথচ রাজনৈতিক নেতা সাজতে হবে, তাদের পক্ষে সবকিছুই বলা সম্ভব। তাদের ব্যক্তিপূজার রাজনীতি নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির প্রয়োজনে। আব্বা বলতেন, মাথাটা খুলে রেখে কথা বলা হচ্ছে। শহীদ বুদ্ধিজীবীদের অবর্তমানে কেউ কেউ বলতে চেয়েছেন, দেশে বুদ্ধিজীবী বলতে কেউ আর থাকল না। যারা এ কথা বলতে পারেন, রাজনীতিতে নেতৃত্বের পরিবর্তন হওয়া মানে বিরাজনীতিকরণ, তারা তো রাজনীতিই বোঝেন না। বাকসর্বস্ব ফাঁকা বুলি কপচানো রাজনীতি নয়। রাজনীতি যারা করেন, তারা কেউ কারও চাকরি করার জন্য তা করেন না। রাজনীতির একটি বড় দিক হল নেতৃত্বের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা- রাষ্ট্র পরিচালনায় নতুন এবং যোগ্য নেতৃত্বের প্রতিষ্ঠা। যারা বলেন, দুই নেত্রীর পরিবর্তন হলে রাজনীতি থাকবে না, তারা আসলে রাজনৈতিক বিচারে এতিম। সুশাসনের জন্য রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকলে একশ্রেণীর আমলা লাভবান হন।
আর লাভবান হন দুর্নীতিপরায়ণ, সুবিধাবাদী সুযোগ সন্ধানীরা। সরকার চালানোর চাবি থাকে ঝানু আমলাদেরই হাতে। তাদের কাছে রাস্তাঘাট, সেতু, ফ্লাইওভার ইত্যাদি প্রজেক্টের কাজ করাই রাষ্ট্র পরিচালনা। আইনের শাসন, জনগণের অধিকার, জনগণের কাছে সরকারের দায়বদ্ধতা কিংবা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, সরকারি কর্মকাণ্ডের স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ইত্যাদি তো আমলাদের শিক্ষা ও অনুশীলনের বিষয় নয়। বিরাজনীতিকরণের কাজটি তো জনবিচ্ছিন্ন সরকারই করে থাকে। পার্লামেন্টের কাছে জবাবদিহিতা ঝামেলার ব্যাপার। সরকার পরিবর্তন তো তাদের কাছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। একই সরকারের একই নেতৃত্ব তাদের কাছে সুবিধাজনক। আমলাদের দোষ দিচ্ছি না। তারা কোনো গণতান্ত্রিক মানসিকতার রাজনীতি করতে চাকরিতে যোগ দেননি। তারা ক্ষমতাসচেতন। তাদের ওপর নির্ভর করে স্বৈরশাসকরা সরকার পরিচালনায় সাহসী হন। আওয়ামী লীগ প্রথমবার পূর্ব পাকিস্তানে সরকার গঠনের পর মানিক মিয়া রাজনৈতিক নেতাদের সতর্ক করতে গিয়ে যে লেখাটি লিখেছিলেন তার শিরোনাম ছিল ‘পল্টন থেকে সেক্রেটারিয়েট’। তিনি বোঝাতে চেয়েছিলেন, আন্দোলনের কার্যক্রম চালানোর শিক্ষা সরকার চালানোর শিক্ষা নয়। সরকার চালানোর জন্য বাস্তবভিত্তিক জ্ঞান-বুদ্ধি অর্জনের উপদেশই তিনি দিতে চেয়েছিলেন।
ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন : আইনবিদ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ

No comments

Powered by Blogger.