উত্তর-পূর্ব ভারত: কাছে থেকেও কত দূরে!

১৯ জুলাই মেঘালয় থেকে বাংলাদেশে ফিরতে ডাউকি স্থলবন্দরে কথা হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তার সঙ্গে। তাঁকে জিজ্ঞেস করি, এই বন্দর দিয়ে প্রতিদিন কত মানুষ আসা-যাওয়া করে? তিনি সাগ্রহে নিবন্ধন বইটি দেখিয়ে বললেন, প্রতিদিন কয়েক শ মানুষ আসা–যাওয়া করে। আমার ধারণা ছিল, শুধু বাংলাদেশ থেকেই মানুষ ওপারে যায়। কিন্তু ওই কর্মকর্তা ভুল ভাঙিয়ে দিয়ে বললেন, দুই তরফেই যাতায়াত বেড়েছে। ওই দিনই একদল ভারতীয় ছাত্রছাত্রী বাংলাদেশে এসেছেন, যাঁরা এখানকার বিভিন্ন মেডিকেল কলেজে পড়েন। বাংলাদেশ থেকেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষার্থী শিলংয়ের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনা করেন। তবে শিক্ষার্থী বিনিময়ের এই প্রবণতা উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য রাজ্যে তেমন দেখা যায় না। আমরা ভারতের পশ্চিম অংশ থেকে শিক্ষার্থী টানতে না পারলেও উত্তর-পূর্বাঞ্চল থেকে পারব। একই কথা প্রযোজ্য স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে। আমরা যদি অভয় পরিবেশ তৈরি করতে পারি তাহলে পর্যটকমন্ত্রী রাশেদ খান মেননের ভাষায় ‘শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা পর্যটনেও’ বাংলাদেশ সফল হবে। কেননা, ত্রিপুরা বা মেঘালয়ের শিক্ষার্থী বা স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থীদের জন্য বাংলাদেশে আসা যত সহজ, আসাম বা ভারতের অন্য অংশে যাওয়া ততই কঠিন।
কেবল পর্যটন নয়, ব্যবসা-বাণিজ্যেও বাংলাদেশ উত্তর-পূর্ব ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হতে পারে। ভৌগোলিক দিক দিয়ে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটি রাজ্যের অন্তত চারটির সঙ্গে বাংলাদেশের সীমান্ত আছে—আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা ও মিজোরাম। এর মধ্যে মেঘালয়, আসাম ও ত্রিপুরার সঙ্গে রয়েছে দীর্ঘ সীমান্ত। যদিও ত্রিপুরা ছাড়া এসব রাজ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের যোগাযোগ খুবই কম। ১৫-১৬ জুলাই শিলংয়ে অনুষ্ঠিত নদী উৎসবে বাংলাদেশ ও ভারতের নীতিনির্ধারক, নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মী ও সংস্কৃতিসেবীরা সেই যোগাযোগ বাড়ানোর ওপরই জোর দিলেন। তাঁরা বললেন, সম্পর্কোন্নয়নের জন্য পরস্পরকে জানতে হবে, বুঝতে হবে। ভাবের আদান-প্রদান বাড়াতে হবে। ব্যবসা-বাণিজ্য ও বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতিযোগী নয় বরং পরিপূরক হিসেবে কাজ করতে হবে। অর্থাৎ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের পণ্য বাংলাদেশের মানুষের জন্য এবং বাংলাদেশি পণ্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষের জন্য সহজলভ্য করতে হবে। কোনো বাধা থাকতে পারবে না। ভারতের পশ্চিম অংশের সঙ্গে আমাদের বাণিজ্য অনেকটা একতরফা। সেখানে বাংলাদেশ থেকে যে পরিমাণ পণ্য যায়, আসে তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি। কিন্তু ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই উত্তর-পূর্ব ভারত হয়ে উঠতে পারে আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু সমস্যা হলো,
এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মালিক রাজ্য সরকার নয়, কেন্দ্রীয় সরকার। এ কারণে মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমা কিংবা ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী মানিক সরকার অনেক কিছু চাইলেও পারেন না। নদী উৎসবে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের প্রতিটি রাজ্যের সঙ্গে স্থল, বিমান, নৌ ও রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার দাবি উঠেছে। যোগাযোগব্যবস্থাকে সাতচল্লিশের আগের অবস্থায় না হলেও পঁয়ষট্টি সালের আগে যেখানে ছিল, সেখানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। ভূমিবেষ্টিত উত্তর-পূর্বাঞ্চলের দাবি, চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে পণ্য পরিবহনের। এ ব্যাপ​ারে বাংলাদেশেরও আপত্তি নেই। কিন্তু সমস্যা হলো রাস্তাঘাটগুলো খুবই নাজুক। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের মানুষ কেন বাংলাদেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে চায়? কেন বাংলাদেশি পণ্যের প্রতি তাদের আগ্রহ? কারণ, দেশটির পশ্চিমাঞ্চল থেকে যেকোনো পণ্য উত্তর-পূর্ব ভারতে নিতে (এমনকি বাংলাদেশের ওপর দিয়ে হলেও) যে খরচ পড়বে, বাংলাদেশে তৈরি সেই পণ্যের দাম তার চেয়ে কম হবে। এ কারণে সেখানে প্রাণসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের পণ্যের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হয়েছে। যেকোনো বড় শহরে প্রাণের পণ্যের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। কয়েক দিন আগে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলমের সঙ্গে আলাপকালে বিজেপির সাধারণ সম্পাদক রাম মাধব ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য বাংলাদেশকে অনুরোধ করেছেন। তাঁর প্রস্তাব,
ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বাংলাদেশ আরও নজর দিক। সেখানে আরও লগ্নি বাড়াক। একইভাবে ভারতের উদ্যোক্তাদেরও বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহী হতে হবে। তবে এ ক্ষেত্রে যেসব আইনি ও কাঠামোগত বাধা আছে, সেগুলো দূর করা জরুরি। শিল্পকারখানার কাঁচামাল ও উৎপাদিত পণ্যের সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে হবে। উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়াতে বাংলাদেশ বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। নৌ ও সড়কপথে পণ্য সরবরাহের জন্য আশুগঞ্জ স্থলবন্দরকে পোর্ট অফ কল ঘোষণা করা হয়েছে। ইতিমধ্যে বেশ কিছু পণ্য সেখানে পাঠানো হয়েছে। ত্রিপুরায় সহকারী হাইকমিশন খোলা হয়েছে। গুয়াহাটিতেও ডেপুটি হাইকমিশন খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ঢাকা-গুয়াহাটি সরাসরি বিমান পরিষেবা দেওয়ারও উদ্যোগ আছে। কিন্তু ভারতের পক্ষ থেকে আশু কোনো পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এমনকি আসামের সীমান্ত দিয়ে যেসব বাংলাদেশি পণ্য রপ্তানি হয়, তার মান পরীক্ষা করতে গুয়াহাটি পাঠাতে হয়। এতে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা আর্থিক ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। সীমান্তেই পণ্যের মান পরীক্ষার দাবি তাঁদের। অন্যদিকে গুয়াহাটিতে বাংলাদেশ মিশন না থাকায় একজন ভিসাপ্রার্থীকে আবেদন করতে কলকাতা বা আগরতলা যেতে হয়, যা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। এ ব্যাপারে আসাম ​ও মেঘালয়ের বাসিন্দারা যে বিকল্প ব্যবস্থার দাবি জানিয়েছে, সেটি হলো এজেন্সির মাধ্যমে বাংলাদেশ ভিসার আবেদনপত্র নেবে এবং পরে কলকাতা বা আগরতলা মিশন সেটি যাচাই–বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেবে।
