অপরিণত শিশুর জন্মহার বাড়ছে by ফরিদ উদ্দিন আহমেদ

বাংলাদেশে অপরিণত শিশুর জন্মহার বাড়ছে। বছরে মোট শিশু জন্মের ১৪ শতাংশ অপরিণত হয়ে জন্মায়। বছরে চার লাখ ৩৯ হাজার শিশু অপরিণত হয়ে নির্ধারিত সময়ের আগেই জন্মায়। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ২৬ হাজার ১০০ জন নানা জটিলতার কারণে অকালে বা সরাসরি মারা যায়। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অপরিণত হয়ে জন্মালেও খুব সহজ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে এসব শিশুর মৃত্যু রোধ করা সম্ভব। গর্ভকালীন উন্নত পরিচর্যা ও চিকিৎসার মাধ্যমে অপরিণত শিশুর জন্ম রোধ করা যায়। ঠিক কী কারণে অপরিণত শিশু জন্মায় তা বলতে না পারলেও সম্ভাব্য কিছু কারণের কথা জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা বলছেন, এসব কারণ এখনও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত নয়। শিশু বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে ৩৭ সপ্তাহের কম সময়ের আগেই অপরিণত শিশুর জন্মের হার ১৪ শতাংশ। এসব শিশুর ওজনও কম হচ্ছে। জন্মের সময়ে ২২ শতাংশ শিশুর ওজন আড়াই কেজিরও কম থাকে। অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়া শিশুদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে অনুপাত ১ দশমিক ২ শূন্য। অর্থাৎ ছেলে ১ দশমিক ২ শূন্য হলে মেয়ে শিশু একজন অপরিণত বয়সে জন্ম নিচ্ছে। প্রতি বছর বাংলাদেশে ২৮ সপ্তাহেরও কম সময়ে জন্ম নেয় এমন শিশুর সংখ্যা ২২ হাজার।
অপরিণত শিশুর জন্মের সম্ভাব্য কিছু কারণ উল্লেখ করে শিশু বিশেষজ্ঞরা জানান, কিশোরী বয়সে বিবাহ বা বাল্যবিবাহ, সাধারণত একটি শিশু জন্মের দু’বছর আগে আরেকটি শিশুর জন্ম হলে, মা স্থুলকায় হলে, ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হলে, হাইপারটেনশন থাকলে, গর্ভাবস্থায় মা একলাম্পশিয়ায় (খিচুনি) ভুগলে, গর্ভাবস্থায় মা রান্নার ধোঁয়ায় কাজ করলে, অ্যাজমা, গর্ভকালীন অবস্থায় পানি আগে ভাঙলে, গর্ভ অবস্থায় রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্তশূন্যতা ইত্যাদি কারণে সন্তান অপরিণত হয়ে জন্মায় বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। অপরিণত শিশু দীর্ঘ মেয়াদে প্রতিবন্ধিতায় ভুগে থাকে।
কিভাবে ঝুঁকি কমানো যায়:  চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, কিশোরী বয়সে গর্ভবতী হলে অপরিণত বয়সের শিশু জন্মের ঝুঁকি থাকে। পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি ব্যবহারের মাধ্যমে তা কমানো সম্ভব। কমপক্ষে দু’বছর অন্তর সন্তান নিলে এই ঝুঁকি এড়ানো যায় বলে চিকিৎসকরা মনে করেন। গর্ভকালীন সঠিক যত্নবান হওয়া, সময় মতো ক্লিনিকে চেকআপ এবং নিরাপদ ডেলিভারি বা প্রসব অপরিণত শিশুর জন্মদান কমাতে সাহায্য করে। বিশ্বব্যাপী গুণগত স্বাস্থ্যসেবাই পারে অপরিণত বয়সে জন্মানো শিশুর মৃত্যু ঠেকাতে। মায়ের বুকের দুধ, প্রত্যেক মা ও  তার শিশুর উন্নতমানের স্বাস্থ্যসেবা এ ধরনের শিশুমৃত্যু রোধে কাজ করে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (কেএমসি) অপরিণত বয়সের শিশু ও কম ওজনের শিশুকে সুরক্ষা দেয়ার অন্যতম পন্থা বলে তারা মনে করেন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা জানান, ইনকিউবেটর নয়, মায়ের কাছে রেখেই অপরিণত শিশুকে চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করে বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার (সিএমসি) পদ্ধতির এ চিকিৎসা ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিউনেটালজি বিভাগ, ঢাকা শিশু হাসপাতালসহ বিভিন্ন হাসপাতালে অপরিণত শিশুকে মায়ের কাছে রেখেই, মায়ের তত্ত্বাবধানে চিকিৎসা দিয়ে সাফল্য পাওয়া গেছে। এটা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক স্বীকৃত একটি পদ্ধতি। মায়ের কাছে থাকলে বা ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার থাকলে শিশু উষ্ণতা পায়। মা শিশুর অবস্থা বুঝতে পারেন। বাংলাদেশ ১৯৯০ সালের পরে সর্বপ্রথম দিনাজপুরে সিএমসি পদ্ধতি চালু করে।  রাজধানীর শিশু হাসপাতালে এই পদ্ধতি চালু হয় ২০১৩ সালে। শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল সিএমসি চালুর প্রস্তুতি নিয়েছে। এছাড়া, ঢাকার বাইরের জেলা শহরের হাসপাতালগুলোও ধারাবাহিকভাবে এই পদ্ধতি চালু করবে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন। সমপ্রতি বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৫টি দেশের গবেষণায় দেখা গেছে, ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার পদ্ধতিতে শিশু ইনকিউবেটরের চেয়ে দ্রুত সুস্থ হয়ে ওঠে বা এ পদ্ধতি অধিক কার্যকর।
