ভারত বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট করেনি:মুচকুন্দ দুবে

মুচকুন্দ দুবে
মুচকুন্দ দুবের জন্ম ভারতের ঝাড়খণ্ডে, ১৯৩৩ সালে। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫৬ সালে অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভের পর এক বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৭ সালে যোগ দেন ভারতীয় পররাষ্ট্র বিভাগে; কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তেহরান, জেনেভা, বার্ন, নিউইয়র্ক ও ঢাকায়। ১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ছিলেন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত ছিলেন জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি। ১৯৯১ সালে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে অবসর গ্রহণের পর ১৯৯২ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির অধ্যাপক ছিলেন। এখন তিনি দিল্লির কাউন্সিল ফর সোশ্যাল ডেভেলপমেন্টের প্রেসিডেন্ট। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মশিউল আলম প্রথম আলো: বাংলাদেশের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ এ দেশের স্বাধীনতার সময় থেকে। আশির দশকের শুরুতে আপনি ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে তিন বছর ছিলেন। তার আগে ও পরে আপনি অজস্রবার এ দেশে এসেছেন। আপনার এবারের আসার উপলক্ষটা কী? মুচকুন্দ দুবে: আমি লালনের কবিতা বা গানের বাণী বাংলা থেকে হিন্দিতে অনুবাদ করার একটা কাজ হাতে নিয়েছি। দিল্লির সাহিত্য আকাদেমি তাঁর ১০০ কবিতার হিন্দি অনুবাদ নিয়ে একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছে। আমার এবারের বাংলাদেশে আসা সেই কাজের উপলক্ষে। লালন অনুবাদ করতে গিয়ে আমি দেখেছি, তিনি অনেক আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত শব্দ ও শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন, যেগুলোর স্থানীয় ব্যঞ্জনা সঠিকভাবে অনুধাবন করা খুব প্রয়োজন। লালনের বিপুল পুনরুজ্জীবন ঘটেছে বাংলাদেশে, পশ্চিমবঙ্গে নয়; বাংলাদেশে অনেক গবেষক আছেন, যাঁদের অনেকে সারা জীবন ধরে এ নিয়ে গবেষণা করছেন। আমি এসেছি তাঁদের সম্পর্কে জানতে, তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এবং তাঁদের সঙ্গে আলোচনা-পরামর্শ করে আমার কাছে অস্পষ্ট বিষয়গুলো পরিষ্কার করে নিতে। এটাই আমার এবারের আসার একমাত্র লক্ষ্য। প্রথম আলো: আপনি কীভাবে বাংলা সাহিত্য, বিশেষ করে লালনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন? মুচকুন্দ দুবে: একদম ছেলেবেলা থেকে কাব্যসাহিত্যের প্রতি আমার আকর্ষণ। তুলসী দাসের অনেক কবিতা আমার মুখস্থ, গীতার অনেক অংশ আমার মুখস্থ...কাব্যসাহিত্যের আরও অনেক কিছুই আমার মনে আছে। এটা বেশ লক্ষ করার মতো একটা ব্যাপার যে পৃথিবীর অধিকাংশ ধর্মগ্রন্থ একই সঙ্গে মহৎ কাব্যগুণও ধারণ করে, গীতাও তা-ই। আমি অর্থনীতির ছাত্র ছিলাম, অর্থনীতি পড়িয়েছি, অর্থনীতিবিদ হিসেবে কাজ করেছি এবং পরে কূটনীতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। আবার এসবের মধ্যেই সারা জীবন ধরে কাব্যসাহিত্যের প্রতি আমার আগ্রহ বজায় থেকেছে। মনে আছে, আমি যখন পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএ অনার্স প্রথম বর্ষের ছাত্র, তখন গীতাঞ্জলির কবিতাগুলো অনুবাদ করেছিলাম হিন্দিতে। এটা ১৯৫৩ সালের ঘটনা। প্রথম আলো: সমকালীন পৃথিবী, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়ার জন্য লালন কতটা প্রাসঙ্গিক?  