যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি ও গণমাধ্যমের রুচিবৈকল্য by শিশির ভট্টাচার্য্য

কয়েক শতাব্দী তক্কে তক্কে থেকে অবশেষে ১৯৮০ সালে আফগানিস্তানে আগ্রাসন করেই ফেলে রাশিয়া। অনতিবিলম্বে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিল সারা বিশ্বের গণমাধ্যম। রাশিয়ার গণমাধ্যমের চোখে অবশ্য রুশ বাহিনী ছিল বহিরাগত দুষ্কৃতদের কবল থেকে আফগানিস্তানকে রক্ষার প্রয়োজনে স্বল্প সময়ের জন্য আসা এক মিত্রবাহিনী মাত্র।
কিছুদিনের মধ্যেই মার্কিন মদদে ও অর্থায়নে মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়ে যায় পাকিস্তান-আফগানিস্তানে। মৌলবাদ ঝাড়ে-বংশে বাড়তে থাকে এবং এর ঢেউ এসে লাগে উপমহাদেশসহ পৃথিবীর সর্বত্র। উপমহাদেশে নারীর পোশাকে দর্শনীয় পরিবর্তন আসে, ফারসি বিদায় সম্ভাষণ ‘খোদা হাফেজ’-এর ব্যবহার কমতে থাকে। ‘জঙ্গিবাদ’ নামক যে দানবের সম্মুখে থরহরি আজ সারা বিশ্ব, তার জন্ম ও বিকাশ হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের ঔরসে, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের গর্ভে, আশি ও নব্বইয়ের দশকে।
কাবুলে দিনে-দুপুরে গোলাগুলি, এখানে-ওখানে বোমা বিস্ফোরণ শুরু হয়ে যায়। সারা বিশ্বের মার্কিনপন্থী গণমাধ্যম তখন সেসব খবর ফলাও করে প্রচার করে। সোভিয়েতপন্থী গণমাধ্যম, বলা বাহুল্য, সন্ত্রাসের সেই সব সংবাদ বেমালুম চেপে যায়। ১৯৮২ সালে রাশিয়া মিসাইল মেরে একটি দক্ষিণ কোরীয় যাত্রীবাহী বিমান গুঁড়িয়ে দিয়েছিল। সারা পৃথিবীর ডানপন্থী গণমাধ্যমে নিন্দার ঝড় ওঠে। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় সাত সাতটি পৃষ্ঠাজুড়ে ছাপা হয়েছিল সেই কমিউনিস্ট কুকীর্তির ছবি ও কাহিনি। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিশোধ নিয়েছিল কদিন পরেই। সুনির্দিষ্ট রুট ধরে এগিয়ে যাওয়া একটি রুশ বেসামরিক বিমানকে ১২৬ জন যাত্রীসহ ভূপাতিত করেছিল অ্যাঙ্গোলার মার্কিন-সমর্থিত স্বাধীনতাকামী যোদ্ধারা। ঠান্ডা মাথায় ঘটানো এই হত্যাকাণ্ডের খবর মাত্র ১০০ শব্দে ছাপা হয়েছিল নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়।
এই যখন অবস্থা, তখন ১৯৮৩ সালের মে মাসে ভ্লাদিমির দানচেভ নামে মস্কো রেডিওর এক রুশ সাংবাদিক আফগানিস্তানে রাশিয়ান আগ্রাসনের সমালোচনা করে মুজাহিদ বাহিনীকে এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান করেন। অনতিবিলম্বে দানচেভকে গ্রেপ্তার করা হয়। মস্কো রেডিও জানায়, অসুস্থ দানচেভকে হাওয়া বদলের জন্য পাঠানো হয়েছে (সম্ভবত সাইবেরিয়ায়, রাশিয়ার সর্বোত্তম আবহাওয়া যেহেতু সেখানেই!)।
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড-সংশ্লিষ্ট মুদ্রণ বা সম্প্রচারনীতিতে সুরুচির অভাব রয়েছে। দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে থেকেই দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হতে থাকে ফাঁস লাগানো ম্যানিলা দড়ির রঙিন ছবি মার্কিন সমাজে ‘বাক্স্বাধীনতা’ নামে একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি আছে বলে শোনা যায়। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যখন ভিয়েতনামে আগ্রাসন করে, তখন কোনো মার্কিন দানচেভ তার সমালোচনা করেনি কেন? নোয়াম চমস্কির মতে, এটা একটা কূটাভাষ। রাশিয়ার মতো স্বৈরতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় একজন প্রতিবাদী দানচেভ সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু আমেরিকার মতো তথাকথিত উদারনৈতিক সমাজব্যবস্থায় কোনো দানচেভের অস্তিত্ব কল্পনাও করা যায় না।
