পাবনা নাটোর ও সিরাজগঞ্জের চাষিরা সরষের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত

পাবনা নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় এ বছর সরষের বাম্পার ফলন হয়েছে। অনুকুল আবহাওয়ার কারণে এ অঞ্চলের প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে তিন লাখ টনের বেশি সরষে উৎপাদন হয়েছে। হাট-বাজারে প্রচুর সরষে আমদানি হচ্ছে। ফড়িয়া দালালদের সিন্ডিকেট বাজারদর নিয়ন্ত্রন করায় প্রান্তিক ও বর্গাচাষিরা সরষের ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। বর্তমানে হাট-বাজারে মানভেদে প্রতিমণ সরষে এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আগামীতে সরষের দাম বাড়ার আশায় অনেক ব্যবসায়ীই সরষে কিনি গুদামজাত করতে শুরু করেছেন। রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, পাবনা জেলার বেড়া, সাঁথিয়া, সুজানগর, পাবনা সদর, আটঘড়িয়া, ঈশ্বরদী, ফরিদপুর, চাটমোহর, ভাঙ্গুড়া, নাটোরের লালপুর, বড়াইগ্রাম, গুরুদাসপুর, সিংড়া, বাগাতিপাড়া, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর, উল্লাপাড়া, রায়গঞ্জ, তারাশ, কাজীপুর, সিরাজগঞ্জ সদর, চৌহালীসহ ২১টি উপজেলায় এ বছর প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আগাম, নাবী ও বারি-১৪ জাতের সরষের চাষ হয়েছিল। প্রতি হেক্টরে দুই টন হিসেবে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল তিন লাখ টন। আবহাওয়া অনুকুলে থাকায় উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে গেছে বলে কৃষি সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, এ বছর পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার চরপেচাকোলা, চরআড়ালিয়া, সাঁড়াশিয়া, চরসাফুল¬া, আগবাকশোয়া, চরনাগদা, চরঢালা, চরকল্যানপুর, পূর্বশ্রীকন্ঠদিয়া, পদ্মারচর, চরযমুনা, বাইরচর, শ্রীপুর, খিদ্রদাশুরিয়া, মুরাদপুর, বরাংগাল, ঘোড়জান এবং সিরাজগঞ্জ জেলার মেঘাইরচর, খাসকাউলিয়া, মিনারদিয়াচর, ওমরপুরচর, পয়লারচর, বানতিয়ারচর, মীরকুটিয়ারচর, রস্তমেরচর, সোলজানারচর, দইকান্দিরচর, চরআগবাঙলা, শিমুলকান্দি, বারোপাখিয়ারচর, ধীতপুর, কুশিরচর, ভুমোরিয়া, চাঁমতারা, শিংঘুলি, নয়াহাটাবরংগাইল, ভারদিঘুলিয়া, চরবলরামপুর, চরভাড়ারা, সাদিপুর, সুদিরাজপুর, আশুতোষপুর, কোমরপুর, বীরপুর, পীরপুর, চালাকপাড়া, হঠাতপাড়ারার চরের ৬০ হাজার হেক্টর জমিতে সরষের আশাতীত ফলন পাওয়া গেছে। গত একযুগে সরষের এমন বাম্পার ফলন পাওয়া যায়নি বলে চাষিরা জানিয়েছেন। সরষের গুণগত মান বৃদ্ধি ও হাটবাজারে বিক্রির জন্য চাষিরা সরষে রোদে শুকিয়েছেন।
শুকানো সরষের দাম ভাল পাওয়া যায়। পাইকার ও মজুতদারা হাটবাজার থেকে সরষে কিনে ভালভাবে শুকিয়ে গুদামজাত শুরু করেছেন। বর্তমানে সরষের বাজারদর এক হাজার ৭০০ টাকা থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকা। ফড়িয়া দালালরা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে কম দামে সরষে কিনে বেশি দামে বিভিন্ন তেল মিলে বিক্রি করছে। এ বছর বাম্পার ফলন হওয়ায় হাট-বাজারে সরষের সরবরাহ বেড়েছে। গত বছর প্রতিমণ সরষে বিক্রি হয়েছিল এক হাজার ৮০০ টাকা থেকে এক হাজার ৯০০ টাকায়। এ বছর সরষের দাম কিছুটা কম। আগামীতে সরষের দাম বাড়বে বলে আশা করছেন অনেক ব্যবসায়ী। ত্ইা অনেক ব্যবসায়ীই সরষে কিনি গুদামজাত করতে