গণপরিবহনের নৈরাজ্য

গণপরিবহন বন্ধ। নেই ছোট যানবাহনও। রিকশা চলাচলেও বাধা। রাস্তায় নামলেই চালকদের মারধর। ভাঙচুরের হাত থেকে রক্ষা পায়নি সরকারি কর্মকর্তার গাড়ি, রাষ্ট্র মালিকানার পরিবহন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা ভাঙচুর করেছে রোগী বহনকারী অ্যাম্বুলেন্স। চলাচলে বাধা দিয়েছে লাশবাহী গাড়িও। বিনা উসকানিতেই হামলা হয়েছে পুলিশের ওপর। ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন সরকারি কর্মকর্তাসহ পথচারীরা। জরুরি প্রয়োজনেও ঘর থেকে মানুষ যেতে পারেনি গন্তব্যে। দু’দিন ধরে টার্মিনালেই অপেক্ষার প্রহর গুনেছে দূরের যাত্রীরা। যাদের সামর্থ্য আছে তারা উঠেছেন আশপাশের হোটেলে। অন্যরা ভীতিকর পরিস্থিতির মধ্যেই টার্মিনালে পার করেছেন রাত। এসব এলাকার ব্যবসায়ীরাও ছিলেন আতঙ্কে। কারো দোকানে চুরির ঘটনাও ঘটেছে। শ্রমিকরা বন্ধ করে দেয় ভাতের হোটেলও। ফলে না খেয়েই থাকতে হয়েছে দূরের যাত্রীদের। ঢাকার বাইরে থেকে চিকিৎসা নিতে এসে হাসপাতালেই পৌঁছতে পারেনি অনেকে। নিরুপায় হয়ে অনেকে পার্শ্ববর্তী এলাকা থেকে পায়ে হেঁটেই পৌঁছেছেন রাজধানীতে। অনেকে প্রত্যন্ত জেলা শহর থেকে রাজধানীর উদ্দেশ্যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েছেন বিপাকে। মাইলের পর মাইল হেঁটেও কেউ কেউ গুনেছেন ১০-২০ গুণ অতিরিক্ত ভাড়া। গত দু’দিন ধরে এমন নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি ছিল দেশজুড়ে। পরিবহন শ্রমিকরা সারা দেশেই পেশি শক্তি প্রদর্শন করেছে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে। তাদের তাণ্ডবে মানুষের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করলেও কারও কিছু করার ছিল না। এদিকে নৌমন্ত্রী শাজাহান খানের বাসায় বৈঠকের পর ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত আসার খবর প্রকাশের পর ওই মন্ত্রীর ঘোষণায়ই ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়েছে। গত দুই দিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাই সমালোচনার কেন্দ্রে ছিলেন এই মন্ত্রী। সরকারি দলের নেতাকর্র্মীরাও তার অবস্থানের কড়া সমালোচনা করেছেন অনেকে। বিএনপির পক্ষ থেকে বলা হয়, এক মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রীর ইন্ধনে ধর্মঘট ডাকা হয়েছিল। এদিকে দেশজুড়ে কোটি মানুষের দীর্ঘ দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার পর গতকাল দুপুরে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা আসে। যদিও অনেক স্থানে এ বার্তা পৌঁছায় বিকাল নাগাদ। তাই গতকাল দিনভরই দুর্ভোগ পোহাতে হয় অনেক এলাকার মানুষকে। প্রথম দিনের তান্ডবের পর দ্বিতীয় দিন গতকাল সকাল থেকেই দেশজুড়ে শ্রমিকদের তান্ডব শুরু হয়। সকালে রাজধানীর গাবতলী এলাকায় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের সংঘর্ষে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সকালে আহত হওয়া ওই শ্রমিককে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তির পর বিকালে তার মৃত্যু হয় বলে চিকিৎসকদের পক্ষ থেকে জানানো হয়।
