আগ্রা-মথুরায় ‘কী হয় কী হয়’

বুধবারের আগ্রা সকাল থেকেই চনমনে। হবে নাই-বা কেন? আগের দিন থেকেই ‘গ্রামে গ্রামে সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে—মৈত্রমহাশয় যাবে সাগরসংগমে’র মতো ঢ্যাঁড়া পেটানো হয়েছে, শহরে প্রচারে আসছেন দুই ‘ভাবি’। দুই ভাবির একজন অখিলেশ ‘ভাইয়া’র বউ কনৌজের লোকসভার এমপি ডিম্পল। কিন্তু অন্য ভাবিটা কে? কেউ বলছেন জিনাত আমান, কেউ বিদ্যা বালান। কিন্তু দ্বিতীয় ভাবি যে অমিতাভ বচ্চনের বউ জয়া, যিনি সমাজবাদী পার্টিরই রাজ্যসভার এমপি,
পাবলিক সেটা বুঝল ভাবিদের আগ্রায় অবতরণের পর। দুই ভাবির তিন-তিনটে পাবলিক মিটিং গোটা জেলাকেই প্রায় অচল করে দিল! আগ্রার খ্যাতি তিন কারণে। গোটা পৃথিবী যদি যমুনাপারের এই শহরটাকে তাজমহলের জন্য চেনে, দেশ তাহলে চেনে জুতাশিল্পের কারণে। আর তৃতীয় পরিচিতি? আগ্রায় তৈরি চালকুমড়োর হরেক রকমের পিঠা ও মথুরা-বৃন্দাবনের পেড়া। প্রায় কুটিরশিল্প হয়ে গেছে এই দুই মিঠাই। আগ্রায় আসবে অথচ ভিন প্রদেশের মানুষ পিঠা ও পেড়া না কিনে ঘরে ফিরবে, এমন কল্পনা করাও নাকি মহা পাপ! যেমন মহা পাপ কৃষ্ণভূমিতে গো-মাতার সঙ্গে দুর্ব্যবহার! এই আগ্রা ও মথুরা জেলায় আপাতত কী হয় কী হয় প্রতীক্ষা। বুক ঠুকে এ কথা বলার মতো হিম্মত কোনো দলই দেখাতে পারছে না। কারণ, এমন ধরনের একটা ভোট অনেক দিন তল্লাটের মানুষ দেখেনি। এই যেমন ফতেহাবাদের মনু তিওয়ারি ও মুকেশ দীক্ষিত। মনু থ্রি হুইলারের ডিলার, মুকেশ টেন্ট ও ক্রোকারিজ ব্যবসায়ী। দুজনকে কাছাকাছি এনেছে তাদের জাতিগত সত্তা ও রাজনৈতিক বিশ্বাস। দুজনেই ব্রাহ্মণ এবং বিজেপির সমর্থক। ঠিক বিজেপি বলাটা কিঞ্চিৎ বাড়াবাড়ি হলেও হতে পারে, কেননা, দুজনকে কাছাকাছি এনেছে নরেন্দ্র মোদির রাজনীতি। মনু ও মুকেশের অবলীলায় স্বীকারোক্তি, ‘আগে কংগ্রেস করতাম। এখন বিজেপি। কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো শক্ত মনের নেতাদের আকাল পড়েছে দেশে।
একমাত্র ব্যতিক্রম নরেন্দ্র মোদি। এবারের ভোটও ওঁর নামেই শুরু ও শেষ হবে।’ একটা সময় ছিল, এই ব্রাহ্মণকুল কংগ্রেস ছাড়া আর কাউকে চিনত না। মনু-মুকেশদের মতে সেই কংস আজ ‘অনাথের মতো ফ্যাল ফ্যাল করে ঘুরছে’। কিন্তু জাঠেরাও তো বিজেপির থেকে মুখ ফেরাচ্ছে? মনু-মুকেশ ও তাঁদের ঘিরে থাকা অন্যরা ঘাড় নাড়াতে নাড়াতে বললেন, ‘জাঠেরাও দেখবেন মোদির নামে বিজেপিকেই ভোট দেবে। কেন জানেন? কারণ, ওরাও বুঝতে পারবে, সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ যদি কেউ দিতে পারেন, তা নরেন্দ্র মোদিই।’ এই দাবিকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিলেন নিউ আনিস জেমস ফ্যাক্টরির মালিক মহম্মদ আনিসুদ্দিন। গোটা আগ্রায় আনিসুদ্দিনকে চেনেন না এমন মানুষের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর। কারণ, তাজমহলের অন্যতম আর্কিটেক্ট মহম্মদ ঈশা, শাহজাহানের আমলে যিনি ইরান থেকে ভারতে এসেছিলেন, আনিসুদ্দিন তাঁর উত্তরসূরি। দুষ্প্রাপ্য পাথরের ব্যবসা যাঁরা করেন, আনিসুদ্দিন তাঁদের কাছে নমস্যই শুধু নন, তাঁর রাজনৈতিক ব্যাখ্যাকে অন্য সম্প্রদায়ের মানুষজনও গুরুত্ব দেন। কারখানা কাম শোরুমে বসে তিনি বললেন, ‘আগ্রা জেলায় এবারের লড়াইয়ের একদিকে অখিলেশ-রাহুল জোট, অন্যদিকে বিজেপি। তৃতীয় শক্তি মায়াবতী, যিনি এই জেলায় গত বিধানসভা ভোটে ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়েছিলেন জেলায় নয়টার মধ্যে ছয়টা আসনে জিতে।’ আনিসুদ্দিনের কথায়, ‘জাঠদের ভোট এবার ভালোমতো ভাগ হচ্ছে, কিছুটা ভাগ হচ্ছে বর্ণহিন্দু ভোটও কংগ্রেসের কারণে। ক্ষমতাপ্রিয় বর্ণহিন্দুদের অনেকে সমাজবাদীদের সাইকেলে সওয়ার হয়ে ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছে। দুটিতেই ক্ষতি বিজেপির। বিজেপির লাভ মুসলমান ভোট ভাগ হলে। সে জন্য তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। মায়াবতীর দিকে চেয়ে বিজেপি তাই হাপিত্যেশ করে বসে রয়েছে। কিন্তু লোকসভার ভোটে মোদির টানে দলিত ভোট যেভাবে ভাগ হয়েছিল, এবার তা হচ্ছে না। না হওয়ার কারণও কিন্তু সেই নরেন্দ্র মোদি।’ দলিত ভোট এবার ভাগ না হওয়ার কারণ নোটবন্দীর মার।
সে মার কেমন তার উদাহরণ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে চামড়াশিল্পে। হাইওয়ের দুই ধারে সার সার চামড়ার জুতার কারখানা। হিং কি মান্ডি এশিয়ার সবচেয়ে বড় রেডিমেড জুতার হোলসেল মার্কেট। আগ্রা শহরের কাটরা উমর এলাকায় মাইরা শু ফ্যাক্টরির ম্যানেজার শামীম উদ্দিন নোটবন্দীর উপাখ্যান শোনালেন এভাবে, ‘গত তিন বছরের পরিস্থিতিটা একবার বিচার করুন। মোদির উত্থানের সঙ্গে সঙ্গে গো-হত্যা বন্ধের একটা জিগির উঠল। গরুর চামড়া তিন বছর ধরে কমতে কমতে এখন প্রায় তলানিতে। আসে মহিষ ও ছাগলের চামড়া। গরু সংরক্ষণের নামে চারদিকে যা বাড়াবাড়ি শুরু হয়, তাতে মহিষের চামড়ার আমদানিও কমে গেছে। জুতাশিল্প অনেকটাই আজকাল সিনথেটিক-নির্ভর। বড় নোট বাতিল করে দিয়ে মোদি তাতেও ঘা দিলেন।’ কোপটা পড়ল কাদের ওপর? শামীমের কথায়, ‘গরিব মানুষ। এই শিল্পে ১০০ শতাংশ মজুরই হয় দলিত নয় মুসলমান। এই দলিত, যাঁরা মায়াবতী ও তাঁর নির্বাচনী প্রতীক হাতি ছাড়া আর কিছু চেনেন না। মোদির টানে এই সমাজের অনেকে লোকসভা ভোটে বিজেপির দিকে ঢলেছিলেন। এবার তাঁরা আবার মায়াবতীর কাছেই ফিরে যাবেন। এতে ক্ষতি হবে বিজেপিরই।’ আর মুসলমান? আনিসুদ্দিন ও শামীম দুজনেরই এক সুর, ‘মুসলমান হয়ে বলতে পারি, সব দিক থেকে ভরসা আমরা অখিলেশকেই করি।’

No comments

Powered by Blogger.