রুশ-তুরস্ক উত্তেজনায় আরেক পারমাণবিক বিশ্বযুদ্ধ আসন্ন? by মাসুম খলিলী

সিরিয়ায় রাশিয়ার সামরিক অভিযানের জের ধরে তুরস্কের আকাশসীমা লঙ্ঘন এবং তুর্কি আঘাতে রুশ বিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে রুশ শীর্ষ রাজনীতিবিদ ঝিরিনস্কি পারমাণবিক বোমা ফেলে ইস্তাম্বুলের ৯০ লাখ মানুষ হত্যার আহ্বান জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি। ভ্লাদিমির ঝিরিনভস্কি বলেছেন, একটি পারমাণবিক আক্রমণ খুব সহজেই ইস্তাম্বুুল ধ্বংস করে দিতে পারে। ইস্তাম্বুল প্রণালীতে শুধু একটি পরমাণু বোমা ফেলে দিলে তাতে ১০ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত সুনামি হয়ে ইস্তাম্বুলের ৯০ লাখ মানুষকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। ঝিরিনভস্কি রাশিয়ার এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছেন তুরস্ককে। রাশিয়ার শীর্ষ নিরাপত্তা বিশ্লেষক পাভেল ফেলজেনহাউয়ার তুরস্কের রুশ জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় পারমাণবিক যুদ্ধ সৃষ্টির আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, গতানুগতিক যুদ্ধে রাশিয়া ন্যাটোর সাথে পেরে উঠবে না। ফলে মস্কোর জন্য পারমাণবিক যুদ্ধ শুরুর কোনো বিকল্প থাকবে না। তুরস্ক ন্যাটোর পঞ্চম ধারা দ্বারা সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও খুব সম্ভবত রাশিয়া যুদ্ধবিমান ধ্বংসের ঘটনায় একটি পারমাণবিক যুদ্ধ শুরু করবে। ফেলজেনহাউয়ার মন্তব্যটি এ রকম- ‘সম্ভবত একটা যুদ্ধ হবে। অন্য কথায়, রাশিয়ান বোমারু বিমান রক্ষার জন্য রুশ বিমান যখন তুর্কি বিমানে আঘাত করবে তখন সঙ্ঘাত আরো বিস্তৃত হবে। এটা সমুদ্রে রাশিয়ান এবং তুর্কি নৌবহরের মধ্যে সঙ্ঘাত সৃষ্টি করতে পারে।’
পারমাণবিক যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিভীষিকা কী হতে পারে এ বিষয়ে কারো অজানা থাকার কথা নয়। কিন্তু এরপরও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে এমন এক অচলাবস্থার দিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে, যার পরিণতি যেন হতে চলেছে পারমাণবিক সঙ্ঘাত। তুরস্ক ও রাশিয়ার মধ্যকার যুদ্ধ বা সঙ্ঘাত সেই জার ও উসমানিয়া শাসন আমলে বারবার দেখা গেলেও এখন প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। তুরস্ক এখন আর পরাশক্তি নয়। কিন্তু তুরস্ক সোভিয়েত ইউনিয়নবিরোধী সামরিক জোট ন্যাটোর সদস্য দেশ। ন্যাটো চুক্তির পাঁচ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে এই নিরাপত্তা জোটের একটি সদস্য দেশ আক্রান্ত হলে অন্য সব দেশ আক্রান্ত হয়েছে বলে গণ্য করা হবে। এ ধারা অনুসারে নাইন-ইলেভেনের পর আফগানিস্তানে তালেবান সরকারের পতন ঘটাতে ন্যাটোর সব মিত্র দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে দাঁড়ায়। চুক্তি অনুযায়ী রাশিয়ার যেকোনো আক্রমণে দ্বিতীয় বৃহত্তম সামরিক সদস্য দেশ তুরস্কের পাশে থাকার কথা ন্যাটোর। ইতোমধ্যে রুশ জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করার ঘটনায় ন্যাটো আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ বিমানের তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘনের স্বীকৃতি দিয়ে বলেছে, ন্যাটোর সদস্য দেশটির নিজ আকাশসীমার নিরাপত্তা রক্ষার অধিকার রয়েছে।
কৌশলগত টানাপড়েন