শুরু করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটোরের লক্ষীকোল বাজার, রয়না ভরট হাট, মৌখাড়া হাট, জালশুকা হাট, চাঁচকৈড় হাট, চাটমোহরের অমৃতকুন্ডা হাট, মির্জাপুর হাট, ছাইকোলাহাট, নওগাঁহাট, চতুরহাট, কাশিনাথপুরহাট, বনগ্রামহাট, তালগাছি, ডেমরা, বনওয়ারীনগড়, আতাইকুলাহাট সরষে বিক্রির জন্য প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে। সরষে বেচা-কেনার জন্য বিভিন্ন হাট-বাজারে গড়ে উঠেছে অসংখ্য আড়ৎ। হাট-বাজারগুলোতে প্রচুর সরষের আমদানি হচ্ছে। খুলনা, চট্রগ্রাম, সিলেট, ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সরষের পাইকার ও মিলাররা এসে আরৎদারদের মাধ্যমে চাহিদা অনুয়ায়ী সরষে কিনছেন। পরে সরষে বস্তায় ভরে ট্রাকে করে সড়ক পথে নিজ নিজ গন্তব্যে নিয়ে যাচ্ছেন। বর্তমানে হাট-বাজারে মান ভেদে প্রতি মণ শুকনা সরষে এক হাজার ৭০০ থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। আর্দ্র সরষে প্রতিমণ এক হাজার ৫০০ দরে বিক্রি হচ্ছে। সিরাজগঞ্জের চৌহালী উপজেলার মিনারদিয়াচর এলাকার সরষে চাষী খোরশেদ আলম ও রফিক মোল্লা বলেন, প্রতি বছরই কৃষকদের সরষে যখন বেচা হয়ে যায়, তখন সরষের দাম বাড়ে। অথচ মৌসুমের শেষে মজুতদারেরা বেশি দামে সরষে বিক্রি করে লাভের টাকা ঘরে তোলেন। যমুনা নদী বেষ্টিত ঢালারচরের কৃষক আহেদ প্রামানিক জানান, এক একর জমিতে সরষে চাষ করতে খরচ হয় এক হাজার থেকে এক হাজার ৫০০ টাকা। প্রতি বিঘায় ৬ থেকে ৭ মণ সরষে উৎপাদন হয়। এ বছর বারি-১৪ জাতের সরষে প্রতি বিঘায় গড়ে ৮ মণ ফলন পাওয়া গেছে। মানভেদে প্রতিমণ সরষের বাজার মূল্য এক হাজার ৬০০ টাকা থেকে এক হাজার ৭৫০ টাকা। অন্যান্য ফসল আবাদ করে প্রতি বিঘায় যে পরিমাণ লাভ হয় তার চেয়ে ওই পরিমাণ জমিতে সরষে চাষ করে দ্বিগুণ লাভ করা যায়। পাবনার হান্ডিয়াল এলাকার কৃষক জামাল শেখ এ বছর পাঁচ একর জমিতে সরষে আবাদ করে ব্যাপক সাফল্য পেয়েছেন। সাত বছর ধরে সরষে আবাদ করে তিনি প্রতি মওসুমে দেড় থেকে পৌণে দুই লাখ টাকা লাভ করছেন। এছাড়া সরষের পাতা ও ফুল ঝরে তৈরি হয় জৈবসার।
ফলে পরবর্তী ফসল আবাদের জন্য সারের তেমন প্রয়োজন হয় না বলে তিনি জানান। ফরিদপুরের সোনাহারা গ্রামের সরষেচাষি নুরুল ইসলাম চলতি বছর প্রতি বিঘা জমিতে ৬ মণ করে মাঘি সরষে পেয়েছেন। আগে একই পরিমান জমিতে মাঘি সরষে পাওয়া যেত ৩ থেকে ৪ মণ। গত বছর প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছিল ৫ মণ। পাবনা কৃষি গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. শফিকুল ইসলাম জানান, মাঘি সরষের চেয়ে বারি-১৪ জাতের সরষের ফলন বেশি হয়েছে। প্রতি বিঘা জমিতে কৃষক এ সরষের সর্বোচ্চ ফলন পেয়েছেন ৭ থেকে ৮ মণ। পাবনা কৃষি সম্প্রসারন বিভাগের উপপরিচালক বিভূতি ভূষন সরকার বলেন, চলতি বছর পাবনা, নাটোর ও সিরাজগঞ্জ জেলায় সরষের ভাল ফলন হয়েছে। ফলন বাড়ানোর জন্য ক্ষেতের পাশে মৌ-বাক্স বসানো হয়েছিল। মৌমাছি পরাগায়ণে সহায়তা করেছে। ফলে সরষের ফলন বেড়েছে। এ পদ্ধতিতে লাভবান হয়েছেন কৃষক ও মৌ ব্যবসায়ী উভয়েই। এছাড়া এ বছর ডাল জাতীয় ফসলের আশাতীত ফলন হয়েছে। যদি কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় না হয় তাহলে মসলা জাতীয় ফসল পেঁয়াজ ও রসুনের ভাল ফলনের সম্ভাবনা রয়েছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

No comments

Powered by Blogger.