যেভাবে ট্রাকচাপায় হত্যা করা হয় খোদেজাকে

ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের হেমায়েতপুর থেকে পাঁচ কিলোমিটার দূরে ঝাউচর গ্রাম। সাভার উপজেলার তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের এই গ্রামে চামড়া শিল্পনগরের পাশেই নুরু গাজীর বাড়ি। বাড়ির পাশেই পূর্ব-পশ্চিমে লম্বা তাঁদের পারিবারিক রাস্তা। এই রাস্তার ওপরই ট্রাকচাপা দিয়ে খোদেজা বেগমকে হত্যা করেন মীর হোসেন, যে ঘটনায় গত সোমবার আদালত তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। এই রায়ের পরপরই পরিবহন শ্রমিকেরা দেশজুড়ে আন্দোলনের নামে মানুষকে চরম ভোগান্তির মধ্যে ফেলেন। টানা ২৪ ঘণ্টারও বেশি একধরনের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলার পর গতকাল বুধবার তা প্রত্যাহার করেন শ্রমিকেরা। স্থানীয় লোকজন এবং ওই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শীরা গতকাল প্রথম আলোকে বলেছেন, বসতবাড়ি ঘেঁষা রাস্তায় বালুবোঝাই ট্রাক চলাচলে সমস্যা হওয়ায় বালু পরিবহনে বাধা দেওয়ার কারণেই নুরু গাজী ও তাঁর স্ত্রী খোদেজার ওপর ট্রাক চালিয়ে দেন মীর হোসেন। এ সময় নুরু গাজী লাফ দিয়ে বাঁচলেও প্রাণ হারান খোদেজা। স্থানীয় ব্যক্তিদের অভিযোগ, মীর হোসেন মাদকাসক্ত ছিলেন এবং তিনি আরেকটি হত্যার এজাহারভুক্ত আসামি। অবশ্য মীর হোসেনের পরিবারের দাবি, তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি মাদকাসক্তও ছিলেন না। ঘটনার সূত্রপাত যেভাবে  ২০০৩ সাল। তখনো গড়ে ওঠেনি সাভারের চামড়া শিল্পনগর। এলাকার প্রভাবশালী কয়েক ব্যক্তি তখন নদী থেকে বালু কেটে বিক্রি করতেন। মীর হোসেন ট্রাকে করে ওই বালু পৌঁছে দিতেন ক্রেতাদের বাড়ি ও জমিতে। এ জন্য মীর হোসেন নিয়মিত নুরু গাজী ও তাঁর পরিবারের ব্যক্তিগত রাস্তা ব্যবহার করতেন। বসতবাড়ি ঘেঁষা ওই রাস্তায় বালুবোঝাই ট্রাক চলাচলের কারণে নুরু গাজী ও তাঁর প্রতিবেশীদের সমস্যা হচ্ছিল। এ কারণে শুরু থেকেই তাঁরা বালু পরিবহনে বাধা দিয়ে আসছিলেন। কিন্তু মীর হোসেন বাধা মানেননি। নুরু গাজীর ছেলে আনোয়ার হোসেন বলেন, বালু পরিবহনে বাধা দেওয়ায় মীর হোসেন তাঁদের নানাভাবে হুমকি দিয়ে আসছিলেন।
সেদিন যা হয়েছিল নুরু গাজী বলেন, তাঁদের পারিবারিক রাস্তা ব্যবহার করায় তিনি ও তাঁর প্রতিবেশী সলিম মিয়াসহ অন্যরা ট্রাক চলাচলে বাধা দেন। মীর হোসেন এতে ক্ষিপ্ত হয়ে সলিম মিয়ার ছোট মেয়ে লিপি আক্তারকে তুলে নেওয়ার হুমকি দেন। বিষয়টি জানার পর ২০০৩ সালের ২০ জুলাই বালুবোঝাই ট্রাক নিয়ে যাওয়ার সময় তিনি ও তাঁর স্ত্রী খোদেজা বেগম ট্রাকের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাধা দেন। এ সময় তাঁরা মীর হোসেনের কাছে বাধা উপেক্ষা করে ট্রাকে বালু পরিবহন করা ও লিপিকে তুলে নেওয়ার হুমকির কারণ জানতে চান। এ নিয়ে তর্কবিতর্কের একপর্যায়ে মীর হোসেন তাঁদের ওপর দিয়ে ট্রাক তুলে দেন। তিনি লাফ দিয়ে রাস্তার দক্ষিণ পাশে যেতে পারলেও তাঁর স্ত্রী ওই ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে মারা যান। একই ধরনের বর্ণনা দিলেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সলিম মিয়া। তিনি বলেন, ওই সময় তিনি ও নুরু গাজী আর স্থানীয় লোকজন ট্রাকসহ মীর হোসেনকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেন। ঝাউচর গ্রামের শাহাবুদ্দিন মাস্টার অভিযোগ করেন, মীর হোসেন ছিলেন মাদকাসক্ত। বেশির ভাগ সময় তিনি মদ্যপ অবস্থায় গাড়ি চালাতেন। তাঁর আচরণও ছিল উচ্ছৃঙ্খল। একই গ্রামের মুজাহারুল ইসলাম বলেন, নার্গিস আক্তার নামে এক গৃহবধূ হত্যার এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন মীর হোসেন। নার্গিসের মা শাহানাজ বেগম অভিযোগ করেন, পারিবারিক কলহের জেরে ১৯৯৭ সালে মীর হোসেন, নার্গিসের স্বামী ওসমান গণিসহ কয়েকজন মিলে তাঁর মেয়েকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। ওই মামলায় ওসমান গনির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হলেও সাক্ষীর অভাবে অন্যরা খালাস পেয়ে যান।
মীর হোসেনের পরিবার যা বলল ঘটনার দিন ট্রাকে শ্রমিকের কাজ করছিলেন মীর হোসেনের ভাই ইনতাজ আলী। তিনি বলেন, নুরু গাজী ও তাঁর স্ত্রী খোদেজা বেগম ট্রাকের সামনে দাঁড়িয়ে বাধা দেন। এ নিয়ে তাঁর ভাই মীর হোসেনের সঙ্গে তাঁদের তর্কবিতর্ক হয়। এ সময় স্থানীয় লোকজন সেখানে উপস্থিত হয়ে বিষয়টি মীমাংসা করে দিলে নুরু গাজী ও তাঁর স্ত্রী ট্রাক ছেড়ে দিয়ে রাস্তার পাশে দাঁড়ান। এরপর তাঁর ভাই ট্রাক চালিয়ে যাওয়ার সময় হঠাৎ খোদেজা পা পিছলে রাস্তার ওপর পড়ে যান। এ সময় ট্রাকের পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে তিনি মারা যান। মীর হোসেনের স্ত্রী হালিমা বেগম বলেন, ‘আমার স্বামী খোদেজা বেগমকে হত্যা করেননি। মিথ্যা সাক্ষী দিয়ে তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি মাদকাসক্তও ছিলেন না।’

No comments

Powered by Blogger.