বৈশ্বিক অর্থনীতির বিস্ময়কর ঘুরে দাঁড়ানো

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যে যে অনভিপ্রেত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো, তাতে কেউ হয়তো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, ইতিমধ্যে চ্যালেঞ্জের মুখে থাকা বিশ্ব অর্থনীতি শিগগিরই আরও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কিন্তু আমরা ২০১৭ সালে যখন প্রবেশ করলাম, তখন যেসব তথ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে আসছে, তাতে পরিস্থিতি ভিন্ন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। গোল্ডম্যান স্যাকসের যখন প্রধান অর্থনীতিবিদ ছিলাম, তখন থেকেই আমি বিশ্ব অর্থনীতির ছয়টি সূচকে চোখ রাখতে শুরু করি। বিষয়টা হচ্ছে, এগুলো একত্র করলে বোঝা যায়, বৈশ্বিক অর্থনীতি আগামী ছয় মাস কেমন যাবে। ঠিক এ মুহূর্তে দেখতে পাচ্ছি, নিকট অতীতের তুলনায় এই ছয়টি সূচক আমাদের অধিকতর অঙ্গীকারের জানান দিচ্ছে। আর সম্প্রতি মাত্র একটি সূচক কিছুটা উচ্চপর্যায় থেকে নিচে পড়ে গেছে। প্রথম সূচকটি হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাপ্তাহিক বেকারত্বের পরিসংখ্যান, যাতে তারা দাবি করেছে, সেখান থেকে কেউ যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির সামগ্রিক শক্তি যাচাই করতে পারে। বেকারত্ব যে পিছিয়ে থাকার সূচক, সে ব্যাপারে অর্থনীতিবিদদের যথাযথ প্রশিক্ষণ আছে। কিন্তু এই সূচক দিয়ে নিকট ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা যায়।
যুক্তরাষ্ট্রের বেকারত্বের এই পরিসংখ্যান সব সময় হালনাগাদ করা হয়, কারণ প্রতি সপ্তাহেই তা প্রকাশ করা হয়। আর পরিসংখ্যানই প্রমাণ দেয়, এটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইক্যুইটি মূল্যের শীর্ষ সূচক। গত সপ্তাহে দেখা গেল, বেকারত্বের পরিসংখ্যান যথেষ্টই নিম্নমুখী, কয়েক দিন ধরেই এমনটা দেখা যাচ্ছে, যা মার্কিন শেয়ার বাজারের জন্য ভালো। একইভাবে, ইনস্টিটিউট ফর সাপ্লাই ম্যানেজমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারিং ইনডেক্সে আগামী তিন থেকে ছয় মাসের মধ্যে মার্কিন অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক প্রাক্-বীক্ষণ করা হয়েছে। যদিও উৎপাদনমুখী শিল্প তুলনামূলকভাবে জিডিপির খুবই ক্ষুদ্র এক অংশ। বেকারত্বের সর্বশেষ পরিসংখ্যানের মতো আইএসএমের সংখ্যা বর্তমানে আশাবাদের কারণ হয়ে উঠছে। তৃতীয় সূচকটি সেই আইএসএম জরিপের একটি আনুষঙ্গিক উপাদান: উৎপাদকদের নতুন আদেশ ও ইনভেনটরি। এই মুহূর্তে নতুন আদেশের সংখ্যা বাড়ছে ও ইনভেনটরি নিম্নমুখী। এটা এই ইঙ্গিত দেয় যে, এই আদেশ বাস্তবায়নে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে অধিক উৎপাদন করতে হবে। এবার যুক্তরাষ্ট্রের বাইরে চোখ রাখি, যেটাকে চতুর্থ সূচক বলা যেতে পারে। সেটা হলো, শিল্প উৎপাদনের তুলনায় চীনাদের খুচরা পণ্য বাবদ ব্যয়। এসব পরিসংখ্যান আমাদের একঝলকে অর্থনীতির চক্রাকার-প্রবণতা ও চীনের কাঠামোগত পুনর্বিন্যাস সম্পর্কে ধারণা দেয়। আমরা বুঝতে পারি,
চীন রপ্তানি থেকে সরে গিয়ে অভ্যন্তরীণ ভোগের দিকে যাচ্ছে। তর্কযোগ্যভাবে বলা যায়, এই সূচকটি সামনের বছরগুলোতে চীন ও বাকি পৃথিবীর অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সূচকে পরিণত হবে। শিল্প উৎপাদনের সাপেক্ষে চীনাদের খুচরা পণ্য বাবদ ব্যয়ের মধ্যে একধরনের অনিশ্চয়তা থাকলেও ২০০৮ সাল থেকে তাদের খুচরা পণ্য বাবদ ব্যয় বাড়ছে। এমনকি সম্প্রতি চীনাদের ভোগ-ব্যয় আরও এক দফা বেড়েছে। আর তাই যাঁরা প্রায়ই চীনা অর্থনীতির ঝুঁকির কথা বলেন, তাঁদের মতো আমি অতটা উদ্বিগ্ন নই। দেশটির শিল্প উৎপাদন ও বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়া এবং বিলাসবহুল পণ্য ক্রয়ে সরকার নিরুৎসাহিত করা সত্ত্বেও চীনাদের ভোগ-ব্যয় বেড়েছে। কেউ হয়তো আপত্তি করবেন, চীনাদের তথ্যে আস্থা রাখা যায় না। কিন্তু আমি এটা বুঝে উঠতে পারি না, একটি অনুপাতের একাংশের তথ্য