সরকার ইউনেসকো প্রতিনিধিদের কী বোঝাল? by বদরূল ইমাম

বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশীদার সুন্দরবন
গত ২২ মার্চ এক সপ্তাহের জন্য জাতিসংঘের ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টারের প্রতিনিধিদল সুন্দরবনের সন্নিকটে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ফলে সুন্দরবনে যে প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে জানতে বাংলাদেশ সফরে আসে। এর আগে ২০১৫ সালের জুলাই মাসে ইউনেসকো ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটি তার ৩৯তম অধিবেশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের ওপর যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে, সে বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বাংলাদেশ সরকারের কাছে তা নিরসনে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে, সে সম্পর্কে তথ্য জানতে চায়। ইউনেসকো প্রতিনিধিদলের সফর তারই ধারাবাহিকতায় সম্পাদিত হয়। পুরোপুরি সরকারি ব্যবস্থাপনা ও বেষ্টনীর মধ্যে ইউনেসকো প্রতিনিধিদলকে রামপাল ও সুন্দরবন এলাকা পরিদর্শন করাতে নিয়ে যাওয়া হয় এবং জনগণ বা সংবাদমাধ্যমগুলোকে পাশ কাটিয়ে এ সফরটি শেষ করা হয়। উল্লেখ্য, বিশ্বের সর্ববৃহৎ শ্বাসমূলীয় জলাবন (ম্যানগ্রোভ) সুন্দরবন অসংখ্য প্রজাতির প্রাণীর আবাসস্থল ও নির্মল সৌন্দর্যময় অনন্য চরিত্রের জন্য ইউনেসকো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ বা ‘বিশ্ব ঐতিহ্য’ মর্যাদা লাভ করে। জাতিসংঘের অন্য একটি সংস্থা রামসার সেক্রেটারিয়েটের পক্ষ থেকেও সরকারের কাছে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। এদিকে দেশের বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ, বিশেষজ্ঞ মহল তথা সব সচেতন নাগরিক একমত প্রকাশ করেন যে রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্প সুন্দরবনকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। এ ব্যাপারে সরকারের সাড়া পেতে ব্যর্থ হয়ে দেশের পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনকারী সংস্থা ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় সুন্দরবন রক্ষা কমিটি গঠন করা হয় এবং তা বিপুল জনসমর্থন লাভ করে। এর প্রেক্ষাপটে পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে জাতীয় সুন্দরবন রক্ষা কমিটি মার্চ মাসে সফররত ইউনেসকো প্রতিনিধিদলের সঙ্গে রামপাল ও সুন্দরবন বিষয়ে মতবিনিময় করার সুযোগ দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে একাধিকবার অনুরোধ করে। কিন্তু সরকারি মহলের পক্ষ থেকে এহেন কোনো সভা করার অনুমতির সাড়া মেলেনি। ইউনেসকো প্রতিনিধিদলের পক্ষ থেকে স্থানীয় নাগরিক সমাজের বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের সঙ্গে মতবিনিময়ের ইচ্ছা প্রকাশ করা হলেও সরকার এ ব্যাপারে নীরব থাকে। ইউনেসকো প্রতিনিধিদল ২৮ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করার আগে সুন্দরবন জাতীয় রক্ষা কমিটির কাছে লেখা পত্রে দুঃখ প্রকাশ করে জানায় যে যদিও তারা এ যাত্রায় নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মতবিনিময় করার সুযোগ পেল না, পরবর্তী সময়ে তারা যোগাযোগের মাধ্যমে মতবিনিময় করবে। জাতীয় সুন্দরবন রক্ষা কমিটি ও নাগরিক সমাজ ইউনেসকো প্রতিনিধিদলকে কী বলতে চেয়েছিল? নাগরিক সমাজের পক্ষে বিষয়গুলো খোলামেলাভাবে ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত এক নাগরিক সংলাপ অনুষ্ঠানে আলোচনায় নিয়ে আসা হয়। এতে সুন্দরবনের এত