বেপরোয়া অজ্ঞান পার্টি- ৬ দিনে আক্রান্ত ৩০

কর্মব্যস্ততার একটি মাস শেষে শুরু হয়েছে নতুন মাস। কর্মস্থলভেদে নতুন মাসের প্রায় ১৫ তারিখ পর্যন্ত বেতন পাওয়ার এই সময়টা চাকরিজীবীদের কাছে উৎসবের মতো আনন্দের। কিন্তু অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে অনেকের আনন্দ পরিণত হচ্ছে বিষাদে। বেতন নিয়ে আনন্দে বাসায় পৌঁছার পরিবর্তে অচেতন হয়ে সঙ্গে থাকা সব হারিয়ে গন্তব্য হচ্ছে হাসপাতাল। চলতি মাসের অফিস ও ব্যাংক খোলা থাকার প্রথম তিন দিনেই অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে কেবল ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেই ভর্তি হয়েছেন অন্তত ২১ জন। গতকাল পর্যন্ত ৬ দিনে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০-এ। প্রকৃত ভুক্তভোগীর সংখ্যা এর কয়েকগুণ বলে ধারণা করা হচ্ছে। জামিনে বেরিয়ে এসে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা চাকরিজীবীদের বেতন পাওয়ার এই সময়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছে পুলিশ ও সংশ্লিষ্টরা। মলম বা রাসায়নিক পদার্থের বিষক্রিয়ার আকস্মিকতা ও তীব্রতায় শারীরিক ও মানসিকভাবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ভুক্তভোগীরা।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার (মিডিয়া) মুনতাসিরুল ইসলাম মানবজমিনকে বলেন, সচরাচর ঈদ ও পূজার সময় অজ্ঞান ও মলম পার্টির তৎপরতা বাড়ে। তখন পুলিশি অভিযানে অনেক সদস্য গ্রেপ্তারও হয়েছিল। তাদের অধিকাংশই এখন জামিনে বেরিয়ে এসে একই কাজে নেমেছে বলে পুলিশের কাছে তথ্য আছে। ফলে সম্প্রতি অজ্ঞান ও মলম পার্টির তৎপরতা কিছুটা বেড়েছে। এছাড়া বেতন পাওয়ার এই সময়ে মানুষের হাতে টাকা থাকাসহ কয়েকটি কারণে তা বেড়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চলছে। বড় কোনো সাফল্য এলে গণমাধ্যমকে জানানো হবে।
পুলিশ ও ভুক্তভোগী সূত্রে জানা যায়, সাধারণত দুই ঈদ ও পূজার সময় অজ্ঞান পার্টির তৎপরতা বাড়লেও বর্তমানে মাসের শুরুতে চাকরিজীবীদের বেতন তোলার এই সময়ে রাজধানীজুড়ে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ব্যস্ততম এলাকায় দিন দিন বেড়ে চলছে তাদের তৎপরতা। বহু পরিশ্রমের কাঙ্ক্ষিত বেতন তোলার পর খেটে-খাওয়া কর্মজীবী মানুষ তাদের শিকারে পরিণত হচ্ছেন। ব্যাংক, এটিএম বুথ বা অফিস থেকে বেতনের টাকা তোলার পর ছদ্মবেশে পিছু নিচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। ব্যবসায়ী ও কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষও এতে শিকার হচ্ছেন। যানবাহন, রাস্তাঘাট বা ব্যাংক এলাকায় সুবিধামত স্থান ও সময়ে অজান্তে নাকে-মুখে চেতনানাশক মলম বা রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়ে দেয়া হচ্ছে। খাওয়ানো হচ্ছে কৌশলে। শিকার হওয়ার পরে অচেতন হয়ে পড়লে সঙ্গে থাকা টাকা-পয়সা ও সম্পদ হাতিয়ে নিয়ে সরে পড়ছে। চলতি মাসের প্রথমদিন থেকে এ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় শতাধিক মানুষ অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানভেদে আগামী ১৫ তারিখ পর্যন্ত বেতন প্রদানের সময় রয়েছে। এ সময় পর্যন্ত অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা বেপরোয়া থাকবে বলে জানিয়েছেন একাধিক ভুক্তভোগী।
পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্র জানায়, গত বুধবার একদিনে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় পৃথক ঘটনায় অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন চাকরিজীবীসহ বিভিন্ন পেশার ১৩ ব্যক্তি। রাজধানীর শেখ বোরহানউদ্দিন কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান আনিসুর রহমান ওইদিন দুপুরে ব্যাংক থেকে বেতনের ৩০ হাজার টাকা তোলেন। এরপর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে ওঠেন ১৩ নম্বর রুটের একটি বাসে। একপর্যায়ে তিনি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়ে গাড়িতে অচেতন হয়ে পড়লে তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠলে সন্ধ্যায় তাকে বাড়িতে নিয়ে যান স্বজনরা।
আনিসুর রহমানের ভাই নিজাম উদ্দিন বলেন, গাড়িতে ওঠার পর তার পাশের আসনে বসা অপর এক লোকের সঙ্গে তার কথা জমে যায়। ওই লোক নিজেকে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক পরিচয় দেয়। এরপর জানতে চায় আনিসুর রহমান ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কিনা। তিনিও আক্রান্ত বলে জানান। ওই লোক তার কাছে গাছের তৈরি ওষুধ আছে এবং তা খেলে ডায়াবেটিস সেরে যায় বলে উল্লেখ করেন। একপর্যায়ে বিশ্বাস জমিয়ে তা খাওয়ান। পরে আনিসুর রহমান অচেতন হয়ে পড়লে বেতনের টাকাটা হাতিয়ে নিয়ে কোনো এক সময় গাড়ি থেকে নেমে পড়ে ওই লোক। এরপর আনিসুরকে হাসপাতালে নেয়া হয়।
একই দিন দুপুরে নারায়ণগঞ্জের পাগলায় অবস্থিত জনতা ব্যাংক থেকে প্রকৌশলী নুরুন্নবী (৫২) বেতন থেকে লক্ষাধিক টাকা টাকা তোলেন। এরপর বোরাক পরিবহনের একটি বাসে চড়ে ঢাকায় আসার পথে বাসে তাকে কিছু খাওয়ানো হয় বলে ধারণা করা হচ্ছে। একপর্যায়ে তিনি অচেতন হয়ে পড়েন। হারান তার সঙ্গে থাকা টাকা। পরে বিকালে বাসের সহকারী রাশেদ তাকে ঢাকা মেডিকেলে পৌঁছে দেন। একই দিন সকালে ফকিরাপুল কাঁচাবাজার এলাকা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় রাজবাড়ি থেকে বিদেশে যাওয়ার জন্য ঢাকায় আসা কামরুজ্জামানকে। তাকে অচেতন করে ৬০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয় দুর্বৃত্তরা। একই দিন খিলক্ষেত ফ্লাইওভার এলাকায় সিএনজি অটোরিকশা চালক শাহীনকে (৪০) অচেতন করে তার অটোরিকশা ছিনতাই করা হয়। ঝিনাইদহ থেকে চাকরির ইন্টারভিউ দিতে আসা সত্যেন বিশ্বাসকে (২৬) সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল এলাকায় অচেতন করে ৩ হাজার ৭০০ টাকা নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। একই দিন বিকালে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া বাসস্ট্যান্ড থেকে ফয়েজ আহমেদ (৪০) এবং সন্ধ্যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সামনে আবু বক্কর (৪০) নামে সমবয়সী অপর এক ব্যক্তিকে উদ্ধার করা হয়।
আবু বক্করের আত্মীয় সবুজ মিয়া জানান, পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী আবু বক্করের ইসলামবাগে দোকান রয়েছে। এক লাখ টাকা নিয়ে বের হন। তাকে অচেতন করে সব টাকা নিয়ে গেছে। একই দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়ে অচেতন হওয়া আরও ৬ জনকে ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি করা হয়।