মুচকুন্দ দুবে: লালন পৃথিবীর এই অংশের মহত্তম সন্ত কবিদের একজন। আমি মনে করি উত্তর ভারতের সন্ত কবিদের ওপরে তাঁর স্থান। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া ভারতের অবশিষ্ট অংশে তাঁকে পরিচিত করানো হয়নি। পশ্চিমবঙ্গেও লালনের গান ও কবিতা নিয়ে সেই মাত্রায় কাজ হয়নি, যতটা করা হয়েছে বাংলাদেশে। আমার মনে হয়, আজকের বিভক্ত, সংঘাতময়, ঘৃণা-বিদ্বেষপূর্ণ পৃথিবীতে, যেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে, যেখানে শুধু এক ধর্মের মানুষের বিরুদ্ধে অন্য ধর্মের মানুষের ঘৃণা নয়, বরং একই ধর্মের বিভিন্ন গোত্রের মধ্যেও ঘৃণা-বিদ্বেষ ও সংঘাত চলছে, সেখানে লালন অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। কারণ, এই মানুষটি মানবজাতির ঐক্যের কথা ভেবেছিলেন, যা উৎসারিত হয়েছে তাঁর আধ্যাত্মিকতা থেকে এবং যা তাঁর গানে ও কবিতায় বারবার প্রতিফলিত হয়েছে। আমি মনে করি, লালন বাংলাদেশের জন্য যতটা প্রাসঙ্গিক, তার চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক ভারতের জন্য। কারণ বাংলাদেশের সুবিধা হলো, এ দেশের মানুষ মোটের ওপর হোমোজেনাস বা সমরূপ; বেশির ভাগ মানুষ একই ধর্মের, একই ভাষার, কম-বেশি একই সংস্কৃতির। কিন্তু ভারতের ভাবাদর্শগত ও ধর্মবিশ্বাসগত পার্থক্য ও মতভেদগুলো অনেক অনেক বেশি প্রকট। জাতপ্রথার অবশেষ ভারতে এখনো অত্যন্ত শক্তিশালী, অনেক মানুষ বৈষম্যের শিকার হচ্ছে ঐতিহ্যগতভাবে, বংশপরম্পরায়। তাই লালনের বাণী ভারতের জন্য বাংলাদেশের তুলনায় অনেক অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ও প্রাসঙ্গিক। এ কারণেই আমি লালনের প্রায় ১০০টি কবিতা অনুবাদ করতে উৎসাহিত হয়েছি। প্রথম আলো: আপনি কবে প্রথম বাংলাদেশে আসেন? মুচকুন্দ দুবে: ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার ঠিক পরেই। আমি তখন জাতিসংঘে কর্মরত ছিলাম, এসেছিলাম জাতিসংঘের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্বাসন ও দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্য কী ধরনের সহযোগিতা প্রয়োজন, তা নিরূপণ করাই ছিল ওই সফরের উদ্দেশ্য। মনে আছে, আমি তখন ঢাকার পূর্বাণী হোটেলে উঠেছিলাম। কারণ অন্য যে একমাত্র হোটেলটি ছিল, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সেখানে বিপুলসংখ্যক মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। আমি দুই সপ্তাহ ছিলাম, সংসদ সদস্যরাসহ যেসব ব্যক্তি উন্নয়ন খাতের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন, তাঁদের সঙ্গে আমার আলাপ-আলোচনা হয়েছিল, আমি একটা প্রতিবেদন তৈরি করেছিলাম। প্রথম আলো: পরে আপনি ভারতীয় হাইকমিশনার হিসেবে তিন বছর ঢাকায় ছিলেন, কূটনীতিক হিসেবে আপনি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে কাজ করেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে এ বিষয়ে আপনি দৃষ্টি রেখে আসছেন। দুই দেশের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ কী? মুচকুন্দ দুবে: আমার ধারণা, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় ভালো। এর প্রধান কারণ, দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাস অনেক দৃঢ় হয়েছে। আস্থা সৃষ্টি হলেই সাহসী উদ্যোগ নেওয়া যায়, বড় কাজ করা যায়। আস্থার সম্পর্কটা গড়ে উঠেছে বিশেষত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে। সেই আস্থার ভিত্তিতে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ভারতের কিছু বড় উদ্বেগের বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছে। প্রথম