বিশ্বাসযোগ্য হলে অপর অংশের তথ্য বিশ্বাসযোগ্য হবে না কেন। কথা হচ্ছে, তারা যদি শিল্প-উৎপাদন হ্রাসের তথ্য দিতে পারে, তাহলে ভোগ–ব্যয় নিয়ে তথ্যবিভ্রাট ঘটাবে কেন। যা হোক, আমাদের হাতে যে তথ্য আছে, তা নিয়েই আমাদের কাজ করতে হবে। পঞ্চম সূচকটি হচ্ছে দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্যসংক্রান্ত তথ্য। প্রতি মাসের প্রথম দিন বাণিজ্য শেষ হওয়ার পর নিয়মিতভাবে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়, যা অন্য যেকোনো দেশের তুলনায় দ্রুততর। দেশটির অর্থনীতি উন্মুক্ত। পৃথিবীজুড়েই তাদের বাণিজ্য-সহযোগী আছে, যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। ফলে তাদের বাণিজ্যবিষয়ক তথ্যাদি দেখে সিদ্ধান্ত টানা যায়, বৈশ্বিক বাণিজ্যের অবস্থা কী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নিম্নমুখী থাকার পর দক্ষিণ কোরিয়ার বাণিজ্য নভেম্বর থেকে ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, তার রপ্তানি প্রবৃদ্ধি। এই জানুয়ারিতে দেশটির রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। নিশ্চিতভাবেই এই প্রাপ্তি বিশ্বায়ন-সংক্রান্ত যেসব কথা আজকাল শোনা যায়, তার সঙ্গে বেমানান। ফলে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সুরক্ষাবাদী প্রশাসন এখন বৈশ্বিক বাণিজ্যকে দীর্ঘ নির্বাসনে পাঠাতে পারে।
কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়ার সাম্প্রতিক তথ্য-উপাত্ত আমাদের এই ইঙ্গিত দেয় যে, এখনো বিশ্বায়নের জীবনপ্রদীপ একেবারে নির্বাপিত হয়ে যায়নি। আর ২০১৭ সালের শুরুটাও ভালো হলো। বস্তুত ট্রাম্প প্রশাসনের জামানায় সবচেয়ে খারাপ কিছু ঘটলেও এটা সম্ভব যে সাম্প্রতিক এই ধীরগতি ক্ষণস্থায়ী ব্যাপার হবে। হয়তো একটা ব্যাপারই ঘটবে, যার মধ্যে বহু কিছুর সমাবেশ হবে, এর মধ্যে যেমন ইউরোর সংকট থাকতে পারে, তেমনি ইউরোপীয় দেশে চলমান অর্থনৈতিক দুর্বলতা, পণ্যের দামের দ্রুত পতন, ব্রাজিল-রাশিয়াসহ অন্যান্য বর্ধিঞ্চু অর্থনীতির দ্রুত পতন এবং আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর ওপর কড়া নিয়মকানুন আরোপ, যার কারণে বাণিজ্যে অর্থায়ন বাধাগ্রস্ত হতে পারে। শেষ সূচকটি হচ্ছে, জার্মানির ইফো বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স, যার মধ্যে সামগ্রিকভাবে ইউরোপের জন্য সহায়ক তথ্য রয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, জার্মানি ইউরোপ মহাদেশের অর্থনৈতিক কেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি কয়েক মাসে ইফো জরিপে ইতিবাচক ফলাফল দেখা গেছে, যদিও এই তথ্য-উপাত্ত জানুয়ারির চেয়ে ডিসেম্বরেই বেশি প্রতিশ্রুতিশীল ছিল। এসব সূচক একত্র করলে আমি এই ইঙ্গিত পাই যে, বৈশ্বিক অর্থনীতি এখন ৪ শতাংশের বেশি হারে বাড়তে পারে। গত কয়েক বছরের মধ্যে এটাই প্রবৃদ্ধির সবচেয়ে বেশি হার হবে। যদিও গত দশকে প্রবৃদ্ধির গড় হার ছিল ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, যা আগের দশকের গড় হারের চেয়ে খুব একটা কম ছিল না। একই সঙ্গে, এই ছয়টি সূচক দেখে আমরা বলতে পারব না, আগামী কয়েক মাসের পর কী ঘটবে। ব্যাপারটা হচ্ছে, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শক্তিশালী থাকবে, নাকি আরও শক্তিশালী হবে, নাকি তার গতি কমে যাবে, এটা এক উন্মুক্ত প্রশ্ন। এটা কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার যে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিট ও ট্রাম্পের নির্বাচিত হওয়ার পরও বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে। তবে কেন এমনটা ঘটছে তা পরিষ্কার নয়। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের হাতে এমন কোনো সূচক নেই যা দিয়ে আমরা বলতে পারি, এ কারণে এমনটা হচ্ছে। শুধু সময়ই আমাদের বলে দেবে, কেন এমন ঘটছে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জিম ও’নিল: গোল্ডম্যান স্যাকসের সাবেক চেয়ারম্যান।

No comments

Powered by Blogger.