হাওরে হাহাকার: ত্রাণ পাননি ৮০ বছরের বৃদ্ধা

‘টাউনে কাম করে ইজারা নিয়া দেড় কেদার (৩০ শতাংশে এক কেদার) ক্ষেত করছিলাম। কিচ্ছু নাই। সব শেষ হইয়া গেছে। অহন কার ঘরে যাইমু, কিতা খাইমু। এক পরিবারে তিনজন। আমার খোঁজখবর কেউ নেয় না। সরকারি সাহায্যের একগুটা চাউলও পাইছি না। খালি হুনছি, মানুষ সাহায্য পায়।’ গরুর গোবর কুড়াতে এসে অঝরে চোখের পানি ফেলছিলেন আর এমন দুর্দশার কথা জানালেন ৮০ বছরের বৃদ্ধা পরশমণি। বাড়ি বানিয়াচং উপজেলার সুবিদপুর গ্রামে। মেয়ে পারুলের সংসারে থাকেন তিনি। এ পরিবারেই রয়েছে তার একমাত্র নাতি। সে এখন অন্যের দোকানে কাজ নিয়েছে সংসারের অন্ন জোগাতে। গোবর কুড়াতে এসেছিলেন আতুকুড়া গ্রামের সুরবালা। তিনি জানান, ২-৩ কেদার জমি ছিল। সব পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন সন্তানদের খাওয়ানো, পড়ানো নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তিনি। চালত নয়ই, সরকারি কোনো সহায়তাই তিনি পাননি বলে জানান। ভাটিপাড়া গ্রামের কালিপদ সরকার জানান, ১৬ কেদার জমি করেছিলেন তিনি। সব পানিতে তলিয়ে গেছে। কিছুই নেই বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিৎকার করে বলেন, কেউ আমাদের খবর নেয়নি। কোনো সাহায্য তো নয়ই। আর বিজয়পুর গ্রামের রজব আলী জানান, ঋণ নিয়ে ৬-৭ কেদার জমি করেছিলেন। উপজেলা চেয়ারম্যান কখনই তাদের খবর নেননি।
দেখতেও যাননি বলে তিনি অভিযোগ করেন। একই অভিযোগ করেন সুবিদপুর এলাকার কৃষকরাও। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান শেখ বশির আহমেদ জানান, প্রতিনিয়তই তিনি হাওরবাসীর খবর নিচ্ছেন। দিনরাত হাওরে ত্রাণ বিতরণ করছেন। এসব ছবি ফেসবুকেও তিনি দিচ্ছেন। তবে সব জায়গায় যাওয়ার সুযোগ হয় না বা সম্ভবও নয় জানিয়ে বলেন, আমি প্রতিদিনই হবিগঞ্জে যাতায়াত করি। আসা যাওয়ার পথে সুবিদপুরের মানুষকে দেখি। ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে তিনি জানান, এখানে ২৫ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মাঝে হেক্টরপ্রতি ২ জন কৃষক ধরা হলে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকের সংখ্যা হবে ৫০ হাজার। ত্রাণের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহ জানান, তার উপজেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছিল। এর মধ্যে প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির ধান পানিতে তলিয়ে গেছে। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের জন্য এরই মধ্যে ৫০ মেট্রিক টন চাল এসেছে। তা বিতরণও করা হচ্ছে। যারা বেশি দরিদ্র তাদের আগে দেয়া হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে ত্রাণ দেয়া হবে। সুবিদপুর ইউপি চেয়ারম্যান আবুল কাশেম চৌধুরী জানান, তার ইউনিয়নে প্রায় তিন হাজার তিনজন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এর মধ্যে ত্রাণ মিলেছে মাত্র এক হাজার একজনের জন্য। ফলে যেসব কৃষক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এবং দরিদ্র তাদেরই আগে দেয়া হচ্ছে। অন্যদের বিষয়ে বিভিন্ন দফতরে যোগাযোগ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, আমি তালিকাটি শুধু মেম্বার নয়, প্রতিটি গ্রামের সাধারণ মানুষকে দিয়েই সমন্বয় করছি। কারণ সাধারণ মানুষের তালিকাটি পক্ষপাতহীন হবে বলে আমি মনে করি।