রাশিয়ার সাথে প্রতিবেশী তুরস্কের সম্পর্ক গত দেড় দশকে ক্রমেই ঘনিষ্ঠ থেকে ঘনিষ্ঠতর হয়েছে। আঙ্কারা রাশিয়ান গ্যাসের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্রেতা। রুশ পর্যটকদের একটি বড় সংখ্যা প্রতি বছর তুরস্ক ভ্রমণ করে। এ দুই দেশের এক দেশের নাগরিকদের অন্য দেশ ভ্রমণের জন্য ভিসার প্রয়োজন হয় না। দুই দেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের অঙ্কও ক্রমেই বাড়ছিল। এ অবস্থার মধ্যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয় সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদবিরোধী বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে। রাশিয়ার একমাত্র উষ্ণ পানির নৌঘাঁটির অবস্থান সিরিয়ার লাতাকিয়ায়। সোভিয়েত আমল থেকেই রুশ নিরাপত্তা ও প্রভাব বিস্তারের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হিসেবে এটি বিবেচিত হয়ে আসছিল। বাশারের পতন ঘটলে এ ঘাঁটির স্থায়িত্ব হুমকির মধ্যে পড়তে পারে। ফলে যখনই বাশার আল আসাদের পতন ঘটার মতো অবস্থা দেখা দিয়েছে, তখন রাশিয়া বর্ধিত সামরিক সহায়তা দিয়েছে দামেশককে।
সর্বশেষ বাশারবিরোধী আন নুসরা ফ্রন্ট রাজধানী দামেস্কের চার পাশে চলে এলে বাশার প্রশাসনের টিকে থাকা নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দেয়। ইরানের আল কুদস বিশেষ বাহিনী ও হিজবুল্লাহর প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশগ্রহণের পরও দামেস্কে আসাদের পতন ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়। অন্য দিকে, আমেরিকান নেতৃত্বাধীন আইএসবিরোধী কোয়ালিশনের হাঁকডাক যতই শোনা যাক না কেন, আইসিসের শক্তি ক্রমেই বিস্তৃত হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে রাশিয়া সিরিয়ায় তার ঘাঁটি ও অন্যান্য স্বার্থ রক্ষার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে প্রত্যক্ষভাবে।
সিরিয়ায় রাশিয়ার সর্বাত্মক সামরিক হস্তক্ষেপ যে তুরস্কের সাথে সম্পর্কে একটি বৈরী পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে তা হিসাব-নিকাশের বাইরে থাকার কথা নয়। কিন্তু রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল ও ইউক্রেনের প্রক্সি যুদ্ধে রুশ বংশোদ্ভূূত সংখ্যাগুরু অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পর যে অর্থনৈতিক অবরোধের মুখে পড়ে, তা থেকে উত্তরণে আগ্রাসী ভূমিকা নেয়ার হয়তোবা প্রয়োজন দেখা দেয়।
ইউক্রেনের পরিবর্তে সিরিয়াকে প্রক্সিযুদ্ধের জন্য বেছে নেয়ার মধ্যে অবশ্য কৌশলগত বেশ কিছু সুবিধা রয়েছে রাশিয়ার। প্রথমত এই সঙ্ঘাতে আঞ্চলিক শক্তি ইরানের সর্বাত্মক সমর্থন লাভ করবে মস্কো। দ্বিতীয়ত তুরস্ক ন্যাটোভুক্ত দেশ হলেও আঙ্কারার কিছু ভারসাম্যমূলক স্বাধীন নীতি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের অনেক দেশের পছন্দ নয়। ক্রিমিয়া দখলের পর রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক অবরোধের অংশ হতে তুরস্ক অস্বীকৃতি জানায়। ফলে তুরস্ককে ন্যাটো মিত্ররা সমর্থন দিলেও এই সমর্থন নিরঙ্কুশ হবে না। বিশেষত ফ্রান্স প্যারিসে হামলার আগে ও পরে মধ্যপ্রাচ্যে সার্বিকভাবে ইসলামিক শক্তির প্রতি বৈরী মনোভাবের পরিচয় দেয়। তৃতীয়ত তুরস্কের একেপির উত্থানকে ইউরোপের অনেক দেশই উৎকণ্ঠার সাথে দেখছে। ইকোনমিস্টসহ প্রভাবশালী বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম এরদোগান শাসনকে তুর্কি সালতানাতের নব্য সংস্করণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চেয়েছে। তুরস্কের সাথে সঙ্ঘাতে জড়ালেও ইউরোপ আঙ্কারার পক্ষে সেভাবে নাও জড়াতে পারে। চতুর্থত বসফরাস প্রণালীতে রুশ জাহাজের আনাগোনার জন্য উন্মুক্ত রাখা মস্কোর স্বার্থের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আইএস ইস্যুকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার এই অঞ্চলে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারলে আঙ্কারা বসফরাস বন্ধ করার বিষয়টি সহজে ভাববে না।
সঙ্ঘাতে দুই দেশের অর্থনৈতিক ঝুঁকি