একটি কৌতুক আছে। স্নায়ুযুদ্ধের যুগে পূর্ব জার্মানির এক কুকুর বার্লিন প্রাচীর টপকে পশ্চিম জার্মানিতে পালিয়ে এসেছিল। জাতভাইকে বহুদিনের ভুখা মনে করে পশ্চিমের কুকুরেরা তার সামনে রাশি রাশি খাবার এনে রাখলে শরণার্থী কুকুরটি বলেছিল: ‘এসব খাবার ওদিকে ঢের সস্তায়, অঢেল পাওয়া যায়। খেতে নয়, আমি এখানে প্রাণভরে ঘেউ ঘেউ করতে এসেছি!’ কখন, কোথায়, কতটুকু ঘেউ ঘেউ করা যাবে, সে ব্যাপারে পাশ্চাত্যে একটি অলিখিত নিয়ম আছে। প্যারিসের মতো শহরে জঙ্গি হামলা হলে গণমাধ্যম কিছুদিন খুব হইচই করে। বৈরুত-বামাকোতে হামলা হলে খবরটা কোনোমতে দিয়েই তারা খালাস, যেন ওই শহরগুলো পৃথিবী নামক গ্রহের অংশই নয়।
আরব দেশগুলোতে মিডিয়া স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রশ্নই আসে না। ঘাড়ে কটা মাথা! হিটলারের শাসনামলে জার্মান মিডিয়া, শীতল যুদ্ধের যুগে পূর্ব ইউরোপের মিডিয়া কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বাইরে কিছুই প্রচার করতে পারত না। কিন্তু সেখানকার সাধারণ মানুষ খবরের দুই পঙ্ক্তির মাঝের খবর পড়তে শিখে গিয়েছিল। অর্থাৎ মিডিয়া যা-ই খাবার দিক, তারা ধুয়ে খেত। পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে সরকার যা প্রচার করতে চায়, সচেতন বা অবচেতনভাবে মিডিয়া তা-ই প্রচার করে, ভয়ে নাকি স্বভাবে কে জানে। মিডিয়া যা খাওয়ায়, শতভাগ শিক্ষিত জনগণ চোখ-কান বুজে তা-ই গিলতে থাকে।
বাংলাদেশের জনগণের সাক্ষর অংশের সিংহভাগ শিক্ষাজীবনে গাইডবই এবং কর্মজীবনে পত্রিকা ছাড়া সাধারণত আর কিছুই পড়ে না। সাক্ষর-নিরক্ষরনির্বিশেষে জনগণের বৃহত্তর অংশের চিন্তার খোরাক আসে স্রেফ টেলিভিশনের খবর আর টক শো থেকে। সুতরাং বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে জাতির মানসিক কাঠামোটি হয়তো তৈরি হয় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাতে, কিন্তু সেটির রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নয়নের দায় সাংবাদিকদের ওপরই বর্তায়, তাঁরা না চাইলেও, স্রেফ পেশাগত কারণে।
প্রাচীন রোমে মৃত্যুদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামিদের যখন ছিঁড়ে খেত হিংস্র পশুরা, তখন গ্যালারিতে বসে নাগরিকেরা সেই দৃশ্য উপভোগ করত। পাশ্চাত্যে একসময় আবালবৃদ্ধবনিতা ফাঁসির মঞ্চের চারপাশে ভিড় করে মজা দেখত। যুদ্ধাপরাধের বিচার করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা একটি ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব পালন করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের গণমাধ্যম যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ার ঘটনা দেখাচ্ছে এবং পাঠক ও দর্শক যেভাবে তা নিচ্ছে, তার সঙ্গে পাশ্চাত্যের জনগণের একসময়ের রুচিবৈকল্যের খুব বেশি তফাত কি আছে?
বাংলাদেশের গণমাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড-সংশ্লিষ্ট মুদ্রণ বা সম্প্রচারনীতিতে সুরুচির অভাব রয়েছে। দণ্ড কার্যকর হওয়ার আগে থেকেই দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হতে থাকে ফাঁস লাগানো ম্যানিলা দড়ির রঙিন ছবি। জল্লাদের নাম, ফাঁসুরের সংখ্যা, আসামির পরিবারের কোন সদস্যটি ঠিক কয়টার সময় দেখা করতে এল, তারা কে কী বলল, আসামি ক্ষমা চেয়েছে নাকি চায়নি, শেষ সময়টুকু কার কীভাবে কেটেছে, লাশবাহী গাড়ি কখন বেরিয়ে গেল, গাড়ির রং কী ছিল ইত্যাদি গুরুত্বের সঙ্গে বলা হতে থাকে দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে। আমজনতা হয়তো এসবই জানতে চায়। কিন্তু রুচি বা গণমাধ্যমের দায়দায়িত্বের বিষয়টিকে উপক্ষোর সুযোগ কই।
জনগণের রুচি গঠনে প্রধান ভূমিকা রাখার কথা ছিল গণমাধ্যমের। কিন্তু দেশে দেশে, যুগে যুগে ‘মিডিওকার’ হওয়াই যদি মিডিয়ার ভবিতব্য হয়, তবে জনগণের রুচিবৈকল্য আরোগ্যের সম্ভাবনা ‘হনুজ দূর অস্ত’।
শিশির ভট্টাচার্য্য: অধ্যাপক, আধুনিক ভাষা শিক্ষা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

No comments

Powered by Blogger.