নতুন ইসির নিরপেক্ষতা পরীক্ষা হোক এখনই

নতুন নির্বাচন নয়, নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়েই আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের মধ্যে বাহাস শুরু হয়ে গেছে। সরকারি পক্ষ বলছে, এর চেয়ে ভালো নির্বাচন কমিশন আর হয় না। অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে কমিশনে ঠাঁই পাওয়া সবাই শতভাগ যোগ্য ও নিরপেক্ষ। আর বিরোধী দলের বক্তব্য, অনুসন্ধান কমিটির নামে সরকার তাদের পছন্দসই লোকদের নিয়েই কমিশন গঠন করেছে। তবে বিএনপি স্বীকার করেছে যে পাঁচ সদস্যের নির্বাচন কমিশনে তাদের তালিকা থেকেও একজনকে নেওয়া হয়েছে। বিশিষ্ট লেখক-কবি মাহবুব তালুকদার বিএনপির প্রস্তাবেই ছিলেন। তাঁর যে চিন্তাভাবনা ও অভিজ্ঞতা তাতে বলার সুযোগ নেই যে তিনি বিএনপির লোক। একইভাবে এরশাদের জাতীয় পার্টি বা তরীকত ফেডারেশনের তালিকা থেকে সিইসি পদে কে এম নুরুল হুদার নিয়োগ পাওয়াও প্রমাণ করে না যে তিনি তাদের লোক। অন্য তিন কমিশনারের বেলায় সে কথা কমবেশি প্রযোজ্য। যিনি যেই অভিজ্ঞতা ও পটভূমি থেকেই আসুন না কেন, তাঁদের একমাত্র দায়িত্ব হবে নির্বাচনগুলো সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে পরিচালনা করা। নতুন নির্বাচন কমিশন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরবিরোধী মনোভাব দেখে ২০০০ সালে সিইসি পদে এম এ সাঈদের নিয়োগের কথা মনে পড়ল।
সে সময় বিএনপি আরও বেশি জোরালো কণ্ঠে তাঁর নিয়োগের প্রতিবাদ করেছিল। তারা হরতাল পর্যন্ত ডেকেছিল। কিন্তু সেই এম এ সাঈদের কমিশনই যখন ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের জাতীয় নির্বাচন করল, তখন তাঁকে বিএনপির লোক হিসেবেই চিহ্নিত করা হলো। নির্বাচনে পরাজিত হয়ে আওয়ামী লীগ সিইসির পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা লতিফুর রহমানকেও আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করাল। অন্যদিকে ২০০৮ সালের নির্বাচনে যে বিএনপি পরাজিত হয়েছে, সেটি দলের নেতারা এখনো মানতে পারেননি। তাঁরা শেখ হাসিনার সরকারকে সেনা-সমর্থিত সরকারেরই বর্ধিত রূপ বলে মনে করেন। দুই বিপরীতমুখী ষড়যন্ত্রতত্ত্বের পেছনে যেটি কাজ করেছে তা হলো, কঠিন সত্যকে স্বীকার করতে না পারা। নেতারা যে জনগণের নামে তাঁরা রাজনীতি করেন, সেই জনগণের ওপরই আস্থা রাখতে পারেন না। আমাদের নির্বাচনী রাজনীতি তথা গণতন্ত্রের বড় সংকট হলো কেউ হারতে চান না, সবাই জয়ী হতে চান। কিন্তু নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য যে জনগণের মন জয় করতে হয়, ক্ষমতায় গিয়ে তাঁরা সেটি ভুলে যান। নতুন সিইসি কে এম নুরুল হুদার বিরুদ্ধে বিএনপির প্রধান অভিযোগ, তিনি ১৯৯৬ সালে জনতার মঞ্চে গিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি তখন কুমিল্লার ডিসি ছিলাম। আমি জনতার মঞ্চে যোগ দিইনি এবং বিএনপিও সেই অভিযোগ আনেনি। চাকরিতে ২৫ বছর হলে কোনো কারণ না দেখিয়ে কাউকে অবসর দেওয়া যায়। কিন্তু আমি তার বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করেছি। আদালতের রায়ে চাকরি ফিরে পেয়েছি।’ তিনি আরও বলেন,
‘আমি পেছনের দিকে তাকাতে চাই না। কারও প্রতি রাগ বা অনুরাগের বশবর্তী হব না। আমি নিরপেক্ষভাবে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে সচেষ্ট থাকব।’ (প্রথম আলো, ৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭) যাঁরা সিইসির বিরুদ্ধে পক্ষপাতের অভিযোগ এনেছেন, তাঁদের স্মরণ করতে বলব যে কে এম নুরুল হুদা কুমিল্লায় জেলা প্রশাসক থাকতেই ১৫ ফেব্রুয়ারির নির্বাচন হয়েছিল এবং তিনি সেই নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তার দায়িত্বও পালন করেছেন। এ ধরনের বিতর্কিত কাজ করার জন্য সরকারি কর্মকর্তাদের অভিযুক্ত করার আগে রাজনৈতিক নেতৃত্বের উচিত আয়নায় নিজের মুখ দেখা। আগের এক লেখায় আওয়ামী লীগকে আয়নায় মুখ দেখার কথা বলায় বিএনপি খুশি হয়েছিল। মনে হচ্ছে বিএনপিরও আয়নায় মুখ দেখার সময় এসেছে। বিএনপি এখন নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার নিয়ে অনেক ভালো ভালো প্রস্তাব দিচ্ছে। করণীয় বাতলাচ্ছে। কিন্তু তারা ক্ষমতায় থাকতে নির্বাচন কমিশন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার সংস্কারে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোট যখন ৩১ দফা দাবিনামা পেশ করে, তা আমলেই নেয়নি। ২০০৬ সালে বিএনপি গায়ের জোরে ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করে নির্বাচনটি ভন্ডুল করে না দিলে হয়তো ইতিহাস অন্য ধারায় এগোত। দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে উচ্চ আদালতের রায়ের পরও আওয়ামী লীগের পক্ষে সংসদে ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিল করা কঠিন হতো। তবে শপথ নেওয়ার আগেই নতুন নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে যে বিতর্ক হচ্ছে, তার আপাত সমাধান খোঁজা যেতে পারে দুটি উপনির্বাচনে। কথা নয়, কাজে প্রমাণ হোক। আগামী কিছুদিনের মধ্যে গাইবান্ধায় মনজুরুল ইসলাম ও সুনামগঞ্জে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের শূন্য দুটি আসনে উপনির্বাচন হবে।
যে দেশে অধিকাংশ দল সংসদে কোনো আসনই পায় না, সে দেশে দুটি শূন্য আসনের উপনির্বাচন হেলাফেলার বিষয় নয়। পঞ্চাশের দশকে টাঙ্গাইল উপনির্বাচনে তরুণ নেতা শামসুল হকের (আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক) জয়ই পরবর্তীকালে মুসলিম লীগের পতন ত্বরান্বিত ঘটিয়েছিল। আবার খালেদা জিয়ার প্রথম শাসনামলে মাগুরা উপনির্বাচনে কারচুপির কারণে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়েছিল বিএনপিকে। ২০১৪ সালে বিএনপি নির্বাচনে না গিয়ে মারাত্মক ভুল করেছে এবং আগামী নির্বাচনে না গেলে তাদের অস্তিত্ব থাকবে না বলে আওয়ামী লীগের যেসব নেতা আগাম ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন, তাদের কাছে সবিনয় নিবেদন, বিএনপি নিয়ে এত চিন্তা না করে নিজের ঘরে তাকান। আপনারা যে নারায়ণগঞ্জ মডেলে নির্বাচন করার কথা বলছেন, সেটি গাইবান্ধা ও সুনামগঞ্জ উপনির্বাচন দিয়েই শুরু করুন। গণতন্ত্রের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য উপনির্বাচনেই বিএনপিকে নিয়ে আসুন। স্থানীয় সরকার সংস্থার নির্বাচনে দলটি যেহেতু অংশ নেয়, সেহেতু উপনির্বাচনেও তারা অংশ নিতে পারে। সবার অংশগ্রহণে উপনির্বাচন হলে নুরুল হুদা কমিশনের ভূমিকাটিও স্পষ্ট হবে তারা সত্যি সত্যি নিরপেক্ষ, না কারও প্রতি পক্ষপাত আছে। আর সরকারের জন্য পরীক্ষা হবে তারা নারায়ণগঞ্জ মডেল নির্বাচন চায়, না মাগুরা মডেলে। বিদায়ী নির্বাচন কমিশনের প্রধান কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ তাঁর শেষ সংবাদ সম্মেলনে যেভাবে নিজের ‘কৃতিত্ব’ ও ‘সাফল্যের’ বর্ণনা করে গেলেন, তা কে এম নুরুল হুদার নেতৃত্বে গঠিত কমিশনের জন্য কাজ করা আরও কঠিন করে তুলল। দেশের জনগণ তাঁদের ভোট রকিব কমিশনের কাছে আমানত রেখেছিল,
সেটি তারা অনেকাংশে খেয়ানত করে বিদায় নিয়েছে। তারপরও নিজেদের সফল বলে দাবি করা হাস্যকরই বটে। এই কমিশনের ভাগ্য ভালো যে তারা বিএনপির মতো একটি ‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ বিরোধী দল পেয়েছিল। বিরোধী দলে আওয়ামী লীগ থাকলে তাদের বিদায় এম এ আজিজ কমিশনের চেয়ে উত্তম হতো, সে কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অনেকেই ধারণা করেছিলেন, নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের পর নির্বাচন কমিশন নিয়ে বিতর্কের আপাত অবসান ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি এবং ঘটার সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। কমিশন নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে বাগ্যুদ্ধ চলতে থাকবে। রাজনীতি যে এখন আর সংসদে নেই, সেটি আমাদের মাননীয় সাংসদেরাও প্রমাণ করে চলেছেন। অতীতে বছর শুরুর সংসদ অধিবেশনের জন্য সরকারি ও বিরোধী দলের সাংসদেরা উন্মুখ হয়ে থাকতেন রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর বক্তব্য রাখার জন্য। এই সুযোগে তাঁরা নিজ নিজ এলাকার সমস্যা তুলে ধরার সুযোগ পেতেন। কিন্তু এবার সংসদ অধিবেশনটি নিয়ে খোদ সাংসদেরাই আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছেন। পেছনের আসনগুলো প্রায়ই খালি থাকতে দেখা যায়।
সুরঞ্জিতের অপূর্ণ বাসনা
জাতীয় সংসদের প্রসঙ্গ উঠলে আওয়ামী লীগের সদ্য প্রয়াত নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের কথা মনে পড়ে। তিনি সরকারি দলে থাকুন আর বিরোধী দলে থাকুন, তাঁর বক্তব্য শোনার জন্য সবাই উদ্গ্রীব থাকতেন। সংসদে এখন আর তাঁর সেই হাস্যকৌতুক মেশানো বক্তব্য এবং মন্ত্রী-নেতাদের প্রতি তির্যক মন্তব্য শোনা যাবে না। সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের মৃত্যুর পর দলমত–নির্বিশেষে সবাই বলেছেন, তাঁর মতো দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ানের অভাব সহজে পূরণ হওয়ার নয়। সংসদীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রবেশ স্বাধীনতার আগেই। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের গণজোয়ারের মধ্যেও তিনি ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ (মোজাফফর) থেকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার পর গঠিত গণপরিষদে তিনি ও পাহাড়ি নেতা এম এন লারমা ছিলেন বিরোধী দলের বলিষ্ঠ কণ্ঠ। কিন্তু ১৯৭৩ সালের সংসদে তিনি নির্বাচিত হতে পারেননি অথবা হতে দেওয়া হয়নি। পরবর্তী প্রায় সব সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত যখন বিরোধী দলে ছিলেন, সরকারি দল তাঁকে প্রচণ্ড ভয় পেত। আর সরকারি দলে থাকতে মন্ত্রীরা তটস্থ থাকতেন কখন আক্রমণের তিরটি তাঁদের ওপর এসে পড়ে। তাঁর ‘ক্ষণস্থায়ী মন্ত্রিত্ব’ নিয়ে যত বিতর্কই থাকুক না কেন,
সত্য বলায় তিনি ছিলেন অকপট। নব্বই দশকের শুরুতে যখন তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেননি, তখন একবার টিভিতে জিয়াউর রহমানের প্রশংসা করায় তাঁর বাসায় ইটপাটকেলও পড়েছিল। সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাসের আগে সংসদে যে বিশেষ কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার যুগ্ম আহ্বায়ক ছিলেন সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। সে সময়ে তিনি সংবিধানের চার মৌলনীতি ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছিলেন। প্রথম আলোর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘কতগুলো বিষয় আছে, যা নিয়ে বিতর্ক বা আলোচনার সুযোগ নেই। যেমন: আমাদের স্বাধীনতা এসেছে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রও কিন্তু আলোচনার মাধ্যমে আসেনি; এসেছে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। এই ঘোষণার ভিত্তিতেই ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। মনে রাখতে হবে, সংবিধান সেই মুক্তিযুদ্ধেরই ফসল।...স্বাধীনতার ৪০ বছর পর দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃস্থাপিত হতে যাচ্ছে।’ প্রায় পাঁচ বছর আগে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃস্থাপনে যে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করেছিলেন, তা অপূর্ণই রয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ প্রবর্তিত বাহাত্তরের সংবিধান থেকে বাংলাদেশ এখনো অনেক দূরে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.