আলো: যেমন? মুচকুন্দ দুবে: আপনি জানেন, যেকোনো দেশের সবচেয়ে বড় ভাবনার বিষয় তার নিরাপত্তা। এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের উদ্বেগ নিরসনের জন্য আওয়ামী লীগ সরকার যথাযথভাবে কাজ করেছে। আমার মতে, দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়নের এটাই প্রধান ভিত্তি। প্রথম আলো: আমাদের এখানে এমন একটা অনুভূতি আছে যে বাংলাদেশ ভারতের জন্য সব করেছে, কিন্তু ভারত তার প্রতিদান দেয়নি। কেউ কেউ বলেন, ভারত শুধু নিয়েছে, কিছুই দেয়নি। আপনি কী বলেন? মুচকুন্দ দুবে: এ বিষয়ে আমার মত, ভারত বাংলাদেশকে প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করেছে, কিন্তু যথেষ্ট করেনি এবং কার্যকরভাবে করেনি। তা যদি যথেষ্ট মাত্রায় ও কার্যকরভাবে করা না হয়, তাহলে আমার মনে হয় সুসম্পর্কের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা কঠিন হবে। অনেক বিষয়ে অতীতে আমি অনেক কথা বলেছি, যেগুলো এখন সত্য প্রমাণিত হচ্ছে। যেমন, আশির দশকের শুরুতে আমি যখন ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনারের দায়িত্ব পালন করছিলাম, তখন বলেছিলাম, ভারতের উচিত বাংলাদেশকে একতরফা মুক্তবাণিজ্যের সুবিধা দেওয়া। বাংলাদেশের পণ্যের জন্য ভারতের বাজার সম্পূর্ণভাবে খুলে দেওয়া উচিত। দরকার সব ধরনের প্রতিবন্ধকতা তুলে নেওয়া। আমাদের বাজারকে বাংলাদেশের বাজার করে তোলা। ভারতকে এটা করতে হবে বাংলাদেশের কাছ থেকে এর কোনো প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই। শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বলে আবার যদি শুল্কযুক্ত পণ্যের আলাদা তালিকা রাখা হয়, সেই ‘নেগেটিভ লিস্টে’ যদি হাজার খানেক পণ্য থাকে, তাহলে সেটা কোনো কাজের কথা নয়। কোনো নেগেটিভ লিস্ট থাকা উচিত নয়। এসব কথা আমি অজস্রবার অনেক জায়গায় বলেছি এবং লিখেছিল। আমি খুশি যে সম্প্রতি ভারত নেগেটিভ লিস্ট তুলে নিয়েছে। মনমোহন সিংয়ের সময় থেকেই এ তালিকা ধীরে ধীরে ছোট করা হয়েছে, এখন নেগেটিভ লিস্টে প্রায় কিছুই নেই। প্রথম আলো: বাণিজ্য ছাড়া আর কোনো ভারতের করণীয় নেই? মুচকুন্দ দুবে: আমি বহু বছর ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক সমতাপূর্ণ ও টেকসই হতে পারবে না, যদি আমরা বাংলাদেশকে আমাদের সঙ্গে বাণিজ্য করার জন্য সক্ষম করে না তুলি। বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের শিল্প খাত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি শুরু থেকেই জোর দিয়ে বলে আসছি যে ভারতের উচিত বাংলাদেশের রপ্তানিশিল্প, অন্যান্য শিল্প ও অবকাঠামো খাতে ব্যাপকভাবে বিনিয়োগ করা। অতীতে আমি বলেছিলাম, চার থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা উচিত। এটা আমি বলেছিলাম ১০-১৫ বছর আগে। এখন এটা বাস্তবায়িত হতে চলেছে, এখন দু-তিন বিলিয়ন বিনিয়োগ করা হচ্ছে। কিন্তু আমি মনে করি, এটাও যথেষ্ট নয়। এখনো এটা খুবই ক্ষুদ্র বিনিয়োগ। আমাদের সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হলে, অব্যাহত রাখতে হলে বিনিয়োগ এর তিন-চার গুণ বাড়াতে হবে। প্রথম আলো: আমাদের সুন্দরবনের কাছে রামপালে ভারতীয় বিনিয়োগে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন প্রকল্পের বিরুদ্ধে এ দেশে প্রবল আপত্তি আছে। পরিবেশ বিশেষজ্ঞ ও নাগরিক সমাজের এক বিশাল অংশ বলছে, এর ফলে সুন্দরবনের পরিবেশ বিপন্ন হবে। সুন্দরবনের পশ্চিমবঙ্গ অংশ থেকে ২৪ কিলোমিটার দূরেও এ ধরনের প্রকল্প অনুমতি পায়নি, অথচ বাংলাদেশের রামপালে এটা করা