ধর্মঘটের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে সকালে তিন মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। ওই বৈঠকে শ্রমিক প্রতিনিধিও ছিলেন। বৈঠকে ওবায়দুল কাদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের কড়া নির্দেশনা দেন। এরপর নৌমন্ত্রী মতিঝিলে বিআরটিসি ভবনে সমবায় প্রতিমন্ত্রী মশিউর রহমান রাঙ্গাকে নিয়ে শ্রমিক-মালিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করেন। এরপরই ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন শাজাহান খান। আগের দিন রাতে নৌমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে বৈঠকের পর ধর্মঘটের ঘোষণা আসে বলে পত্রিকায় খবর আসে। ওই মন্ত্রী এবং প্রতিমন্ত্রী রাঙ্গাও ছিলেন। এদিকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণার পর রাজধানীসহ দূরপাল্লার যানবাহন চলাচল শরু হয়।
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় পরিচালক তারেক মাসুদ ও ফটো সাংবাদিক মিশুক মুনীর নিহতের ঘটনায় দায়ের করা মামলায় জামির হোসেন নামের এক পরিবহন শ্রমিককে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন আদালত। এছাড়া সাভারের ট্রাক চাপায় এক নারীকে হত্যার ঘটনায় মীর হোসেন মীরু নামে আরেক চালককে ফাঁসির আদেশ দিয়েছেন সিএমএম আদালত। এ দুই ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবহন শ্রমিকরা গাড়ি চালানো বন্ধ করে দেয়। মঙ্গলবার সকাল থেকে বাস চলাচল বন্ধ করে দিলেও সন্ধ্যার পর থেকে শ্রমিকরা নৈরাজ্য শুরু করে। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, গাবতলীতে ওইদিন বিকাল থেকে সমাবেশ করে পরিবহন শ্রমিকরা। তাদের বিক্ষোভের মুখে দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। সড়কের ওপর টায়ার জ্বালিয়ে অবরোধ সৃষ্টি করে তারা। একপর্যায়ে শ্রমিকরা গাড়ি ভাঙচুর শুরু করে। রাত ৯টার দিকে গাবতলী বাস টার্মিনালের পাশের একটি পুলিশ বক্সকে ঘিরে বিক্ষোভ শুরু করে পরিবহন শ্র্রমিকরা। কিছুক্ষণ পর ওই বক্সে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। একইসঙ্গে গাবতলী টার্মিনাল এলাকার বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। এছাড়া পুলিশের একটি রেকারেও আগুন ধরিয়ে দেয়। পরে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। কিছুক্ষণ পর মিরপুরের স্থানীয় এমপি আসলামুল হক সেখানে পৌঁছেন। তিনি শ্রমিকদের শান্ত করার চেষ্টা করেন। বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা তার কথায় কর্ণপাত করেনি। পুলিশের সঙ্গে তাদের দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়। পরে পুলিশ সাঁঝোয়া যান ও জলকামান ব্যবহার