আন্দোলনের চাপে বাতিল মূলনীতি কমিটির সুপারিশ

পাকিস্তানের সর্বাধিনায়ক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাঁর ঢাকা সফরে সেই যে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের ওপর ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়ে গেলেন, এরপর সেই প্রভাবে নেতাদের নিষ্ক্রিয়তায় মনে হচ্ছিল, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সহজে আর জাগিয়ে তোলা যাবে না। তমদ্দুন মজলিস প্রভাবিত রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক তমদ্দুন নেতা শামসুল আলম তো ইস্তফা দিয়ে খালাস। এর নির্বাহী দায়িত্ব এসে পড়ে মোহাম্মদ তোয়াহার ওপর। কিন্তু তাঁর পক্ষে একা আন্দোলন চাঙা করে তোলা সম্ভব ছিল না। কারণ, মূল দলগুলো এ ব্যাপারে নীরব। নীরব এমনকি অতি উৎসাহী তমদ্দুন মজলিস, এমনকি নীরব মুসলিম ছাত্রলীগও।
ছাত্রনেতাদের একাংশও নিশ্চুপ। যে যা-ই বলুক, সেই দুঃসময়ে একমাত্র ছাত্র ফেডারেশন সাহসে ভর করে ১৯৪৯-এর ১১ মার্চের আন্দোলন দিবস পালন করতে রমনার রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। মাত্র ২০-২৫ জন বামপন্থী ছাত্রের কণ্ঠে স্লোগান: ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘উর্দুর জুলুম চলবে না’ ইত্যাদি। নেতৃত্বে ছিলেন সাহসী ছাত্রনেত্রী নাদেরা বেগম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের বামপন্থী ছাত্রনেতা নাসির আহমেদ, ছাত্রনেতা সৈয়দ আফজাল হোসেন প্রমুখ। সঙ্গে ঢাকা কলেজ, জগন্নাথ কলেজের কিছুসংখ্যক ছাত্র, যেমন আবদুস সালাম, মৃণাল বাড়ড়ি প্রমুখ। কিন্তু পুলিশের বেধড়ক লাঠিচার্জ ও গ্রেপ্তারের কারণে ছোটখাটো মিছিলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। গোটা ১৯৪৯ সালজুড়ে এরপর রমনার রাজপথে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে স্লোগান বড় একটা শোনা যায়নি। তবে এ সময়ের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ১৯৪৯-এর জুনে গণতান্ত্রিক ধ্যানধারণার কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক নেতা, বিশেষ করে জননেতা মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে গঠিত হয় গণসংগঠন আওয়ামী মুসলিম লীগ। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সেক্রেটারি শামসুল হক। যুগ্ম সম্পাদক তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও খোন্দকার মোশতাক আহমদ। লক্ষ করার বিষয়, এ দলের প্রথম অধিবেশনে ছিল বিচিত্র মতাদর্শের সংগঠনের মানুষ। এসব সংগঠনের মধ্যে যেমন ছিল জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম, তেমনি ছিল রেলওয়ে শ্রমিক লীগ, দু-একটি ছাত্রসংগঠন। ছিলেন জনা কয় ঢাকাই ব্যবসায়ীও। পাকিস্তানি দুঃশাসনের যুগে এই প্রথম বহু চরিত্রের একটি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশ নানা বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে। শাসকশ্রেণি তখনো যেকোনো প্রকার সরকার-বিরোধিতা দমনে উগ্র চণ্ডনীতি গ্রহণে অভ্যস্ত, এককথায় ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক কায়দা অনুসরণ।
গণতন্ত্রবিরোধী এমন উগ্র রাজনৈতিক পরিবেশে নতুন করে ভাষা আন্দোলন গড়ে তোলা সহজ বিষয় ছিল না। আত্মবিশ্বাসী মুসলিম লীগ সরকার এই সুযোগে চেষ্টা চালায় পূর্ববঙ্গের ভাষা আন্দোলনকে স্থায়ীভাবে নিষ্ক্রিয় করে তোলার এবং সেটা রাজনৈতিক দমননীতির পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কূটকৌশলে। সে প্রচেষ্টা ছিল নানা রকমের। কিন্তু সে অপরিণামদর্শী প্রচেষ্টা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে দাঁড়ায়। আরবি হরফে বাংলা লেখা চালু করতে পূর্ববঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে আরবি হরফে বাংলা শিক্ষার কয়েকটি বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র চালু করা হয়। এ প্রচেষ্টার মধ্যমণি কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী কথিত বাঙালি ফজলুর রহমান। এ ছাড়া ছিল তাঁর উদ্যোগে পূর্ববঙ্গে উর্দু শিক্ষা বিস্তারের জন্য শিক্ষায়ন প্রতিষ্ঠা। পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষাকে ইসলামি আদর্শে পুনর্গঠিত করার চেষ্টাও চলে প্রবল উদ্যমে। এসব চেষ্টার মূল লক্ষ্য ছিল বাংলার মাটিতে বাংলা ভাষাকে কবর দেওয়ার অশুভ চিন্তা। এসব প্রচেষ্টার অতি উৎসাহী উদ্যোগী ব্যক্তি ছিলেন কবি গোলাম মোস্তফা, আমলা মীজানুর রহমান প্রমুখ। বলতে হয়, বাঙালির মধ্যে ‘মীরজাফরি বদরক্ত’ থেকে থেকে দেখা দিয়েছে। এ অশুভ প্রচেষ্টার পাশাপাশি দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের উদ্যোগে গঠিত মূলনীতি কমিটির বৈঠকে নতুন করে উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে সুপারিশ। দুটো ঘটনাই ভাষা আন্দোলনের নিস্তরঙ্গ নদীতে যথেষ্ট শক্তিমান ঢেউ তোলে। বলা যায়, উসকে দেওয়া হয় আন্দোলনের সম্ভাবনা। ছাত্রদের মিছিলে বরাবর উচ্চারিত স্লোগান ছিল: ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’, ‘হরফ ষড়যন্ত্র বন্ধ করো’, ‘ফজলুর রহমান মুর্দাবাদ’। এবার মূলনীতি কমিটির একাধিক সুপারিশ বাতিলের দাবিতে রাজনৈতিক নেতারাও রাজপথে নেমে আসেন। চলে নিয়মিত সভা-সমাবেশ, মিছিল, স্লোগান। ঢাকার রাজপথে তখন এ দুই ইস্যুতে ছাত্র ও রাজনীতিকদের প্রতিবাদী মিছিল নতুন করে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন পুনরুজ্জীবনের সম্ভাবনা তৈরি করে। প্রতিবাদের চাপে মূলনীতি কমিটির সুপারিশ স্থগিত হলেও ভাষা আন্দোলনের সম্ভাবনায় নতুন করে তৎপরতা শুরু হয়।
আহমদ রফিক: ভাষাসংগ্রামী, কবি ও রবীন্দ্র-গবেষক

No comments

Powered by Blogger.