হচ্ছে মাত্র ১৪ কিলোমিটার দূরে। এটা ভারতের ব্যাপারে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। মুচকুন্দ দুবে:এ বিষয়ে আমারবক্তব্য হলো, এই বিদ্যুৎকেন্দ্র কোথায় স্থাপন করা হবে, সে সিদ্ধান্ত একান্তভাবেই বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের বিষয়। বাংলাদেশ সরকারের ওপর ভারত সরকারের বা ভারতের এ সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। যদি বাংলাদেশ সরকার মনে করে প্রকল্পটি অন্য কোনো জায়গায় স্থাপন করা যায়, তাহলে সেটা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় নেওয়া উচিত। আমি অবশ্য এ বিষয়ে অবগত নই। তবে একটি বিষয়ে আমি নিশ্চিত যে প্রকল্পের জায়গা নির্বাচন করা এবং সেখানে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ করতে বলার একক এখতিয়ার বিনিয়োগে আমন্ত্রণকারী দেশেরই। প্রকল্পের জায়গা নির্বাচন করা একটা বিষয়, আরেকটা বিষয় খোদ প্রকল্পটিই। যদি কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়েই বাংলাদেশে আপত্তি থাকে, তাহলে এটা বেশ সমস্যাপূর্ণ ব্যাপার, কারণ এ বিষয়ে দ্ব্যর্থকতা আছে। খোদ ভারতেই বিরাট বড় বড় তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলা হচ্ছে। আমার মনে হয়, প্রকট জ্বালানি সংকটে ভুগছে এমন যেকোনো দেশের জন্য সঠিক জ্বালানিনীতি হবে মিশ্র উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের নীতি। প্রথম আলো: যাঁরা রামপালের বিরোধিতা করছেন, তাঁরা কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরোধিতা করছেন না। তাঁরা শুধু বলছেন, রামপালে করলে সুন্দরবনের ক্ষতি হবে, এই প্রকল্প অন্য কোথাও সরিয়ে নেওয়া হোক। মুচকুন্দ দুবে: আমি আবারও বলছি, এইসিদ্ধান্ত সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ সরকারের নেওয়ার বিষয়। প্রথম আলো: দক্ষিণ এশিয়ার অন্যদেশগুলোর সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক, বিশেষত পাকিস্তান ও অতি সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে নেপালের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলুন। মুচকুন্দ দুবে: দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে অবস্থা সার্ক গঠনের সময় যেমন ছিল, এখন তার থেকে বেশি পরিবর্তিত হয়নি। আঞ্চলিক সংহতি জোরদার করার ক্ষেত্রে সার্কের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ কোনো অগ্রগতি ঘটেনি। সবচেয়ে বড় সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার সম্পর্ক। পৃথিবীতে কোনো আঞ্চলিক ঐক্যের আন্দোলন সফল হয়নি দুটি জিনিস ছাড়া। একটা হলো, অঞ্চলের সবচেয়ে অনুন্নত দেশগুলোকে বাণিজ্য উদারীকরণের সুযোগ নেওয়ায় সক্ষম করে তোলা, তাদের উৎপাদনক্ষমতা বাড়নোর মধ্য দিয়ে। এটা ঘটছে ইউরোপীয় ইউনিয়নে। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়ায় এ ক্ষেত্রে যথেষ্ট কাজ করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, আঞ্চলিক ঐক্য ও সংহতি সৃষ্টির জন্য একটা ইঞ্জিন বা ড্রাইভিং ফোর্স থাকতে হয়। অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলো এ ভূমিকা নেয়। দক্ষিণ এশিয়ায় এ ভূমিকা নিতে পারত ভারত ও পাকিস্তান, সর্বোপরি ভারত। কিন্তু ভারত এ ভূমিকা নেয়নি। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বড় উদ্যোগের পরিবেশ এখন বিরাজ করছে না। এ অঞ্চলের অনেক দেশ নিজের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত, আঞ্চলিক ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়গুলো তাদের অগ্রাধিকার পাচ্ছে না। পাকিস্তানে তালেবান, সন্ত্রাসবাদ, জাতিগোষ্ঠীগত হানাহানি ইত্যাদি। ভারতে দুই ভাবাদর্শের লড়াই; দেশপ্রেমের দুই ধরনের সংজ্ঞা, জাতীয়তাবাদের দুই ধরনের সংজ্ঞা। এগুলো মোটেই ভালো নয়। আমি দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক সংহতি-সহযোগিতার বিষয়ে খুব বেশি আশাবাদী হতে পারছি না। কিন্তু আমাদের চেষ্টা করে যেতে হবে। প্রথম আলো: আঞ্চলিক শক্তিহিসেবে ভারত যে ভূমিকা পালন করছে, তা আপনি কীভাবে দেখেন? নেপালের দৃষ্টান্ত বিবেচনায় নিয়ে? মুচকুন্দ দুবে: নেপালের সঙ্গেআমাদের যে সমস্যা হলো, তা থেকে যে তিক্ততা ও অনাস্থা সৃষ্টি হলো, সেটা আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির অনুকূল নয়। বিষয়টি এ অঞ্চলের অন্য দেশগুলোও লক্ষ করবে এবং তাদের এটা ভাবার যথেষ্ট যুক্তিসংগত কারণ থাকবে যে আজকে নেপালের সঙ্গে ভারতের যা ঘটল, আগামীকাল সেটা আমাদের ক্ষেত্রেও ঘটতে পারে। এটা কোনো সঠিক পথ নয়। আমি মনে করি, আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষার ক্ষেত্রে কিছু দূরদৃষ্টি থাকা উচিত, কিছু নীতি থাকা উচিত, কিছু আদর্শ থাকা উচিত। এমন হওয়া একেবারেই উচিত নয় যে আজকে আমরা দেখলাম, আমাদের জাতীয় স্বার্থের জন্য পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর সঙ্গে মিলমিশ দরকার, তাই আমরা সেসব দেশ সফর করতে লাগলাম, তাদের দাওয়াত দিতে লাগলাম। আবার দুই দিন পর আমরা দেখলাম আমাদের জাতীয় স্বার্থ অন্য রকম, তখন আমরা এসব বন্ধ করে দিলাম। এ রকম হওয়া উচিত নয়। যেমন, ভারতে আজও আমি শুনি, বাংলাদেশ থেকে আসা মুসলমানরা অবৈধ আর হিন্দুরা বৈধ। এ ধরনের বক্তব্য একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়, এটা আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির প্রতিকূল। প্রথম আলো: আপনি সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে বই লিখেছেন। সাম্প্রদায়িক দল বিজেপি এখন ভারতের রাষ্ট্রক্ষমতায়। এর প্রভাব কিন্তু বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতেও পড়েছে। মুচকুন্দ দুবে: অবশ্যই। সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে আমি যে বই লিখেছি, সেটাতে এবং ভারতের পররাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে আমি যে বই লিখেছি, সেটাতে খুব পরিষ্কারভাবে আমি বলেছি, আমাদের, ভারতের বহুত্ববাদী সমাজের সংহতি ধরে রাখার সামর্থ্য অনেকাংশে নির্ভর করে প্রতিবেশী দেশগুলোর বহুত্ববাদী সমাজের কী ঘটছে তার ওপরে। আমরা যদি আমাদের নিজের দেশে বহুত্ববাদী সমাজকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে না পারি, তাহলে প্রতিবেশী দেশগুলোতেও বহুত্ববাদ ধরে রাখার ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যার সৃষ্টি হবে। আরেকটি বিষয় হলো, আমি মনে করি, ভারতে গত দু-তিন বছরে সাম্প্রদায়িকতার পুনরুত্থান ঘটেছে। এটা শুধু আমাদের অভ্যন্তরীণ সংহতি, শান্তি ও স্থিতিশীলতাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতেও এর বিরূপ প্রভাব অবশ্যই পড়বে। ভারতে সংখ্যালঘুদের ওপর ঘন ঘন আক্রমণ, গরু খাওয়া, ভিন্ন ধর্মের মধ্যে বিয়ে ইত্যাদি ভুয়া অজুহাতে হত্যা করা—এসব ঘটনায় আমি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। ভারতে অতীতেও এ ধরনের ঘটনা যে একেবারেই ঘটত না তা নয়, কিন্তু যখনই এ রকম কোনো ঘটনা ঘটত, তখন সরকার কঠোর পদক্ষেপ নিত। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাওয়ার আগেই সরকার তৎপর হতো। কিন্তু এখনকার সরকার তা করছে না। গতানুগতিক ধারায় হয়তো পুলিশকে তদন্ত করতে বলা হচ্ছে, কিন্তু দশ মাস পরে আমরা জানতে পারছি না পুলিশ তদন্ত করে কী পেয়েছে, কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সুতরাং আমি ভীষণভাবে উদ্বিগ্ন। আমি আমার শিক্ষাদীক্ষায়, নীতি-নৈতিকতায়, বিশ্বাসে, ভাবাদর্শে অসাম্প্রদায়িকতা ধারণ করি এবং দ্বিধাহীনভাবে সোচ্চার কণ্ঠে কথা বলি, যখন দেখি যে অসাম্প্রদায়িকতার নীতি আক্রান্ত হচ্ছে। প্রথম আলো: গণতন্ত্র, টেকসই উন্নয়ন,বৈষম্যহীন সমতাপূর্ণ সমাজ—এসব আপনার আগ্রহের বিষয় এবং এসব নিয়েও আপনি অনেক লিখেছেন। আপনি কি মনে করেন, বর্তমান পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থায়, যেখানে মুনাফাই প্রধান প্রণোদনাশক্তি, সেখানে ধনী-গরিবের বৈষম্য দূর করা, একটা সমতাপূর্ণ পৃথিবী গড়ে তোলা আদৌ সম্ভব? মুচকুন্দ দুবে: এ বিষয়ে আমার আশাবাদের কিছুবাস্তব কারণ আছে। পশ্চিমা দুনিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর অধিকাংশের ধীর প্রবৃদ্ধি বা স্লো গ্রোথ সিনড্রোম অনেকাংশেই তাদের সমাজে অসাম্য বৃদ্ধির ফল। তাদের এই সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার, প্রবৃদ্ধির হার দেড় শতাংশ থেকে বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে সমৃদ্ধির ভাগ সমাজের সব অংশের জন্য নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে। গবেষণা-সমীক্ষা থেকে পাওয়া তথ্য-উপাত্তের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ করেছেন টমাস পিকেটি তাঁর ইকোনমিকস অব ইনইকুয়ালিটি গ্রন্থে। তিনি শ খানেক দেশের প্রায় এক শ বছরের তথ্য-উপাত্ত জড়ো করে এটা দেখিয়েছেন। কিছুকাল আগ পর্যন্ত আলোচনা হয়েছে শুধু আয়ের অসমতা নিয়ে। কিন্তু করপোরেট সেক্টরের উত্থান ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ফিন্যান্স-সর্বস্বতার ফলে সম্পদের অসমতাও সৃষ্টি হয়েছে। কারণ করপোরেশনগুলোর নির্বাহীদের এত উচ্চহারে বেতন দেওয়া হয় যে তাঁদের হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়েছে। ফলে আয়-বৈষম্যের মাধ্যমে সম্পদের বৈষম্য অনেক বেড়ে গেছে। এটার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বৈশ্বিক অর্থনীতিতে। প্রথম আলো: এই দেশগুলোকে কী করতেহবে? মুচকুন্দ দুবে: আমার মনে হয়, ওই দেশগুলোরবিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রয়োজন হবে। কারণ একটা অর্থনৈতিক সংকট থেকে আরেকটা অর্থনৈতিক সংকটে গিয়ে পড়া দিনের পর দিন তো চলতে পারে না। এ বিষয়ে বৈশ্বিক পরিসরে আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন, যেটার জন্য সর্বোত্তম ফোরাম হতে পারে জাতিসংঘ। আমি মনে করি না যে এটার জন্য উপযোগী ফোরাম জি-২০। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতিসংঘের অবস্থা ভালো নয়, জাতিসংঘ ক্ষয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘকে এমনই দুর্বল করে ফেলা হয়েছে যে তাকে যেন আর চেনা যায় না। অসাম্যের প্রশ্নে আন্তর্জাতিক পরিসরে কোনো উদ্যোগ যদি নিতে হয়, তাহলে প্রথম ও প্রধান কর্তব্য হবে জাতিসংঘকে পুনরুজ্জীবিত করা। প্রথম আলো: আপনার কি মনে হয় যে জাতিসংঘ যুদ্ধ, অবরোধ আরোপ ইত্যাদি রাজনৈতিক বিষয়ে অতিমাত্রায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছে? মুচকুন্দ দুবে: ঠিক। তবে এটা জাতিসংঘের একদম শুরুথেকেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ ছিল: কীভাবে আগ্রাসন বন্ধ করা যায়, যুদ্ধ থামানো যায় ইত্যাদি। সেটা এখনো আছে