কাছে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করার বিপক্ষেই নাগরিক সমাজের বক্তব্য তুলে ধরা হয়, যার সারসংক্ষেপ নিম্নরূপ: দেশ ও বিদেশের বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদেরা তাঁদের বিজ্ঞানভিত্তিক যুক্তি দিয়ে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন যে রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সুন্দরবনের অপূরণীয় দূষণ ও ক্ষতিসাধন করবে। প্রত্যক্ষ প্রভাবসমূহ: প্রত্যক্ষভাবে যে দূষণ হবে, তার মধ্যে প্রধান হলো বায়ুদূষণ (মূলত নির্গত সালফার ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন অক্সাইড ও কার্বন ডাই-অক্সাইডজনিত), নদীর পানিদূষণ এবং কঠিন পদার্থদূষণ (নির্গত ভারী ধাতুতে দুষ্ট ছাইজনিত)। সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহার করে এসব দূষণ বন্ধ করা হবে বলে সরকারপক্ষ যে যুক্তি তুলে ধরার চেষ্টা করে, তা নেহাতই অপরিপক্ব। পৃথিবীব্যাপী চালু এ ধরনের টেকনোলজি কোথাও দূষণ বন্ধ করতে পারে না, তা কেবল আংশিকভাবে কমাতে পারে মাত্র। আর সুন্দরবনের মতো জীববৈচিত্র্যবাহী ও পরিবেশ সংবেদনশীল স্থানের জন্য এই আংশিক দূষণই বনাঞ্চল ধ্বংসের জন্য যথেষ্ট। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহারের জন্য পশুর নদের পানি ব্যবহার করা হবে। নদী থেকে পানি নেওয়া ও ব্যবহারের পর তার অংশবিশেষ গরম অবস্থায় নদীতে ফেলে দেওয়া উভয়েই পরিবেশের ক্ষতি করবে। অপর একটি বড় ক্ষতিকর দূষক কয়লা পোড়ানোর ফলে নির্গত ছাই, যার ভেতর অবস্থিত নানান ভারী ধাতু, যেমন পারদ বা মারকারি, লেড, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক ইত্যাদি পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে প্রতিবছর প্রায় ১০ লাখ টন বিষাক্ত ছাই নির্গত হবে। এ ছাই দিয়ে জমি ভরাট করা হবে ও বাকি অংশ ছাই পানির সঙ্গে মিশিয়ে পুকুর করে রাখা হবে, যা ‘অ্যাশ পন্ড’ নামে পরিচিত। বিশ্বের সব কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রেই ‘অ্যাশ পন্ড’ বড় এক পরিবেশ দূষক এবং স্বাস্থ্যহানির© উৎস হিসেবে বিজ্ঞানী ও পরিবেশবিদদের রোষানলে পড়ে। এর কারণ অসংখ্য উদাহরণ, যেখানে এই ‘অ্যাশ পন্ড’ থেকে বিষাক্ত ধাতু ও উপাদান ভূগর্ভে© প্রবেশ করে দূষণ ঘটিয়েছে, নদীর পানির সঙ্গে মিশে নদীকে দূষিত করেছে। রামপালে পশুর নদের তীরে তৈরি করা এই ‘অ্যাশ পন্ড’ উপরিউক্তভাবে যে দূষণ ঘটাবে, তা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন বিশেষজ্ঞ কর্তৃক সমালোচিত হয়েছে। পরোক্ষ প্রভাবসমূহ: পরোক্ষভাবে যে দূষণ ঘটবে, তার মধ্যে অন্যতম হলো সুন্দরবনের ভেতরে নদীপথে কয়লা পরিবহনের পথে উপচে পড়া কয়লার দূষণ (দুর্ঘটনাজনিত নয়), একই কারণে শব্দদূষণ, আলোদূষণ (রাতে), নদীর নাব্যতা বাড়াতে ড্রেজিং করার জন্য দূষণ এবং দুর্ঘটনাজনিত কয়লাদূষণ। উল্লেখ্য, রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিবছর ৪৭ লাখ টন (অর্থাৎ প্রতিদিন ১২ হাজার ৮০০ টন) কয়লা ব্যবহারের প্রয়োজন হবে। এ কয়লা বড় বড় জাহাজে সমুদ্র উপকূলবর্তী আকরাম পয়েন্ট পর্যন্ত আনা যাবে, বাকি ৬০ কিলোমিটার পথ ছোট জাহাজে করে সুন্দরবনের ভেতরে নদীপথে নেওয়া হবে। প্রায় ১০ হাজার টন কয়লা বহনকারী এই ছোট জাহাজগুলো বছরে ৪৭০ বার সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে কয়লা বহন করবে অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন একটির বেশি জাহাজ কয়লা নিয়ে সুন্দরবন পাড়ি দেবে। সরকারি ভাষ্য যে কয়লা পরিবহনের সময়, তা সম্পূর্ণভাবে ঢেকে নেওয়া হবে—তাই দূষণ হবে না, তা নেহাতই