সরেজমিন বানিয়াচংয়ের কয়েকটি হাওর ঘুরে জানা যায়, এ উপজেলার প্রায় সব গ্রামের মানুষই কৃষিনির্ভর। জেলার সবচেয়ে বড় বড় হাওরও এ উপজেলায়ই। এসব হাওরের অধিকাংশ এলাকায়ই বছরে মাত্র একটি ফসল হয়। বোরো ফসলই তাদের একমাত্র অবলম্বন। এ মৌসুমে যে ফসল মেলে তা শুধু বানিয়াচং নয়, জেলার চাহিদা মিটিয়ে অন্য জেলারও চাহিদা পূরণ করে। এ ফসল বিক্রি করেই উপজেলার মানুষের বছরের খরচ মেটে। কিন্তু এ বছর প্রথম দফার বৃষ্টিপাতে খুব বেশি নষ্ট না হলেও দ্বিতীয় দফার বৃষ্টিপাতে সব তলিয়ে গেছে। চৈত্রের মাঝামাঝি কাঁচা, আধাপাকা এসব ধান পানিতে তলিয়ে যায়। টানা কয়েক দিন ধরে পানিতে তলিয়ে থাকার কারণে এসব ধানে পচন ধরে। অনেক স্থানে পচা ধান, আধা পচা ধান তুলে আনছেন কৃষকরা। গবাদিপশুকে খাওয়ার উদ্দেশ্যেই তারা এসব নিয়ে আসছেন। কেউবা আবার মন মানছে না তাই হাওরে গিয়ে পানিতে নেমে ধান হাতিয়ে দেখছেন। প্রায় জায়গায়ই ক্ষতিগ্রস্ত এসব কৃষকের মধ্যে ত্রাণের জন্য হাহাকার দেখা দিয়েছে। অনেকেই আবার মন বুঝাচ্ছেন আল্লাহ নিয়েছেন, আল্লাহই খাওয়াবেন বলে। মাছ খেতে ভয় পাচ্ছেন জগন্নাথপুরের মানুষ : জগন্নাথপুরে মাছ না খাওয়া ও না ধরার জন্য নিষেজ্ঞা প্রত্যাহারের পরও দেশীয় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ খেতে এখনও ভয় পাচ্ছেন অধিকাংশ জনসাধারণ। মাছ বাজারগুলোতেও তীব্র সংকট দেখা গেছে দেশীয় প্রজাতির মাছের। শনিবার উপজেলা সদরের জগন্নাথপুর বাজার ঘুরে দেখা যায়, স্থানীয় প্রজাতির কোনো মাছ নেই বললেই চলে। ইলিশ মাছ ও জাটকা বেশি পরিমাণে দেখা গেছে। তবে ফিশারির মাছ বেশি পরিমাণে রয়েছে বাজারে। উপায় না পেয়ে কেউ কেউ ফিশারির মাছ কিনছেন। তাও আবার বেশি দামে। স্থানীয় জাতের মাছের সংকট দেখা দেয়ায় দাম বেড়ে গেছে ফিশারি মাছের। জগন্নাথপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা ওয়াহিদুল আবরার জানান, জগন্নাথপুরের হাওরের পানিতে অ্যামোনিয়া গ্যাস কমে গেছে। পানিতে অক্সিজেন স্বাভাবিক মাত্রায় আসছে।
এখন থেকে মাছ খাওয়া ও ধরা যাবে। গোলাপগঞ্জে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা পাচ্ছেন ১ কেজি চাল : বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত সিলেটের গোলাপগঞ্জের অসহায় লোকেরা তেমন ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। সরকারিভাবে যে সহযোগিতা করা হচ্ছে তা খুবই অপ্রতুল। ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে এক-তৃতীয়াংশ ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। এসব ক্ষতিপূরণ বণ্টন করতে জনপ্রতিনিধিরাও পড়েছেন মহাবিপাকে। ক্ষতিগ্রস্ত লোকজন বেসরকারি সাহায্য-সহযোগিতা পাচ্ছেন না। এর মধ্যে সরকারিভাবে ইউনিয়নওয়ারি তালিকা একসঙ্গে মাসে ৩০ কেজি চাল ও ৫০০ টাকা (গড়ে প্রতিদিন এক কেজি করে চাল) করে দেয়া হচ্ছে। এলাকাবাসী বলছেন, ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় এ সাহায্য এক-তৃতীয়াংশের কম লোক পাচ্ছেন। শরিফগঞ্জ ইউপি চেয়ারম্যান এমএ মুহিত হিরা জানান, এ ইউনিয়নে ক্ষতিগ্রস্তদের তুলনায় সরকারি সাহায্য চার ভাগের এক ভাগের চেয়ে কম। এগুলো কিভাবে বণ্টন করব ভেবে পাচ্ছি না। ছাতকে শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে নিঃস্ব এক পরিবার : এক পরিবারে সাতটি মহিষের মৃত্যুর ঘটনায় শেষ সম্বলটুকুও হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছেন কৃষক। নাইদার হাওরের পানিতে ডুব দিয়ে বিষাক্ত খাবার খাওয়ায় এক পরিবারের সাতটি মহিষ মারা যায়। শুক্রবার রাতে ছাতক উপজেলায় নোয়ারাই ইউনিয়নের বাতিরকান্দি গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। বাতিরকান্দি গ্রামের মৃত আবদুল কাহার-কালা মিয়ার ছেলে লিলু মিয়ার একমাত্র সম্বল ছিল সাতটি মহিষ।

No comments

Powered by Blogger.