নতুন ভ্যাট আইনে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হবে

১ জুলাই থেকে কার্যকর হতে যাওয়া নতুন আইনে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ রাখা হলে সার্বিক মূল্যস্ফীতি বাড়বে। এতে পণ্য ও সেবার দাম বাড়বে, চাহিদা কমবে। তখন বাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে শিল্পের উৎপাদনও কমে আসবে। যার প্রভাব পড়বে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগের ওপর। কারণ ভোক্তার চাহিদা কমলে নতুন বিনিয়োগ আসবে না। সার্বিকভাবে নতুন ভ্যাট আইন অভ্যন্তরীণ অর্থনীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করবে। ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সম্মেলন কক্ষে শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে সংগঠনটির সভাপতি আবুল কাশেম খান সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে নতুন ভ্যাট আইন অর্থনীতিতে কি প্রভাব ফেলবে তা তুলে ধরেন। আসন্ন বাজেট উপলক্ষে এ সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। ডিসিসিআইর মতে, নতুন আইনে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার রাখা হলে অনেক পণ্যের দাম বাড়বে। তাই ভ্যাট হার ৭ শতাংশ হওয়া উচিত। এতে মূল্যস্ফীতি হবে না। সরকার রাজস্ব আয় কম হবে মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে বাড়বে। কারণ তখন ভোক্তার চাহিদা বাড়বে। অভ্যন্তরীণ কেনাকাটা বাড়লে রাজস্ব আদায় বাড়বে। উদ্যোক্তারা নতুন নতুন পণ্য ও সেবা উৎপাদনে বিনিয়োগ করবেন।
পাশাপাশি ভ্যাট ইকোসিস্টেম সৃষ্টি করতে পারলে ছোট ব্যবসায়ীরাও ভ্যাট দিতে উৎসাহিত বোধ করবেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, সরকার চাচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশ থেকে ৮ শতাংশে নিয়ে যেতে। এজন্য বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ জিডিপির ২৯ শতাংশ থেকে ৩৩ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। কিন্তু ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের পর পণ্যমূল্য বেড়ে যাবে। এতে অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগ চাপের মধ্যে পড়বে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সব আইনই ভালো। কিন্তু বাস্তবায়নে গিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয়। ব্যবসায়ীরা নতুন ভ্যাট আইনের বিপক্ষে নন। সবাই চান ১ জুলাই থেকেই আইন বাস্তবায়ন হোক। তবে তার আগে প্রতিবন্ধকতাগুলো দূর করতে হবে। এনবিআর (জাতীয় রাজস্ব বোর্ড) থেকে বলা হচ্ছে, নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন হলে ব্যবসা খরচ কমবে। তবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট হার রাখা হলে ব্যবসা ব্যয় কমবে বলে মনে হয় না। পাশাপাশি ভ্যাট আদায় পদ্ধতি নিয়েও ঝামেলা তৈরি হতে পারে। সর্বোপরি ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের প্রভাব মূল্যায়ন (ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট) করা দরকার। অপর এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নতুন আইন কার্যকর হলে ১ হাজার ৩৩৯টি পণ্যের ওপর সম্পূরক শুল্ক উঠে যাবে। এতে স্থানীয় শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সম্পূরক শুল্ক শুধু উঠিয়ে দিলেই হবে না স্থানীয় শিল্প সুরক্ষার বিষয়টি ভাবতে হবে। ভারতের মতো এন্টি-ডাম্পিংসহ সব ধরনের ব্যবস্থা মাথায় রাখতে হবে। তিনি আরও বলেন, আইন তৈরির সময় কোন পণ্যের সম্পূরক শুল্ক উঠিয়ে নেয়া হবে, আর কোন পণ্যে সম্পূরক শুল্ক থাকবে তা নিয়ে চেম্বারের মতামত নেয়া হয়নি। সংবাদ সম্মেলনে আসন্ন বাজেটে আয়কর, ভ্যাটসংক্রান্ত প্রস্তাব এবং অবকাঠামো, জ্বালানিসহ বিনিয়োগের প্রতিবন্ধকতাগুলো তুলে ধরা হয়। এ সময় উপস্থিত ছিলেন- ডিসিসিআইর ঊর্ধ্বতন সহ-সভাপতি কামরুল ইসলাম, পরিচালক আসিফ এ চৌধুরী, হুমায়ন রশিদ, ইমরান আহমেদ প্রমুখ। ডিসিসিআই মনে করে, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশে উন্নীত করার মতো পর্যাপ্ত অবকাঠামো নেই। কাক্সিক্ষত প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাইলে জিডিপির ৫ শতাংশ অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করতে হবে।