করে। নিক্ষেপ করে রাবার বুলেট ও টিয়ার সেল। এ ঘটনার পর গাবতলী বাস টার্মিনাল এলাকা দিয়ে কোনো যানবাহন প্রবেশ করতে দেয়নি শ্রমিকরা। এমনকি অ্যাম্বুলেন্স ও লাশবাহী গাড়িও যেতে দেয়নি। এসব গাড়ি মাজার রোডের ডাইভার্সন রোড দিয়ে ঘুরিয়ে দেয়া হয়। রাত ১টা ২৫ মিনিটে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে একটি লাশবাহী মিনি ট্রাক হাজির হয় টেকনিক্যাল মোড়ে। গাড়িটি গাবতলীর রাস্তায় রওনা হলেও শ্রমিকরা গাড়িটিকে সোজা রাস্তায় যেতে দেয়নি। এ ছাড়া, কয়েকটি অ্যাম্বুলেন্স ভাঙচুরও করেছে তারা। গতকাল সকাল থেকে রিকশা কিংবা  মোটরসাইকেলও যেতে দেয়নি। রাস্তায় টায়ার জ্বালিয়ে শ্রমিকরা আবারো বিক্ষোভে নামে। গাবতলী ও আশপাশের এলাকায় সতর্ক অবস্থান নেয় র‌্যাব-পুলিশ। একইসঙ্গে শত শত শ্রমিক রাস্তায় অবস্থান নেয়। ফলে যাত্রী নিয়ে গাবতলী থেকে কোনো যানবাহনই রাজধানীর বাইরে যেতে পারেনি। সকালের দিকে কিছু সময় পর পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করতে থাকে। মাঝে মাঝে পুলিশের রায়ট কার দিয়ে টহল দিলে শ্রমিকরা রাস্তা ছেড়ে আশপাশের এলাকায় লুকিয়ে পড়ে। পরে আবারো জড়ো হয়ে রায়ট কার লক্ষ্য করে ইট ছোঁড়ে। মোটরসাইকেল আরোহীদেরও যেতে বাধা দিয়েছে তারা। এমনকি কয়েকজনকে মারধরও করেছে বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা।
টাঙ্গাইলের নাগরপুরের বাসিন্দা ৬৬ বছরের বৃদ্ধ আবদুল কাদির। দেখতে রোগা।  তিনি একটি গেঞ্জি গায়ে ফাঁকা রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন। দূর থেকে কোনো পথচারী আসছে এমন মনে হলেই তাকে থামিয়ে তিনি জানতে চাচ্ছেন কিভাবে এলেন?   কথা হয় আবদুল কাদিরের সঙ্গে। তিনি জানান, গত ৭ মাস আগে স্ট্রোকে তার এক পাশ অবশ হয়ে যায়। মতিঝিলের ডিএইচকে নামে একটি হাসপাতালে দীর্ঘ ৬ মাস চিকিৎসা নিয়ে মঙ্গলবার সকালে ছাড়া পেয়েছেন। এরপর ৭টায় টার্মিনালে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা করছেন। সঙ্গে রয়েছেন তার বৃদ্ধ স্ত্রী। দিনভর অপেক্ষা করে কোনো কূলকিনারা না পেয়ে রাত ৮টায় হোটেল চৌধুরীতে উঠেছেন। তিনি বলেন, দীর্ঘদিন হাসপাতালে থাকায় সঙ্গে অনেক জিনিসপত্র রয়েছে। আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, এখন মনে হচ্ছে হাসপাতালে থাকাই ভালো ছিল। আবদুল আলিম নামে এক পথচারী জানান, তিনি সাটুরিয়া থেকে এসেছেন। হেঁটে-রিকশায় এভাবে। প্রায় হাজার খানেক মতো টাকা খরচ হয়ে গেছে তার। কুষ্টিয়া থেকে আসা এক ব্যক্তি জানান, তিনি মঙ্গলবার ভোরে গাবতলী এসেছেন। বোনের হার্টের অসুখ। তাকে দেখাবেন বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদালয়ে। কিন্তু পরিবহন চলাচল না করায় পাশেই একটি হোটেলে উঠেছেন। রোগীর অবস্থাও খারাপের দিকে। টার্মিনালের এক ব্যবসায়ী আবদুল হালিম। তিনি একটি দোকান করেন। বলেন, রাতে ভয়ে দোকান বন্ধ করে চলে যান। সকালে এসে দেখেন প্রায় হাজার খানেক টাকার মালামাল চুরি হয়ে গেছে।
