রাজনীতির ধারা বদলায়নি - রাশেদ খান মেনন by মিজানুর রহমান খান

রাশেদ খান মেনন, পর্যটনমন্ত্রী,
সভাপতি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি
প্রথম আলো: তিন জোটের রূপরেখায় নিরপেক্ষ নির্বাচনের দাবি ছিল। ২৫ বছর পর কীভাবে দেখছেন?
রাশেদ খান মেনন: ওই রূপরেখায় ‘সার্বভৌম’ সংসদের কথা ছিল। দ্বিতীয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ চলবে। তৃতীয় ছিল অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর। এই রূপরেখা তার জন্মেই হোঁচট খেল। বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতকে সঙ্গে নিলেন। পর্দার আড়ালে আগেই আঁতাত করেছিলেন।
প্রথম আলো: রূপরেখায় সংসদীয় পদ্ধতি কেন ছিল না?
মেনন: ওটা আপস ছিল। কারণ, বিএনপি সংসদীয় গণতন্ত্র চায়নি। তাই রূপরেখায় উদ্ধৃতিচিহ্নের মধ্যে ‘সার্বভৌম’ কথাটি লেখা হলো। আমাদের মনে ছিল সংসদীয় গণতন্ত্র। সাহাবুদ্দীন সাহেব ধমকের সুরে বলেছিলেন, বিএনপি যদি সংসদীয় ব্যবস্থায় না ফেরে, তাহলে তিনি থাকবেন না।
প্রথম আলো: তার মানে আপনি সাক্ষ্য দিচ্ছেন যে আওয়ামী লীগ একাই নয়, সাহাবুদ্দীন সাহেব ব্যক্তিগতভাবেও চাপ সৃষ্টি করেছিলেন?
মেনন: হ্যাঁ। তিনিই আমাদের ডেকে বললেন, আপনারা এ জন্য বিএনপির ওপর চাপ সৃষ্টি করুন। বড় দলগুলো এটা করবে না, এই ভাষাতেই বলেছিলেন। তবে সমস্যা বাধল অন্যত্র। আমরা বামেরা ছিলাম ১১ জন। বললাম, সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরলে সরকার গড়তে আমরা আপনাদের নিঃশর্ত সমর্থন দেব। বিএনপির সঙ্গে যোগাযোগও হয়েছিল। আওয়ামী লীগ এ জন্য আমাদের প্রতিÿক্ষুব্ধ হয়েছিল। কিন্তু ওদিকে বিএনপি জামায়াতকে টানল। আর এভাবে বিএনপি প্রথমেই বিশ্বাসঘাতকতা করল। প্রথমে তারা মিরপুরের উপনির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করল। এরপর মাগুরায় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ওপর কফিনের শেষ পেরেক হিসেবে দেখা দিল। এ কারণে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি সামনে এল।
প্রথম আলো: রেডিও-টিভির স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা কি একেবারে ফুরিয়েছে?
মেনন: বিএনপির মন্ত্রী নাজমুল হুদা সংসদে বলেছিলেন, আমাদের খাসি আমরা আগা দিয়ে কাটব, না লেজ দিয়ে কাটব, তা আমাদের ব্যাপার। কমিশন হয়েছিল। পরে আসাফ্উদ্দৌলাহ্কমিশন ভালো রিপোর্ট দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়নটা বাকি থাকল। শেখ হাসিনা দুটো বড় কাজ করেছেন। উন্মুক্ত আকাশনীতি নিলেন। আর এক লাখ টাকায় সিটিসেল মোবাইল ফোন কেনার অবসান ঘটালেন।
প্রথম আলো: ২৫ বছরে প্রেস ফ্রিডম কতটা এগোল?
মেনন: বাংলাদেশের প্রেস অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে স্বাধীন। এরশাদ আমলের সঙ্গে কোনো তুলনাই হবে না। হয়তো কিছুটা সেলফ সেন্সরশিপ আছে।
প্রথম আলো: সেটা অতীতের চেয়ে ব্যাপকতর কোনো মাত্রা পাচ্ছে কি?
মেনন: সরকারের তরফে কোনোভাবেই নেই, কোথাও হস্তক্ষেপ করা হয় না। তবে এখন তো ঘরানার পত্রিকার চল দেখি, তারা যদি ঘরানা মতে খবর লেখে, সে জন্য তো সরকারকে দায়ী করা যাবে না।
প্রথম আলো: ঘরানা কি গণতন্ত্রের পরিপূরক হচ্ছে?
মেনন: (হাসি) বলতেই হয়, সেটা কখনো হয় না।
প্রথম আলো: ব্যক্তি এরশাদ, না তাঁর শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়েছিলেন?
মেনন: শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে।
প্রথম আলো: কিন্তু তাতে বড় গলদ চোখে পড়ে। রাষ্ট্রপতি শব্দ মুছে প্রধানমন্ত্রী বসালেন। লাভ কী হলো?
মেনন: এই ত্রুটি বাহাত্তরের সংবিধানেই ছিল।
প্রথম আলো: কিন্তু বামেরা ঢালাওভাবে বাহাত্তরের সংবিধান পুনরুজ্জীবনে সোচ্চার থেকেছেন।