সে হিসাবে প্রতি বছর ২০ থেকে ২২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ দরকার। এক্ষেত্রে অর্থায়নের জন্য অনুন্নয়ন ব্যয় হ্রাস, বন্ড মার্কেট, দেশি-বিদেশি পুঁজিবাজার থেকে অর্থ সংগ্রহ করা যেতে পারে। আগামী বছরকে অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের বছর ঘোষণা দেয়া যেতে পারে। যার ওপর ভিত্তি করে মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এছাড়া জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাজেটে বরাদ্দ বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে ডিসিসিআই সভাপতি বলেন, শিল্পায়ন ত্বরান্বিত করার এনার্জি রোডম্যাপ প্রণয়ন করা উচিত। কারণ বর্তমানে যেভাবে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে তা অব্যাহত থাকলে ২০২৩ সালের মধ্যে গ্যাসের মজুদ শেষ হয়ে যাবে। পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে শিল্পে এলএনজি ব্যবহারের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেটি শিল্পের জন্য ব্যয় সাশ্রয়ী হবে না। এর পরিবর্তে নিজস্ব কয়লার ব্যবহার বাড়ানো যেতে পারে। কারণ এখনও কয়লা উত্তোলন শুরু হয়নি। মাটির নিচে সর্বোৎকৃষ্ট মানের ৭৫ বছর ব্যবহারের মতো কয়লার রিজার্ভ আছে। কয়লা নীতি চূড়ান্ত করে স্থানীয় কয়লা উত্তোলনকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। এ জন্য বাপেক্সের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে বাপেক্সকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত করা উচিত। গ্যাসের নতুন কূপ খননে টুডি ও থ্রিডিভিত্তিক সিসমিক জরিপ আরও করা উচিত।
আয়কর : ২০১৭-১৮ অর্থবছরের বাজেটে ব্যক্তিশ্রেণীর করমুক্ত আয়ের সীমা আড়াই লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে সাড়ে ৩ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে ডিসিসিআই। পাশাপাশি সর্বোচ্চ করহার ৩০ শতাংশের পরিবর্তে ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা, সারচার্জের সীমা সোয়া ২ কোটি থেকে বাড়িয়ে ৫ কোটি নির্ধারণ, কর্পোরেট কর হার ৩৫ শতাংশ থেকে নামিয়ে ৩০ শতাংশ ও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ক্ষেত্রে ২৫ শতাংশ থেকে ২২ দশমিক ৫ শতাংশ, পারকুইজিট সীমা সাড়ে ৪ লাখ থেকে বাড়িয়ে ৬ লাখ টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
এছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ের করদাতাদের সন্তানের শিক্ষা খরচকে করের আওতামুক্ত রাখার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। এক সন্তানের জন্য প্রাথমিক শিক্ষা থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত ৬০ হাজার টাকা করে দুই সন্তানের জন্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা করের আওতার বাইরের রাখা উচিত বলে মনে করে ডিসিসিআই। পাশাপাশি ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত স্মার্টফোন, ট্যাবসহ সব মোবাইল ফোন কেনাকে বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করার প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। ডিসিসিআই সভাপতি আবুল কাশেম খান বলেন, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশে কর-জিডিপি অনুপাত সর্বনিন্ম। মোট জনসংখ্যার দশমিক ৬৭ শতাংশ আয়কর রিটার্ন দাখিল করে। এর মধ্যে আবার ৭৮ দশমিক ২ শতাংশ করদাতাই রাজধানীকেন্দ্রিক। এনবিআরকে করজাল বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ নিতে হবে। প্রয়োজনে ঢাকার বাইরের করদাতাদের করহারে ছাড় দিতে হবে।
ভ্যাট : ডিসিসিআই বলছে, নতুন ভ্যাট আইনের ৮৩, ৯০, ৯১ ও ৯৯ ধারায় রাজস্ব কর্মকর্তাদের সীমাহীন জুডিশিয়াল ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। এগুলো দ্রুত সংশোধন করা উচিত। তা না হলে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার হতে পারেন। পাশাপাশি খুচরা ব্যবসায়ীদের ৫০ লাখ টাকা টার্নওভার পর্যন্ত ভ্যাট অব্যাহতি দেয়া, শিল্পের টার্নওভার ৮০ লাখ থেকে বাড়িয়ে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা নির্ধারণ, ভ্যাট নিবন্ধনকারী ব্যবসায়ীদের সরকারি খরচে ইসিআর (ইলেকট্রুনিক ক্যাশ রেজিস্টার) মেশিন সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি।
শুল্ক ও অন্যান্য : তৈরি পোশাক শিল্পের ইলেকট্রিক ও ইলেকট্রুনিক্স সামগ্রী ডিউটি ফ্রি আমদানি, নতুন গাড়ি আমদানি উৎসাহিত করতে শুল্ক হ্রাস এবং ঘন ঘন এসআরও পরিবর্তন না করার সুপারিশ করেছে ডিসিসিআই। এছাড়া প্রশাসনিক পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘ন্যাশনাল ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড মনিটরিং অ্যাডভাইসরি অথরিটি (এনআইডিএমএএ)’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে সংগঠনটি। যার কাজ হবে এডিপি ও অন্যান্য উন্নয়ন প্রকল্পের কার্যক্রম মনিটরিং করা।

No comments

Powered by Blogger.