দায়সারা গোছের ব্যাখ্যা। কারণ, কয়লা নদীতে উপচে পড়ে মূলত দূষণ ঘটাবে তখন, যখন সুন্দরবনের ভেতর আকরাম পয়েন্টে বড় জাহাজ থেকে ছোট জাহাজে তা স্থানান্তর করা হবে এবং প্রকল্প স্থানে পৌঁছে আবার যখন তা খালাস করা হবে। অপর একটি পরোক্ষ দূষক নদী ড্রেজিং, তা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সুন্দরবনের দক্ষিণ প্রান্তে বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য বনের ভেতর নদীপথে ব্যাপকভাবে ড্রেজিং করা হচ্ছে, যা সুন্দরবনের পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা ড্রেজিংয়ের ফলে পরিবেশের জন্য ক্ষতির সমীক্ষা করার আগে ড্রেজিং না করার পরামর্শ দিলেও তা মানা হয়নি। আরও একটি দূষণের পথ হবে জাহাজ দুর্ঘটনা। উল্লেখ্য, গত এক বছরে যে দুটি কয়লাবাহী জাহাজ সুন্দরবনে নদীতে দুর্ঘটনায় ডুবে দূষণ করেছে, তাদের বহনকারী কয়লার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫১০ টন ও ১ হাজার ২৩০ টন। রামপালের জন্য কয়লাবাহী জাহাজগুলো প্রতিটিতে থাকবে ১০ হাজার টন কয়লা। এ ছাড়া তেলবাহী ও সারবাহী জাহাজ দুর্ঘটনায় সুন্দরবনের নদীগুলোতে যে সংখ্যায় জাহাজডুবি হয়ে থাকে, তার বিপরীতে সরকারি নির্লিপ্ততা এটি প্রমাণ করে যে সুন্দরবনের নদীপথ দুর্ঘটনা থেকে মোটেই সুরক্ষিত নয়। বিতর্কিত ইআইএ: রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সম্পাদিত এনভায়রনমেন্টাল ইমপ্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট (ইআইএ) বিতর্কিত হওয়ার কারণ স্পষ্ট। ইআইএ রিপোর্টটি সরকারের পক্ষে একপেশে, সুকৌশলে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশনার দোষে দুষ্ট। সর্বোপরি এটি কোনো নিরপেক্ষ সংস্থা কর্তৃক প্রণীত নয়, বরং সরকারের অধীন একটি সংস্থা (সিইজিআইএস) কর্তৃক প্রণীত। স্বাভাবিক কারণেই সংস্থাটি সরকারি নির্দেশ উপেক্ষা করে নিরপেক্ষ বিচারে তাদের মতামত ব্যক্ত করতে পারেনি। আরও বিস্ময়ের ব্যাপার হলো ইআইএ রিপোর্টটি করা হয়েছে ২০১৩ সালে, অথচ রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে তার বছর খানেক আগে। জমি অধিগ্রহণ করার পর সম্পাদিত ইআইএ প্রণয়ন করার উদ্দেশ্য যে কেবলই লোক দেখানো, তা বলার প্রয়োজন হয় না। শেষ কথা: দেশবাসীর ও একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থার গভীর উদ্বেগের বিপরীতে সুন্দরবন প্রশ্নে সরকারের নির্লিপ্ততা এবং যেকোনোভাবে রামপাল প্রকল্প বাস্তবায়নের সরকারপক্ষের দৃঢ়তায় সবাই বিচলিত। সুন্দরবনের মতো বিশ্ব ঐতিহ্য বহনকারী স্থানের অপূরণীয় ক্ষতি করে এমন একটি প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে বর্তমান সরকারের বহুবিধ উন্নয়ন পরিকল্পনা দেশের জন্য যে ইতিবাচক পথ সৃষ্টি করছে, তাকে বহুলাংশে ম্লান করে দেবে। জনগণকে আস্থায় নিয়ে দেশকে এগিয়ে যাওয়ার যে প্রবণতা বর্তমান সরকারের রয়েছে বলে আমরা বিশ্বাস করি, রামপাল-সুন্দরবন প্রশ্নে ইউনেসকো প্রতিনিধিদের নিয়ে রাখঢাক ও গোপনীয়তা তার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। হাজার বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে যে অনন্য সুন্দরবন তৈরি হয়েছে, তাকে পরিবেশবিনাশী কোনো কর্মকাণ্ড দ্বারা ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে দেওয়া যায় না। আমাদের আবেদন যে সুন্দরবন ধ্বংসকারী রামপাল কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র বাস্তবায়ন বন্ধ করে প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে স্থাপন করা হোক, যাতে সুন্দরবন সুরক্ষিত থাকে।

No comments

Powered by Blogger.