সাধারণত গর্ভাবস্থার ৩৭ সপ্তাহের আগে জন্ম নেয়া শিশুকে অপরিণত শিশু বলছেন চিকিৎসকরা। আর এ ধরনের শিশুর স্বাস্থ্যগত অধিক সমস্যা এবং মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। বিশ্বে বছরে ১৫ মিলিয়ন তথা দেড় কোটি শিশু অপরিণত বয়সে জন্মগ্রহণ করে (মোট ডেলিভারির বা প্রসবের ৫ শতাংশ থেকে ১৮ শতাংশ)। আর পাঁচ বছরের মধ্যে যেসব শিশু মারা যাচ্ছে তাদের ক্ষেত্রে এটাই সাধারণ কারণ বলে চিকিৎসকরা উল্লেখ করেছেন। বিশ্বে ২০১৫ সালে অপরিণত এক মিলিয়নের উপর  শিশু মারা গেছে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।
কেইস স্ট্যাডি: ডা. তানভিরুল আলম ও ডা. ইমা দম্পতির একমাত্র অপরিণত বয়সের শিশুর জন্ম হয় চলতি বছরের ২৯শে জুন। অত্যন্ত ওজন কম হওয়ায় (৯শ’ ৮০ গ্রাম) ১লা জুলাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর নবজাতক আইসিইউতে (নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্র) ভর্তি করা হয় শিশুকে। এরপর থেকে শিশুটি নানা সমস্যায় ভুগতে থাকে। শিশুটিকে নিয়ে বাবা-মা দীর্ঘ প্রায় দু’মাস অবস্থান করেন হাসপাতালটির নিউনেটালজি বিভাগে। সাবেক বিভাগীয় চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মো. সহিদুল্লাহ ও একই বিভাগের বর্তমান চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আব্দুল মান্নানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিল শিশুটি। রাজধানীর তেজগাঁওস্থ নাক, কান, গলা ইনস্টিটিউটে কর্মরত ডা. তানভিরুল জানান, তার বাচ্চা স্বাভাবিক জন্মের আড়াই মাস আগেই জন্ম নিয়েছে। অপরিণত বয়সে জন্ম নেয়ায় এক মাসের অধিক সময়ে শিশুটি ইনকিউবেটরে রাখা হয়। এক পর্যায়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা তার শিশুটি ‘ক্যাঙ্গারু মাদার কেয়ার’ পদ্ধতিতে রাখার পরামর্শ দেন। এরপর থেকেই শিশুটিকে ইনকিউবেটরে, কখনওবা মায়ের কাছে কেএমসি পদ্ধতিতে প্রতিদিন সাত-আট ঘণ্টা রাখা হতো। এতে শিশুটির শারীরিক অবস্থা দ্রুত উন্নতি হয়েছিল বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ চিকিৎসক জানান, কেএমসি ইনকিউবেটরের বিকল্প হিসেবে কাজ করে। এ সময়ে শিশুর শরীরের গরম, তাপমাত্রা কমে না কিন্তু স্বাভাবিক থাকে (হাইফোথারমিয়া), মায়ের সঙ্গে শিশুর সম্পর্ক তৈরি, শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার ক্ষেত্রে উন্নতি হতে থাকে। হৃৎপিণ্ডের স্বাভাবিক গতি ফিরে পায়। শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক হয়। প্রাকৃতিক পরিবেশে মানানসই হয়ে ওঠে। চিকিৎসকদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও সহযোগিতা এবং নার্সরা মায়ের মতো মমতায় সেবা-শুশ্রূষা দিয়েই তার বাচ্চাকে সুস্থ করে তুলেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
শিশু বিশেষজ্ঞ, বিএসএমএমইউর নিউনেটালজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. আব্দুল মান্নান এই বিষয়ে মানবজমিনকে বলেন, কিশোরী বয়সে বিবাহ বা বাল্যবিবাহ, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস, গর্ভাবস্থায় পানি আগে ভাঙলে, গর্ভকালীন রক্তপাত, হঠাৎ পড়ে যাওয়া, ধূমপান বা তামাক গ্রহণ করা, মায়ের রক্তশূন্যতা ইত্যাদি কারণে অপরিণত শিশুর জন্ম হয়। কম বয়সে বিবাহ রোধ করা, নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে গিয়ে চেকআপ করা, চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবন করলে অপরিণত শিশুর জন্ম কমানো সম্ভব বলে এই শিশু বিশেষজ্ঞ মনে করেন। তিনি আরও জানান, আমাদের বিভাগের আইসিইউতে ভর্তি হওয়া শিশুদের মধ্যে ৬০ শতাংশই হলো অপরিণত বয়সে জন্মা নেয়া শিশু। এই বিভাগে অপরিণত শিশু আসলে আমরা খুব জটিল না হলে ইনকিউবেটরে রাখি না। আমরা শিশুটিকে মায়ের কাছেই রাখি। মা শিশুকে আদর করে নিজের গায়ের সঙ্গে লাগিয়ে রাখেন। এতে করে শিশুটি মায়ের গায়ের উষ্ণতা পায় এবং বুকের দুধ পান করতে পারে প্রয়োজন হলে। শিশুটি কোন জটিলতায় ভুগলে মা-ই দ্রুত বুঝতে পারেন এবং চিকিৎসককে জানাতে পারেন। এতে শিশুটি দ্রুত সুস্থ হয়ে যায় এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে বাড়ি ফিরে যেতে পারে। এ পদ্ধতিতে বাড়তি নার্সের প্রয়োজন হয় না। খরচের পরিমাণ অনেক কম হয়।

No comments

Powered by Blogger.