তুরস্কের সাথে সঙ্ঘাতে নেমে রাশিয়াও কম ঝুঁকি নেয়নি। রাশিয়ার ওপর যেমন তুরস্কের অর্থনীতির বিকাশ খানিকটা নির্ভর করে, তেমনিভাবে রাশিয়ার জ্বালানির বাজার বেশ খানিকটা তুরস্কনির্ভর। গ্যাস পাইপলাইন ও পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ বেশ কিছু বিনিয়োগ প্রকল্প রয়েছে দুই দেশের। ইতোমধ্যে এসব প্রকল্পে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। রাশিয়াও সিরিয়ার যুদ্ধ অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাওয়ার অবস্থানে নেই। এককভাবে ইরান রাশিয়ার অবস্থানকে ধরে রাখতে সহায়তা করতে পারবে না।
রাশিয়া তুরস্কের সাথে সম্পর্কচ্ছেদের ব্যাপারে নানা পদক্ষেপের কথা বললেও একাধিক কারণে দুই দেশের মধ্যে এই সম্পর্কচ্ছেদ বেশ বিরূপ হয়ে উঠতে পারে। প্রথমত, বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে রাশিয়ার বন্ধুর সংখ্যা একেবারে সীমিত। দেশটির সীমিত কয়েকটি মিত্র দেশের মধ্যে একটি ছিল তুরস্ক। ইউক্রেন ইস্যুতে ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের অর্থনৈতিক অবরোধে তুরস্ক অংশ নেয়নি। দেশটি ২০২০ সালের মধ্যে রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য তিন গুণ করে ১০০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার পরিকল্পনা করেছে। বর্তমান উত্তেজনা দুই দেশের এই সম্পর্কে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রাশিয়া তুরস্ক থেকে খাদ্য ও কৃষিপণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি আরোপের কথা বলেছে। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ সংস্থা বলেছে, তারা তুরস্কের কাপড় ফার্নিচার শোধন সামগ্রীর গুণগত মান নিয়ে উদ্বিগ্ন।
দ্বিতীয়ত কৌশলগত জ্বালানি সংযোগ দুই দেশের সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। মাত্র এক বছর আগে দুই দেশ কৌশলগত একাধিক জ্বালানি চুক্তি সম্পাদন করেছে। রাশিয়ান গ্যাস তুরস্কে নিয়ে গিয়ে সেখান থেকে ইউরোপে নেয়ার জন্য একটি নতুন পাইপলাইন প্রকল্প ‘টার্কিশ স্ট্রিম প্রজেক্ট’-এর মধ্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ পাইপলাইন দিয়ে ইউক্রেনের ওপর দিয়ে যে সাউথ স্ট্রিম প্রজেক্ট রয়েছে, তার বিকল্প হিসেবে রাশিয়ান গ্যাস ইউরোপে নেয়ার পরিকল্পনা ছিল। জার্মানির পরে তুরস্ক রাশিয়ার বড় গ্যাস ক্রেতা। রাশিয়া একই সাথে তুরস্কের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রও নির্মাণ করছে। গত এপ্রিলে এর নির্মাণকাজ শুরু হয়েছে এবং আগামী ২০২০ সালে এটি শেষ হওয়ার কথা। ২২ বিলিয়ন ডলারের এই প্রকল্পে রাশিয়ার অর্থায়ন, নির্মাণ এবং এরপর পরিচালনা করার কথা। এই উভয় প্রকল্পই এখন অবরোধের মধ্যে রয়েছে বলে রুশ অর্থমন্ত্রী অ্যালেক্সি উলিয়াকায়েভ উল্লেখ করেছেন।
তৃতীয়ত তুরস্কের জন্য রাশিয়ান পর্যটকপ্রবাহ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০১৪ সালে ৪৫ লাখ রুশ পর্যটক তুরস্কে গেছে। সরকারি ডেটা অনুযায়ী তুরস্কের মোট পর্যটকের ১২ শতাংশ হলো রাশিয়ান। তুরস্ক ভ্রমণকারীদের মধ্যে জার্মানির পরেই রাশিয়ানদের স্থান। পুতিন রুশদের তুরস্কে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। রাশিয়ান টুরিজম এজেন্সিগুলোকে তুরস্কে ভ্রমণের প্যাকেজ বিক্রি না করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। শারম আল শেখের বিমান দুর্ঘটনার পর মিসরে রাশিয়ান পর্যটক যাত্রা বন্ধ হওয়ার ফলে তুরস্কে ব্যাপক হারে রাশিয়ান পর্যটক ভ্রমণ শুরু হয়েছিল। এখন আর সে চিত্র নেই।