এদিকে শ্রমিক-পুলিশ সংঘষের্র সময় শাহ আলম নামে এক শ্রমিক নিহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। তিনি গুলিতে নিহত হন। নিহত শাহ আলম বৈশাখী পরিবহনের চালক। সকালে গুলিতে আহত হওয়ার পর তাকে স্থানীয় সেলিনা আক্তার ক্লিনিক অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জরুরি বিভাগে কর্তব্যরত চিকিৎসক ডা. মঞ্জুরুল হক বলেন, এখানে যখন তাকে নিয়ে আসা হয় আমরা তার পালস পাইনি। আমরা তো মৃত ঘোষণা করতে পারি না। তাই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে নিয়ে যেতে বলি। পরে অন্য শ্রমিকরা শাহ আলমের লাশ সোহরাওয়ার্দীতে না নিয়ে গাবতলী নিয়ে যায়। পুলিশ সেখান থেকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ঢামেকে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
গাবতলীর বাইরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়ও একই চিত্র। যাত্রাবাড়ী গিয়ে দেখা যায় সেখানে দলবদ্ধ কিশোর-তরুণরা। সবার হাতে লাঠি, ইটের টুকরো। তারা টায়ারে অগ্নিসংযোগ করেছেন রাস্তায়। এর মধ্যেই একটি সিএনজি অটোরিকশায় শনির আখড়া থেকে এই দিক দিয়ে চাচ্ছিল। ঘিরে ধরেন শ্রমিকরা। আতঙ্কে গাড়ি থামিয়ে দুই হাত জোড় করে চালক বলেন, ‘বড় ভাইরা গাড়ি ভাঙবেন না। যাত্রী রোগী। গর্ভবর্তী মহিলা মেডিকেলে নিয়ে যাচ্ছি।’ কিন্তু কোনো কথা শুনতে চান না বিক্ষোভকারী শ্রমিকরা। তারা সবাই এক বাক্যে বলছেন, ‘তোরে আজ গাড়ি চালাইতে বলছে কে। ফিরে যা। নইলে কেউ গাড়ি ভাঙলে আমরা দায় নেব না।’ কথা শুনে অসহায় হয়ে যান চালক। এর মধ্যেই মহিলা যাত্রীর সঙ্গে থাকা কিশোর ও এক বৃদ্ধ নারী নামেন সিএনজি অটোরিকশা থেকে। নারী চিৎকার করেন, অযৌক্তিকভাবে ধর্মঘট দিছো, গাড়ি চালাইবা না-চালাইওনা। আমাদের আটকাও কেন। এই রোগীর গাড়িও আটকাও। কি পাইছো?  মহিলার কথা শুনে বিক্ষোভকারীদের কেউ কেউ নীরব হয়ে যান। এর মধ্যেই চালক সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে যেতে সক্ষম হন। সকাল থেকেই পরিবহন ধর্মঘটের নামে সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী এলাকায় নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিল বিক্ষোভকারী শ্রমিকরা। লাঠি হাতে দল বেঁধে রাজপথে নামেন তারা। কোনো গাড়ি দেখলেই দৌড়ে তা আটক করেন। অটোরিকশা এমনকি রিকশারও গতিরোধ করেন তারা। লাঠির ভয় দেখিয়ে নিরীহ যাত্রীদের নামিয়ে দেয়া হয়েছে ওই এলাকায়। মতিঝিল যাওয়ার উদ্দেশ্যে রিকশায় উঠছিলেন এক মধ্য বয়সী নারী। শ্রমিকরা ‘হুররে’ চিৎকার দিয়ে ওই রিকশার সামনে যায়। মহিলাকে অনেকটা ধমক দিয়েই রিকশা থেকে নামিয়ে দেয় তারা। এরকম দৃশ্য ছিল অহরহ। দুপুরে যাত্রাবাড়ী থানার পাশে টায়ার জ্বালিয়ে সড়ক অবরোধ করে শ্রমিকরা। এ সময় আশপাশ দিয়ে কয়েকটি অটোরিকশা যাওয়ার চেষ্টা করলে তাতে