এবং থাকা উচিত। কারণ যুদ্ধ ও আগ্রাসন ঠেকানো জাতিসংঘের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব। আর যত দিন পর্যন্ত দেশে দেশে সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থবোধ কাজ করছে, তত দিন এগুলোর অবসান ঘটবে না, তাই জাতিসংঘের এ ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতেই হবে। কিন্তু এসব বিরোধ-সংঘাতের মূল কারণগুলো দূর করার একটা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য কাজ করতে হবে জাতিসংঘের সংস্থাগুলোকে। ইউনেসকো, ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন, আঙ্কটাড—এই সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যুদ্ধ-সহিংসতা ইত্যাদির মূল কারণগুলো দূর করার চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু এই সংস্থাগুলোকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে; এদের সব কর্মকাণ্ড চলে গেছে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফএর হাতে। বিশ বছর ধরে আমি লিখে চলেছি, উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য যেসব কাজ জাতিসংঘের করার কথা, সেগুলো তার হাতেই ফিরিয়ে দেওয়া হোক। প্রথম আলো: ধনী ও দরিদ্রের মধ্যকার বৈষম্য কমানোর জন্য আপনার কি কোনো সুনির্দিষ্ট পরামর্শ আছে? কী প্রক্রিয়ায় এটা করা যায়? মুচকুন্দ দুবে: আপনি প্রশ্ন করেছিলেন, পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় বৈষম্য দূর করা আদৌ সম্ভব কি না। আমি সেই প্রশ্নে ফিরতে চাই। সাম্প্রতিক বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা সমৃদ্ধি আনতে গিয়ে বাজারের শক্তিগুলোর ওপর অতিমাত্রায় গুরুত্ব দিয়েছে। সন্দেহ নেই, এর মাধ্যমে চীন, ভারতসহ কিছু দেশে ইতিবাচক ফল পাওয়া গেছে, প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে। কিন্তু আবার একই সঙ্গে এর ফলে বৈষম্যও বেড়েছে। আর সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজারের ব্যর্থতার দৃষ্টান্ত এত ঘন ঘন দেখা গেছে এবং সেগুলো এতটাই বিপজ্জনক যে এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা যায় না। তাই অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রে সরকারি হস্তক্ষেপের প্রয়োজন আছে। বাজারের শক্তিগুলোর পরিমিতি আনতে হবে, রাশ টানতে হবে। প্রথম আলো: এত দিন বলা হয়েছে, বাজারের ওপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ন্যূনতম পর্যায়ে কমিয়ে আনতে হবে। আপনি বলছেন সেটা ভুল ছিল? মুচকুন্দ দুবে: ঠিক তাই। কারণ অনিয়ন্ত্রিতবাজার অর্থনীতির কারণে আমাদের ভুগতে হয়েছে, বিশ্বজুড়ে বিরাট বিরাট আর্থিক বিপর্যয় ঘটেছে। যেমন ২০০৮ সালের বিশ্বমন্দা। এই বিশ্বমন্দার কারণ, অনিয়ন্ত্রিত আর্থিক খাত রিয়াল এস্টেট খাতকে গ্রাস করেছিল, অল্প কিছু মানুষ সম্পদের পাহাড় গড়ার জন্য সেটাকে ব্যবহার করছিল, আর সরকার সেটাকে উপেক্ষা করে যাচ্ছিল। তার ফলে যে মন্দা সৃষ্টি হয়েছিল, সেখান থেকে বিশ্ব গত আট-নয় বছরেও পুরোপুরি উঠে দাঁড়াতে পারেনি। এটা সাম্প্রতিক দৃষ্টান্ত। প্রথম আলো: আপনার আরেকটি কাজের ক্ষেত্রশিক্ষা,এবং আপনি বলেন যে উন্নয়নের জন্য শিক্ষা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কেন এবং কীভাবে? মুচকুন্দ দুবে: উন্নয়নের জন্যও যে শিক্ষাখুবগুরুত্বপূর্ণ, তা বহু বছর আগেই দেখিয়েছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ থিওডর শুলজ। ১৯৬০ দশকের মাঝামাঝি তিনি দেখিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের জিএনপির একটা বিরাট অংশের