এর পরদিন গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ৫ ব্যক্তি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন। সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার হন হবিগঞ্জ থেকে আসা দুই বন্ধু হাসান (৩৫) ও রুস্তম (৩০)। খিলগাঁওয়ে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অডিট শাখায় কর্মরত ইউনুছ আলী (৫০)।
গত শুক্রবার মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। একই এলাকা থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আজিজুর রহমানকে (৪০)। তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়। একই দিন আরও ৩ জন একই ঘটনার শিকার হয়। গতকাল শনিবারও একাধিক ঘটনায় মলম পার্টির কাছে সর্বস্ব হারিয়েছে বেশ কয়েকজন। এর আগে চলতি মাসের প্রথম দিন সন্ধ্যায় রায়েরবাজারে মোহাম্মদ হানিফ (৪১) নামে এক ব্যবসায়ীকে অচেতন করে ৫০ হাজার টাকা ছিনিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। একই দিন আরও দুজন একই ঘটনার শিকার হন। এছাড়া গত শুক্রবার পৃথক ঘটনায় আরও তিন ব্যক্তি অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছেন বলে জানা গেছে।
গত রোববার বিকেলে রাজধানীর পল্টনে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েন শাহবাগ থানা পুলিশের সদস্য আব্দুস সালাম (৩৭)। পল্টন মোডের ইউবিএল ক্রসিং থেকে উদ্ধার করে তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়।
এছাড়া ২৪শে নভেম্বর সকালে মিরপুরে ছদ্মবেশী অজ্ঞান পার্টির সদস্যের কাছ থেকে ডাব খেয়ে মারা যান হাজী মহসিন (৫৫) নামে মেরুল বাড্ডার এক বাসিন্দা। ওইদিন অচেতন অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকে েভর্তির পর শেষ রাতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিষক্রিয়ায় তার মৃত্যু হয়।
অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা তাদের শিকার সাধারণ মানুষকে অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহার করছে বিষাক্ত মলম ও রাসায়নিক পদার্থ। এসবের বিষক্রিয়া এতটাই তীব্র থাকে যে, নাকে-মুখে তা লাগিয়ে দেয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষ অচেতন হয়ে পড়ে। চেতন ফিরে পেতে প্রয়োগের মাত্রাভেদে কয়েক ঘণ্টা থেকে কয়েক দিন বা এক সপ্তাহও লেগে যায়। যা খুবই ক্ষতিকর। এতে স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গহানির পাশাপাশি জীবননাশের ঝুঁকিও রয়েছে। লোপ পায় স্মৃতিশক্তি। মানসিক বিকৃতিও ঘটে।
ঢাকা মেডিকেলের সহকারী অধ্যাপক ডা. প্রতাপ সাহা মানবজমিনকে বলেন, মলম পার্টির সদস্যরা খুব তীব্র ও বেশিমাত্রার মলম ও রাসায়নিক পদার্থ মানুষের নাকে-মুখে লাগিয়ে দিচ্ছে। এগুলোর বিষক্রিয়ার আকস্মিকতা ও তীব্রতায় মানুষ মারাও যেতে পারে। শ্বাস-প্রশ্বাসে অসুবিধার জন্যও মৃত্যু ঘটতে পারে। তাৎক্ষণিক চিকিৎসায় অনেকে জীবনে রক্ষা পেলেও মস্তিষ্ক, কিডনি, লিভারসহ স্পর্শকাতর প্রত্যঙ্গের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির শিকার হচ্ছেন। ঢাকা মেডিকেলে আসা রোগীদের অধিকাংশের জ্ঞান ফিরতে দু-তিনদিন লেগে যায় বলেও জানান তিনি।

No comments

Powered by Blogger.