হামলা চালায় তারা। ভাঙচুর করা হয় কয়েকটি অটোরিকশা। এ সময় পুলিশ তাদের সরাতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। একপর্যায়ে পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল ছুঁড়ে শ্রমিকরা। তাৎক্ষণিকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে পুলিশ ধাওয়া করলে ওই স্থান ছেড়ে যায় শ্রমিকরা। ধর্মঘট চলাকালে সায়দাবাদ বাসস্ট্যান্ড থেকে গতকাল দূরপাল্লার কোনো যানবাহন ছেড়ে যায়নি। সব ধরনের পণ?্য ও যাত্রীবাহী যান চলাচল বন্ধ রাখার পাশাপাশি রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এই প্রবেশ পথে ব্যক্তিগত যানবাহনও ঢুকতে বাধা দেয়া হয়েছে। সকালে মুন্সিগঞ্জ থেকে কয়েকটি মিনিবাস সায়দাবাদ শাহজালাল টার্মিনালে পৌঁছলে বিক্ষোভরত শ্রমিকরা ওই বাসগুলোর শ্রমিকদের উপর হামলা চালায়। পরে শ্রমিক নেতা ও পুলিশের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। গাড়ি বন্ধ থাকায় নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী, কেরানীগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ থেকে হিউম্যান হলার, লেগুনা, পিকআপে করে ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করেন অনেকে। কিন্তু পরিবহন শ্রমিকদের বাধার কারণে যাত্রাবাড়ী মোড় পার হতে পারেননি তারা। অনেকে ভ্যানে ও রিকশায় করে ওই রাস্তা দিয়ে যেতে চাইলে তারাও বাধার মুখে পড়েন। সায়দাবাদ, যাত্রাবাড়ী, শনির আখড়া, কাঁচপুর, চিটাগাং রোড, সাইনবোর্ড, মাতুয়াইল, রায়েরবাগ, গোলাপবাগ, মতিঝিলসহ বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে লাঠি হাতে অবস্থান নেন শ্রমিকরা। এসময় দুর্ভোগের শিকার হন রোগী, অফিসগামীরা। একইভাবে নারী, শিশু ও বয়স্কদের দুর্ভোগ পোহাতে দেখা গেছে।
একই অবস্থা ছিল রাজধানীর মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড এলাকায়। সকালে মোহাম্মদপুর-বছিলা ও কেরানীগঞ্জের আঁটি রোডের সিএনজি অটোরিকশাগুলো যাত্রী নিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকায় গেলে ধর্মঘটী শ্রমিকদের হামলার শিকার হয়। হামলায় লাঠি হাতে শিশু শ্রমিকরাও অংশ নেয়। দিনভর রাজধানীতে রিকশা ও পায়ে হেঁটে চলাচল করেছেন। ধর্মঘটের কারণে রিকশা ভাড়া ছিল অন্যান্য দিনের চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। এমনকি কাল দুপুরের পর হঠাৎ করেই বাড়ানো হয় বিমানের টিকিটের মূল্য। গতকাল দেশে ফিরে বিপাকে পড়েন অনেকেই। তাদের মধ্যে একজন লন্ডনপ্রবাসী হারুন-অর-রশীদ। তিনি জানান, ধর্মঘটের কথা শুনে ভেবেছিলেন বিমানে সিলেটের বাড়িতে যাবেন। কিন্তু চাহিদা বেশি থাকায় বিমানের টিকিটও পাওয়া যায়নি। সূত্রমতে, দুপুরের পরপরই বিমানের টিকিটের মূল্য বেড়ে যায় দ্বিগুণেরও বেশি। ইউএস বাংলা এয়ারলাইন্সের টিকিটের মূল্য ছিল ৬ হাজার ৫শ’, বাংলাদেশের বিমানের সিলেটের টিকিট বিক্রি হয়েছে ৬ হাজার ৩শ’ টাকায়।