মেনন: দ্বাদশ সংশোধনী পাসের বিশেষ কমিটির একজন সদস্য ছিলাম। রাত দুটো-তিনটে পর্যন্ত কাজ হতো। কিন্তু বিএনপি এসব প্রশ্নে কখনো ছাড় দিতে রাজি ছিল না। প্রধানমন্ত্রীর হাতে এককভাবে নির্বাহী ক্ষমতা রাখার সমস্যার বিষয়ে আমি ছাড়াও যত দূর মনে পড়ে সুধাংশু শেখর তুলেছিলেন। আমি ৭০ অনুচ্ছেদেরও সংশোধনী চেয়েছিলাম, উল্টো তারা সেটি আরও শক্ত করেছিল। দ্বাদশ সংশোধনী দলগুলোর সমঝোতার ফল।
প্রথম আলো: এটা সামনে কী করে তোলা যাবে?
মেনন: না তোলার কিছু নেই, কথা বলা যাবে। কিন্তু এখন যা অবস্থা দাঁড়িয়েছে, আমরা তো কতগুলো অভ্যস্ততার মধ্য দিয়ে যাই। আমরা অভ্যস্ত হয়ে গেছি। সেখান থেকে বেরোতে একটা বড় ধাক্কা লাগে। সেই ধাক্কা দেওয়ার মতো বাস্তবতা এখন নেই।
প্রথম আলো: কে বদলেছে, এরশাদ, না তাঁর শাসনব্যবস্থা? কেন এরশাদ আপনাদের পাশে?
মেনন: স্বৈরাচারের ফেলে যাওয়া জুতার মধ্যে আমাদের শাসকেরা তাঁদের পা ঢুকিয়ে হেঁটেছেন। যার কারণে আজ আমাদের এই পরিণতি। পিএসএফ হয়েছে এসএসএফ, সবটাই প্রধানমন্ত্রীর হাতে। তবে এরশাদ সাহেব বদলেছেন। ছিয়াশিতে সংসদ বাতিলের আগে তিনি সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরতে সিদ্ধান্ত প্রায় চূড়ান্ত করেছিলেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ সাক্ষ্য দেবেন যে সাকা চৌধুরী ও আনোয়ার জাহিদ তাঁর বিরোধিতা করেছিলেন। গত মন্ত্রিসভা বৈঠকে গল্পচ্ছলে পুরোনো দিনের কথা আলোচিত হয়েছিল।
প্রথম আলো: মওদুদ আহমদ লিখেছেন, বামেদের সমর্থন না পেয়েই বিএনপি জামায়াতকে কাছে টেনেছে।
মেনন: এটা ঠিক, তারা আমাদের সমর্থন চেয়েছিল। কিন্তু তিনি পুরোটা বলেননি। অধ্যাপক বি. চৌধুরীর উপস্থিতিতে এক বৈঠকে বিএনপি বলল, আমাদের আসন দেওয়া হবে। কিন্তু ধানের শীষ নিয়ে নির্বাচন করতে হবে। আমরা বললাম, না, তা করব না। মজিদ উল হক চূড়ান্তভাবে ৩৫ আসন নিতে বললেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ৫-দলীয় নেতারা তা নাকচ করলেন। পরে আওয়ামী লীগ দিতে চাইল ৬টি। আর নির্বাচনের পরে আমরাই প্রস্তাব দিলাম। কিন্তু বিএনপি তা মানল না। ততক্ষণে সাইফুর রহমান এবং এম কে আনোয়ার জামায়াতের সঙ্গে আপস করে ফেলেছেন।
প্রথম আলো: এরশাদের মতো কি খালেদা জিয়ার সঙ্গে সমঝোতায় আসা সম্ভব নয়?
মেনন: তিনি জামায়াত ছাড়বেন না। কারণ, তিনি সব সময় দক্ষিণপন্থীদের দিকেই থেকেছেন। শেখ হাসিনা ওপরে যা-ই করুন, শেষতক গণমুখী থাকেন। বেগম জিয়া বৃত্তের ভেতরে ষড়যন্ত্র করেন, আর ইতিমধ্যে জামায়াত তাঁকে জয় করে নিয়েছে। মওদুদ, খোকারা একসময় কর্তৃত্ব করেছেন, এখন হেরে গেছেন। বিএনপির সবচেয়ে খারাপ হচ্ছেন তারেক রহমান।
প্রথম আলো: বিএনপি-জামায়াতের ন্যুব্জ হওয়ায় সমাজে একটা রূপান্তর শুরু হয়েছে। আমরা ভালো কিছুর দিকে যাচ্ছি কি না?
মেনন: আপনি জানেন, নিরঙ্কুশ ক্ষমতা নিরঙ্কুশভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত, সেই সম্ভাবনা তো সব সময় রয়ে যাচ্ছে। এ বিপদ সব সময় থাকে। হ্যাঁ, বাংলাদেশ একটি ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নতুন প্রজন্ম থেকে যদি কিছু বেরিয়ে আসতে পারে, রাজনীতির ধারা বদলাবে। এখনো সেটা দেখি না। গণজাগরণ মঞ্চ হঠাৎ আশা জাগিয়েছিল। আজ সত্য বলতে হয়, সেখানে চেতনাটা ছিল, কিন্তু এটা ছিল চামচে করে খাওয়ানো, বাইরে থেকে তাদের শক্তি জুগিয়েছিল, তাই হয়নি। আমরা কিন্তু শূন্য থেকে উঠে এসেছিলাম। তরুণেরা স্বতঃপ্রণোদিতভাবে উঠে আসবে, তার অপেক্ষা করব।
প্রথম আলো: আপনাকে ধন্যবাদ।
মেনন: আপনাকেও ধন্যবাদ।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মিজানুর রহমান খান

No comments

Powered by Blogger.