পরে এজেন্সির মাধ্যমেই ফলাফল জানিয়ে দেবে। ইউরোপের অনেক দেশ এই পদ্ধতিতে ভিসার আবেদনপত্র নিতে পারলে বাংলাদেশ ও ভারত পারবে না কেন?  নদী উৎসবে আসা বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা ভিসাপদ্ধতি আরও সহজ করার যে দাবি জানিয়েছেন, তা কেবল যৌক্তিক নয়, জরুরিও।​ আশার কথা, ভিসাপদ্ধতি সহজ করতে ভারতের পক্ষ থেকে বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ব্যবসায়ীদের ভিসা পাঁচ বছর মেয়াদি করা হচ্ছে। মেডিকেল ভিসা দ্রুত পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু পর্যটকদের বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে ভাবতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কায়িক ও মনস্তাত্ত্বিক যেসব বাধা ছিল, তার অনেকটাই দূর করা হয়েছে। ভারতের তরফ থেকে প্রধান উদ্বেগ ছিল নিরাপত্তা নি​েয়। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো ভারতবিরোধী সশস্ত্র তৎপরতায় বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করত। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে এখানে কোনো সন্ত্রাসী গ্রুপকে প্রশ্রয় দেওয়া হচ্ছে না। এমনকি ভারতের অনুরোধে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া উলফার নেতাদের সীমান্ত দিয়ে ‘পুশব্যাক’ করা হয়েছে। ভারত সরকার এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক সন্তোষ প্রকাশ করলেও কোথায় যেন খানিকটা দ্বিধা আছে। বিএসএফের পক্ষ থেকে এখনো ‘সন্ত্রাসীদের’ তালিকা দেওয়া হয়। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে ওঠে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে। উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কোন্নয়নে যে আসাম সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, সেই আসামের সঙ্গেই কথিত অনুপ্রবেশ ইস্যুটি বড় বাধা হয়ে আছে।
আসামের রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনেও এটি ছিল অন্যতম ইস্যু। নির্বাচনে জয়ী ​বিজেপি নেতারা বলছেন, সীমান্ত সিল করে দেবেন। একদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে সংযোগ বাড়ানোর আহ্বান, অন্যদিকে সীমান্ত সিল করার আওয়াজ জনমনে সংশয় ও সন্দেহ তৈরি করে। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ ও অবিভক্ত আসামের যে ঐতিহাসিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন ছিল, সেটি অস্বীকার করা যাবে না। সাতচল্লিশের আগে বঙ্গের চাষিরাই আসামের পাথুরে মাটিতে ফসল ফলিয়েছেন, খনিতে, চা–বাগানে কাজ করেছেন। ইতিহাসবিদ জয়া চট্টোপাধ্যায় তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, আসামসহ অবিভক্ত বাংলায় যে অর্থনৈতিক যোগসূত্র ছিল, দেশভাগ সেটি ভেঙে দিয়েছে এবং তার অভিঘাত পড়েছে দুই দেশের মানুষের ওপরই। সীমান্ত দেশ ভাগ করলেও সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনধারাকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। তাই কথিত অনুপ্রবেশ সমস্যাটি নিছক ধর্মীয় কিংবা রাজনীতির সমীকরণে না ফেলে মানবিক দৃষ্টিতে দেখা উচিত। গত সপ্তাহে আসামের স্পিকার রণজিৎ কুমার দাস কিংবা মেঘালয়ের মুখ্যমন্ত্রী মুকুল সাংমার সঙ্গে কথা বলে মনে হলো, তাঁরা মনেপ্রাণে চান বাংলাদেশের সঙ্গে উত্তর–পূর্বাঞ্চলের সম্পর্কটি বহুমাত্রিক রূপ পাক। বিশেষ করে, বাংলাভাষী রণজিৎ কুমার দাস সীমান্তের দুই অংশের মানুষের অভিন্ন সংস্কৃতি, পোশাক ও খাদ্যাভ্যাসের কথা উল্লেখ করে বললেন, ‘আমরা উভয়ই ভূপেন হাজারিকার গানে উজ্জীবিত হই।’ তারপরও যে প্রশ্নটি থেকে যায় তা হলো, সীমান্তের দেয়াল পেরিয়ে সবার মাঝে গানের সেই চেতনা কবে সঞ্চারিত হবে?
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrabhassan55@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.