সিন্ডিকেট ভাঙতে চিনি আমদানি উন্মুক্ত হচ্ছে

সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে বাণিজ্যিকভাবে চিনি আমদানি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হচ্ছে। এতে দেশে চিনি পরিশোধন ও বাজারজাতে সক্রিয় ছয় কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা থাকছে না। নতুন সিদ্ধান্তে আমদানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট যে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান প্রয়োজনীয় নীতি অনুসরণ করে চাইলেই যে কোনো পরিমাণে চিনি আমদানি করতে পারবে। তবে এ ব্যবস্থায় দেশে অপরিশোধিত চিনি আমদানিকে নিরুৎসাহিত করা হবে। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
সূত্র জানিয়েছে, চিনির আন্তর্জাতিক ও দেশীয় বাজার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে সরকার। মাত্র দেড় মাসের ব্যবধানে পণ্যটির আন্তর্জাতিক বাজারদর প্রতি টন ৩৩০ ডলার থেকে ৫২০ মার্কিন ডলার ওঠানামা করছে। এর প্রভাব পড়েছে দেশীয় বাজারে। রোজায় প্রতি কেজি চিনি বিক্রি হয়েছে ৬৫-৬৭ টাকা দরে। এখন খুচরা বাজারে সেই দর চড়েছে ৭২-৭৫ টাকায়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের দোহাই দিয়ে পরিশোধন কোম্পানি থেকে শুরু করে বাজারজাতকারী সব স্তরেই মজুদ সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছে। এসব মাধ্যম থেকে দেশীয় বাজারে দর ৯০ টাকা থেকে ১০০ টাকায় স্পর্শ করারও আভাস দেয়া হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান পরিকল্পিতভাবে উৎপাদন সক্ষমতার চেয়ে অনেক কম চিনি পরিশোধন করছে। একইভাবে অসৎ উদ্দেশ্যেই বাজারে চিনি ছাড়া হচ্ছে কম। আর এ সুযোগেই অস্থির হচ্ছে চিনির বাজার। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পূর্বাভাস সেল চিনির দেশীয় মজুদ ও আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণে রেখেছে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের আমদানি অনুবিভাগ চিনি আমদানি নিয়ে নতুন হিসাব-নিকাশ কষছে। এই সার্বিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা এবং করণীয় ঠিক করতে আজ জরুরি বৈঠকে বসছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাণিজ্য সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, ট্যারিফ কমিশন, আমদানি-রফতানি নিয়ন্ত্রক বিভাগ, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা এবং এফবিসিসিআইয়ের মনোনীত প্রতিনিধিদের উপস্থিত থাকার কথা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, সরকার বাজারকে তার স্বাভাবিক আচরণের ওপরই চলতে দিতে চায়। তবে ভোক্তার বৃহৎ স্বার্থের বিষয়টিও সতর্কভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। বাজার ব্যবস্থায় সরকারের সংযত আচরণের সুযোগ নিয়ে কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান অনৈতিক তৎপরতায় জড়িয়ে পড়লে অথবা সিন্ডিকেটের অস্তিত্ব প্রতীয়মান হলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পিছপা হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রের কাছে কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী অপরিহার্য নয়। আইন সবার জন্য সমান। মুষ্টিমেয় লোকের স্বার্থরক্ষার দায়িত্ব সরকারের নয়। ১৬ কোটি ভোক্তার স্বার্থরক্ষায় যা যা করণীয়, তার সবকিছুই করবে সরকার। তিনি জানান, পরিশোধিত চিনি আমদানির বিষয়টি সবার জন্য উন্মুক্ত করার ব্যাপারে গভীরভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সুগার রিফাইনারি অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, দেশে ৬টি রিফাইন্ড সুগার ইন্ডাস্ট্রিজের বাৎসরিক চিনি উৎপাদনক্ষমতা রয়েছে ৩১ লাখ ৫০ হাজার টন। সিটি গ্র“পের উৎপাদনক্ষমতা ৫ হাজার টন। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিষ্ঠানটির উৎপাদনক্ষমতা ৩ হাজার টনে নেমে এসেছে। মেঘনা গ্রুপের উৎপাদন ক্ষমতা ২ হাজার টন।
এ ছাড়া আবদুল মোনেম সুগার মিলের উৎপাদনক্ষমতা ১ হাজার টন, এস আলম রিফাইনারির ১ হাজার টন এবং দেশবন্ধুর দৈনিক ৫০০ টন চিনি উৎপাদন সক্ষমতা রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, এসব কোম্পানি এখন চিনির এলসি খোলার হার কমিয়ে দিয়েছে। মজুদকৃত চিনিও বাজারে কম ছাড়ছে। ফলে ব্যবসায়ীরা এখন ডিও দেয়ার এক থেকে দেড় মাসেও চিনি পাচ্ছেন না। এমনকি কোম্পানিগুলোর কাছে ডিও’র টাকা অগ্রিম পরিশোধ করার পরও অনেককে চিনি পাওয়ার জন্য ক্ষমতাধর বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তদ্বির নিতে হচ্ছে। কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানের কারসাজির কাছে অসহায় হয়ে পড়েছেন ১৬ কোটি ভোক্তা। এখন দেখতে হবে সরকারের কাছে দেশের জনগণ মুখ্য, না গুটিকয়েক ব্যক্তি বড়। যদি জনগণই মুখ্য হয়, তবে বাজারে এ অনৈতিক তৎপরতার রাশ টেনে ধরতেই হবে। ভেঙে দিতে হবে একচেটিয়া ব্যবসার সিন্ডিকেট। এ ক্ষেত্রে সরকার পরিশোধিত চিনি আমদানি সবার জন্য উন্মুক্ত করার যে চিন্তা-ভাবনা করছে, সত্যিকার অর্থেই কার্যকর হলে ভোক্তাস্বার্থের জন্য তা এক বিরাট মাইলফলক।

No comments

Powered by Blogger.