কৃতিত্ব হিউম্যান ফ্যাক্টরের। প্রবৃদ্ধির ৬০-৬৫ শতাংশের পেছনে কাজ করেছে বিনিয়োগকৃত পুঁজি। বাকি ৩৫-৪০ শতাংশ তাহলে কোত্থেকে এল? শুলজ প্রায় গাণিতিকভাবে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন যে সেটা এসেছে শিক্ষা থেকে, দক্ষ ও প্রশিক্ষিত লোকবল থেকে। তারপর থেকে গোটা বিশ্ব শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হয়েছে। আমি তো পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ দেখি না, যেখানে রাষ্ট্রীয় অর্থায়নে, রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত পাবলিক স্কুল এডুকেশন সিস্টেম ছাড়া উন্নয়ন ঘটেছে। একটি উদাহরণও নেই। আমরা ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান তো এর ব্যতিক্রম হতে পারি না। আমরা যদি উন্নত হতে চাই, বিশ্বসভায় নিজেদের মর্যাদাপূর্ণ জায়গা করে নিতে চাই, জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ বা একটা বড় অংশকে অশিক্ষিত রেখে সেটা সম্ভব নয়। দ্বিতীয় কথা হলো, পৃথিবীর উৎপাদন প্রক্রিয়া এখন এমন হয়েছে, যেখানে উৎপাদনের চাকা সচল রাখতে প্রতিটি ধাপেই শিক্ষিত কর্মী দরকার। আজকের পৃথিবীতে পুঁজি শুধু সেই সব দেশেই যাচ্ছে, যেখানে শিক্ষিত ও দক্ষ শ্রমিক আছে। তৃতীয়ত, শিক্ষা একটা মৌলিক অধিকার। আমাদের সংবিধান এটা বলে দিয়েছে। প্রত্যেক নাগরিক তাঁর মানবিক মর্যাদার স্বার্থে শিক্ষা লাভের অধিকার ভোগ করেন। প্রথম আলো: ভারতের সংবিধানেই বলা হয়েছে শিক্ষাএকটা মৌলিক অধিকার। আবার শুনছি, রাইট টু এডুকেশন নামে একটা আইন করা হয়েছে। আইনের প্রয়োজন হলো কেন? মুচকুন্দ দুবে: ভারতের সংবিধানে আগে শিক্ষা মৌলিক অধিকারছিল না। সংবিধান শুধু বলেছিল, রাজ্যসমূহ তাদের নাগরিকের শিক্ষা প্রদানের প্রয়াস নেবে। ২০০২ সালে সংবিধানে এটাকে মৌলিক অধিকার হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলো, সংবিধানে বলে দেওয়া হয়, এই অধিকার বাস্তবায়ন করতে হবে একটা আইনের মাধ্যমে। সাত বছর পর ২০০৯ সালে আইনটা পাস হয় ‘রাইট টু এডুকেশন’ নামে। আইনের কথা সংবিধানে না থাকলেই ভালো হতো, মানুষ সরাসরি আদালতে গিয়ে শিক্ষার অধিকার দাবি করতে পারত। প্রথম আলো: আপনি ভারতে শিক্ষাবিস্তারের জন্যকী করছেন? মুচকুন্দ দুবে: আমি ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন কমিটি ফর কমন স্কুল সিস্টেম-এর সভাপতি ছিলাম। ২০০৫ বা ২০০৬ সালে নীতিশ কুমার যখন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী হলেন, তখন তিনি আমাকে একটা কমিশনের নেতৃত্ব নিতে বললেন, যে কমিশন পরামর্শ দেবে কীভাবে বিহার রাজ্যে কমন স্কুল সিস্টেম গড়ে তোলা যায়। আমি সেই দায়িত্ব নিয়ে পাটনায় চলে যাই, সেখানে আট-নয় মাস থেকে একটা প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিই। কিন্তু এর মধ্যে রাজনীতি ঢুকে যায়, কায়েমি স্বার্থবাদী কিছু গোষ্ঠী তৎপর হয়ে ওঠে, নীতিশ কুমার আমার প্রতিবেদনটি এড়িয়ে যান। কিন্তু আমি কমন স্কুল সিস্টেমের পক্ষে কথা বলেই যাচ্ছি। আমার প্রতিবেদনটি ভারতের অ্যাকাডেমিক মহলে বেশ পরিচিত। এ ছাড়া আমাদের একটা ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন কমিটি ফর রাইট টু এডুকেশন ইন ইন্ডিয়া আছে, আমরা কাজ করছি রাইট টু এডুকেশন আইনের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে। এ কমিটিতে এক হাজার বেসরকারি সংস্থা অংশ নিচ্ছে এবং এর কাজ পরিচালিত হয় আমার অফিস থেকে। আমি এ কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালন করছি।

No comments

Powered by Blogger.