চতুর্র্থত রাশিয়া ও তুরস্ক- দুই দেশই এখন বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে পড়েছে। এ সময় সঙ্কট উত্তরণের জন্য প্রয়োজন ছিল একে অন্যের সহযোগিতা বাড়ানো। তেলের দাম কমে যাওয়া এবং পশ্চিমা অবরোধের কারণে রাশিয়ান জিডিপি ৩.৮ শতাংশ সঙ্কুচিত হয়েছে। আর ২০১৬ সালে আরো ০.৬ শতাংশ সঙ্কুচিত হবে বলে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। তুরস্কের অর্থনীতির অবস্থাও ভালো নয়। তুরস্কের এবারের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৩.১ শতাংশ এবং ২০১৬ সালে ৩.৮ শতাংশ হবে বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। এটি ২০১০ ও ২০১১ এর ৯ শতাংশ প্রবৃদ্ধির তুলনায় বেশ কম। ডলারের বিপরীতে তুর্কি লিরার মূল্য এর মধ্যে ২০ ভাগ কমে গেছে। এটি তুরস্কের ১২৫ বিলিয়ন ডলার বিদেশী ঋণের দায়কে স্থানীয় মুদ্রায় অনেক বাড়িয়ে দেবে।
রাশিয়ার মিত্র জোগাড়ের চেষ্টা?
একাধিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক ন্যাটোর সাথে রাশিয়ার আসন্ন যুদ্ধের আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করেছেন। মস্কো ইতোমধ্যে ন্যাটো ও এর মিত্রশক্তির মোকাবেলা করতে পারমাণবিক স্থাপনা বিন্যাসের কাজ শুরু করেছে বলেও উল্লেখ করা হচ্ছে। একই সাথে দেশটি অন্য পারমাণবিক শক্তিগুলোর সাথে বিশেষ বন্ধন তৈরিরও চেষ্টা করছে। চীনের পাশাপাশি পাকিস্তানের সাথে সামরিক সম্পর্ক জোরদার করতে মস্কো একটি ব্যাপকভিত্তিক সামরিক সহায়তা চুক্তি করেছে ইসলামাবাদের সাথে। গত সপ্তাহে মস্কো ও ইসলামাবাদের এই সামরিক সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরের পর রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী সের্গেই শোয়াইগো বলেছেন, বিশ্ব সম্প্রদায় এখন পাকিস্তানের সঙ্গে ব্যবসা করতে চায়। প্রাথমিকভাবে ভারত রাশিয়ার বলয় থেকে ক্রমেই আমেরিকামুখী হওয়ার প্রতিক্রিয়া হিসেবে এটি ঘটছে বলে উল্লেখ করা হলেও এর সাথে বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির যোগসূত্র থাকতে পারে। ইতোমধ্যে ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় রাশিয়া সামরিক সরবরাহে পিছিয়ে পড়েছে। অচিরেই এটি যে শূন্যের কাছাকাছি চলে আসবে তা এক প্রকার নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
রাশিয়া, চীন ও পাকিস্তানের মধ্যে একটি ত্রিভুজ পরাশক্তি অক্ষের উত্থান ঘটার ব্যাপারে বিশ্ব মিডিয়ায় নিয়মিত রিপোর্ট প্রকাশ হচ্ছে। ইতোমধ্যে এ ধরনের পরাশক্তি অক্ষের গঠনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে বলে মনে হচ্ছে। ব্লুমবার্গ পত্রিকা ইতার-তাসকে উদ্ধৃত করে বলেছে, রাশিয়া ও পাকিস্তান ইতোমধ্যেই সন্ত্রাসবাদবিরোধী সহযোগিতার অংশ হিসেবে আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে বন্দরে সামরিক জাহাজ আনাগোনা বৃদ্ধি করেছে। রুশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী এবং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের গত সপ্তাহে বৈঠককালে দুই দেশের মধ্যে ৫৪ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যকে আরো বাড়ানোর ব্যাপারে ঐকমত্য হয়। বেইজিং ও মস্কো উভয়ে তাদের স্বার্থের প্রতি ওয়াশিংটনকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে। বিশ্বব্যাপী আমেরিকান আধিপত্য বন্ধ করার স্বার্থে তাদের অভিন্ন অবস্থান গ্রহণ বলে মনে করা হচ্ছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে পাকিস্তানের উল্লেখযোগ্য কোনো মতবিরোধ দেখা যায় না। তবে ভারতের সাথে ওয়াশিংটনের কৌশলগত সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা এবং নিজস্ব অখণ্ডতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য চীনা এবং রাশিয়ান প্রভাববলয়কে পাকিস্তান এখন নিরাপদ মনে করছে। আর সিরিয়া থেকে ইরাক ইরান আফগানিস্তান হয়ে পাকিস্তান পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় মিত্রবলয় তৈরির প্রতি দৃষ্টি রয়েছে ক্রেমলিনের।
নতুন উত্তেজনায় বহুমুখী প্রভাব?