সকাল ১০টার দিকে মহাখালী বাস স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা যায়, রাজধানীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন জেলার গন্তব্যে যাওয়ার জন্য মহাখালী বাস টার্মিনালে এসে বিপাকে পড়েছেন যাত্রীরা। সকালে এসে গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষায় থাকতে থাকলে অনেকে যাত্রী ছাউনির বেঞ্চে ঘুমিয়ে পড়েছেন। অনেকে আবার গাড়ি না পেয়ে দূর দূরান্ত থেকে পায়ে হেঁটে এসে ক্লান্ত থাকায় বিশ্রাম নিচ্ছেন। আবার কাউকে কাউকে রাস্তার পাশে পার্কিং করে রাখা গাড়ির পাশে ব্যাগ-বস্তা রেখে তার উপরে বসেই অপেক্ষা করতে দেখা গেছে। টার্মিনালে বাস চালক ও শ্রমিকদের মধ্যেও ব্যাপক সতর্কতা দেখা গেছে। সকাল থেকেই কোন সিএনজি বা ইঞ্জিনচালিত যানকে টার্মিনাল থেকে বের হওয়ার রাস্তায় দাঁড়াতে দিচ্ছিলেন না তারা। মো. সাইদুর রহমান নামের এক যাত্রী বলেন, হরতাল অবরোধের মধ্যে দুই একটা গাড়ি পাওয়া যায়। এই আশায় বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় রিকশা, সিএনজি ও প্রাইভেট কার ছাড়া আর কিছুই পাইনি। ১০০ টাকা ভাড়া দিয়ে শান্তি নগরের বাসা থেকে এসেছি টার্মিনালে। যাব গ্রামের বাড়ি শেরপুরে। মহাখালী বাস টার্মিনালে এসে সকাল ৮টা থেকে বসে রয়েছি গাড়ির জন্য। কিন্তু কখন গাড়ি ছাড়বে তা নির্দিষ্ট করে কেউ বলতে পারছে না।
সালাউদ্দিন নামের এক যাত্রী মাদারীপুর থেকে রাতের লঞ্চে পরিবার নিয়ে এসেছেন সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে। পরে জানতে পারেন পরিবহন ধর্মঘট তাই গাড়ি ছাড়বে না। তখন নিরুপায় হয়ে যান কমলাপুর রেল স্টেশনে। গিয়ে দেখেন যতগুলো ট্রেন দাঁড়ানো সবগুলোতে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে রয়েছে যাত্রীতে। সবাই আগে থেকেই উঠে সিট দখল করেছে। কারণ যে সময়ই ছাড়ুক গন্তব্যে পৌঁছতে পারবেন। সঙ্গে পরিবার থাকায় ট্রেনে না গিয়ে সিএনজি করে চলে এসেসেন মহাখালী বাস টার্মিনালে। তিনি বলেন, এখানে এসেও জানতে পারলাম কবে গাড়ি ছাড়বে তা কেউ জানে না। এখন আব্দুল্লাহপুর আত্মীয়ের বাসায় যাব। যেদিন পারি সেদিন বাড়ি ফিরব। তিনি আরো বলেন, ধর্মঘটের কারণে কোথাও কোনো গাড়ি নেই। তাই সদরঘাট থেকে কমলাপুর পর্যন্ত সিএনজি ভাড়া দিতে হয়েছে ৩০০ টাকা। কলমাপুর থেকে মাহাখালী বাস টার্মিনাল পর্যন্ত আসতেও ৩০০ টাকা ভাড়া দিতে হয়েছে। এখন আব্দুল্লাহপুর যেতে ৪০০ টাকা ভাড়া চেয়েছে সিএনজি ওয়ালারা। কিন্তু স্বাভাবিক সময় ১০০ টাকার ভাড়াও না। মিরপুর ৩ নম্বর থেকে হবিগঞ্জের বানিয়াচং যাওয়ার জন্য এসেছেন তপন সরকার। বাড়িতে পূজার অনুষ্ঠানে যোগ দিতে তিন ছেলে-মেয়ে ও স্ত্রীকে সাথে নিয়ে। সকাল থেকেই অপেক্ষা করছেন মহাখালী বাস টার্মিনালে। যাত্রী ছাউনিতে অন্যান্য যাত্রীদের মতো তারাও পরিবার মিলে বসে রয়েছেন গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষায়। মো. রাকিব নামের অপর এক যাত্রী বগুড়া থেকে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের চাকরির পরীক্ষা দিতে এসছিলেন ঢাকায়। এখন পরিবহন ধর্মঘটের কারণে আর ফিরতে পারছেন না। তাই মহাখালী বাস টার্মিনালেই গাড়ি ছাড়ার অপেক্ষা রয়েছেন। মো. আনোয়ারুল ইসলাম এসেছেন মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানার বালুর চর ইউনিয়ন থেকে। সেখানে ফার্নিচারের দোকানে কাজ করেন তিনি। হঠাৎ ছোট বোনের বিয়ের আয়োজন হওয়ায় যাবেন গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুরে। সকালে ছোট ছেলেমেয়ে ও স্ত্রীকে নিয়ে রওনা হন। রাস্তায় বের হয়ে কোনো গাড়ি না পেয়ে ৫০০ টাকায় সিএনজি ভাড়া করে আসেন মহাখালী বাস টার্মিনালে। কিন্তু এসে দেখেন কোনো গাড়ি ছাড়ছে না। পরে সিএনজি ভাড়া করে আবার মুন্সিগঞ্জের বাসার দিকে রওনা হন। তিনি মানবজমিনকে বলেন, শুনেছি ধর্মঘট চলছে। কিন্তু দেশের হরতাল-অবরোধের মধ্যে তো সারাদেশেই গাড়ি চলে। এই জন্য এসেছিলাম যদি কোনো লোকাল গাড়িও পাওয়া যায় তাতে করে বাড়ি যাব। আসার সময় রাস্তায় দুই একটা বিআরটিসির গাড়ি দেখেছি। আর কোনো গাড়ি রাস্তায় পাওয়া যায়নি। গ্রামের বাড়ি শেরপুরে যাওয়ার জন্য বাস টার্মিনালে এসে অপেক্ষা করছেন অপর এক যাত্রী মো. মোশাররফ হোসেন। ঢাকার মগবাজারের বাসা থেকে ৮০ টাকা রিকশা ভাড়া দিয়ে সকাল ১০টার দিকে টার্মিনালে আসেন তিনি। দুপুর ১২টার পরও টার্মিনাল থেকে কোনো গাড়ি ছাড়বে কিনা তার নির্দিষ্ট কোনো তথ্য না পাওয়ায় আবার বাসার উদ্দেশ্যে রওনা হন। খলিলুর রহমান নামের অপর এক যাত্রী আসেন নারায়ণগঞ্জের কাচপুর থেকে। কাউন্টারে গিয়ে জানতে চাইলে গাড়ি ছাড়ার বিষয়ে কেউ কিছু বলছে না দেখে টার্মিনালের ভেতরের যাত্রী ছাউনিতে শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছিলেন তিনি। এনা পরিবহনের কাউন্টার থেকে সেলস এক্সিকিউটিভ কামরুল আহসান জানান, গতকালও অনেক যাত্রী এসেছে। আজও সকাল থেকে যাত্রী আসছে অনেক। কিন্তু উপর থেকে আমাদের বলেছে টিকিট বন্ধ রাখতে আমরা রেখেছি। আবার ছেড়ে দিতে বললে আমরা ছেড়ে দিব। এটা শ্রমিকদের আন্দোলন, আমাদের কোনো বিষয় না।
সকালে ইটের আঘাতে গুরুতর আহত হয়েছেন ইটনা উপজেলার কৃষি সমপ্রসারণ কর্মকর্তা মো. সুমন মিয়া। তিনি গাজিপুরের টেলিকম স্টাফ কলেজে পরিচালিত বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সের একজন প্রশিক্ষণার্থী। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে সচিবালয়ে সংযুক্তিতে যাওয়ার পথে উত্তরা ৬ নম্বর সেক্টরের সামনে প্রশিক্ষণার্থীদের বাসে ইট ছুড়ে শ্রমিকরা। ইটটি তার গালের একাংশে আঘাত করলে মাংস থেতলে পড়ে যায়। দুটো দাঁতও পড়ে যায়। আহত সুমন মিয়াকে প্রথমে উত্তরা কমিউনিটি হাসপাতালে নেয়া হয়। পরে অবস্থার অবনতি হওয়ায় সিএমএইচ-এ নেয়া হয়। আগেরদিন বিপিএটিসির একটি অ্যাম্বুলেন্সও ভাঙচুর করে শ্রমিকরা। গতকাল বিকালে গাবতলী টার্মিনালে শ্রমিকদের হামলার শিকার হন বিডিনিউজের সাংবাদিক মাসুম বিল্লাহ। ওই এলাকার পরিস্থিতি দেখতে গেলে শ্রমিকরা তার ওপর হামলা চালায়। গাছের ডাল দিয়ে তাকে আঘাত করলে তা মুখে আঘাত লাগে। এছাড়া তার মোটরবাইকও ভাঙচুর করে পরিবহন শ্রমিকরা।
উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নৈরাজ্য চলছে: ফখরুল
পাবনার সুজানগর উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীদের গণসংযোগে হামলার অভিযোগ করেছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আগামী ৬ই মার্চ অনুষ্ঠিতব্য দেশের কয়েকটি উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব এখন চরম মাত্রা পেয়েছে। বিএনপি মনোনীত প্রার্থী ও প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর বেপরোয়া হামলা চালিয়ে তাদেরকে আহত করা হচ্ছে। লিফলেট, ব্যানার ছিঁড়ে ফেলা হচ্ছে। প্রচার-প্রচারণায় ব্যাপকভাবে বাধা দেয়া হচ্ছে। নির্বাচনী এলাকাগুলোতে আওয়ামী সশস্ত্র সন্ত্রাসীদের অস্ত্রের ঝনঝনানিতে এলাকাবাসী এখন আতঙ্কিত জীবনযাপন করছে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ও তাদের অঙ্গ সংগঠনের সন্ত্রাসীরা বিরোধী প্রার্থী ও প্রার্থীর সমর্থকদের ভয় পাইয়ে দিতেই অস্ত্রবাজির মাধ্যমে সরকারি দলের প্রার্থীদের জয় সুনিশ্চিত করতে চাইছে। এক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সন্ত্রাসীদেরকে সহযোগিতা দেশবাসীকে আরো উদ্বিগ্ন ও চিন্তিত করে তুলেছে। বিএনপি মহাসচিব বলেন, নির্বাচনী এলাকাগুলোতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে বিএনপি মনোনীত প্রার্থীরা স্থানীয় ও জেলা নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ে অভিযোগ করলেও কোনো প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না। মনে হচ্ছে- সরকারি প্রশাসন সরকারি দলের প্রার্থীদের বিজয়ী করতেই কাজ করছে। উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি প্রমাণ করে নতুন নির্বাচন কমিশন তাদের বাগাড়ম্বর বক্তব্য দিয়ে জাতিকে বিভ্রান্ত করতে চায়। বিএনপি মহাসচিব বলেন, আওয়ামী সন্ত্রাসীদের হামলায় জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক নুর মো. মাসুম বগা, আনিছুল হক বাবু, শহিদুল ইসলাম টুটুল বিশ্বাস ও জেলা যুবদলের সহ-সভাপতি টিপুসহ অনেক নেতাকর্মী আহত হয়েছেন। এছাড়া সুজানগর পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাবেক চেয়ারম্যান কামাল বিশ্বাসের বাড়ি ভাঙচুর করেছে সন্ত্রাসীরা। অন্যদিকে বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হোগলাপাড়া ইউনিয়ন ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক  সিফাত উল্লাহর ওপর হামলা করেছে সরকার সমর্থকরা। মির্জা আলমগীর এসব ন্যক্কারজনক ও বর্বরোচিত ঘটনায় নিন্দা ও প্রতিবাদ জানান।

No comments

Powered by Blogger.