রাশিয়ার জঙ্গিবিমান গুলি করে ধ্বংস করার ঘটনার পর তুরস্কের সাথে সম্পর্কে যে নতুন উত্তেজনা দেখা দিয়েছে, তার সুদূরপ্রসারী প্রভাব অনলগর্ভ মধ্যপ্রাচ্যের বহুমুখী সঙ্ঘাতে নতুন মাত্রা যোগ করতে যাচ্ছে। এর মাধ্যমে সিরীয় সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের যে কিছুটা সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল, সেটিও অনিশ্চিত হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। রাশিয়ার জঙ্গিবিমান ভূপাতিত করার ঘটনাকে পুতিন যে কতটা মারাত্মকভাবে নিয়েছেন, তা স্পষ্ট হয় তার প্রতিক্রিয়া দেখানোকে সামনে রাখলে। এটাকে কেন্দ্র করে রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ল্যাভরভের আঙ্কারা সফর বাতিল ঘোষণা করা হয় শুরুতে। রুশ বিমান ভূপাতিত করার ঘটনাকে পিঠে ছুরিকাঘাত হিসেবে বর্ণনা করেছেন পুতিন। একই সাথে তুরস্কের সাথে সব ধরনের সম্পর্ককে নতুন করে মূল্যায়ন করার ঘোষণাও দিয়েছেন। তিনি এমন কথাও বলেছেন, তুরস্কের বর্তমান নেতৃত্বের ইসলামীকরণের চেষ্টা তার জন্য বিরক্তিকর। এর পাল্টা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত হয় তুর্কি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের পক্ষ থেকে। তিনি ৯৯ শতাংশ মুসলিমের দেশে ইসলামীকরণের অভিযোগকে ঔদ্ধত্য হিসেবে বর্ণনা করেন। সিরিয়ার যে প্রেসিডেন্ট তিন লাখ ৮০ হাজার মানুষের হত্যার জন্য দায়ী, তার পক্ষ সমর্থনকে সন্ত্রাসের সহযোগিতা হিসেবে মূল্যায়ন করেন।
তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান রাশিয়া সফর করার দুই দিনের মাথায় রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করে বসেন। এই হস্তক্ষেপের বিষয় এরদোগানের সাথে আলোচনায় এসেছিল বলে মনে হয়নি এ ঘটনায় তুরস্কের প্রতিক্রিয়া দেখে। সিরিয়ায় সামরিক হামলার পর রুশ জঙ্গিবিমান একাধিকবার তুর্কি আকাশসীমা লঙ্ঘন করে। এসব ঘটনার কোনো কোনোটি অনিচ্ছাকৃত মনে হলেও কিছু ঘটনা আঙ্কারাকে বার্তা দেয়ার জন্য বলে মনে হয়েছে। তুরস্ক বলেছে, সর্বশেষ দফা আকাশসীমা লঙ্ঘনের পর তুর্কি বিমান থেকে পাঁচ মিনিট ধরে ১০ বার সতর্কবাণী উচ্চারণ করার পর রুশ বিমানে গুলি করা হয়েছে। মস্কোর বক্তব্য হলো রুশ বিমানটি আদৌ তুরস্কের আকাশসীমায় প্রবেশ করেনি। পরে বিমানটির গতি পথের এক মানচিত্রে দেখা যায় বিমানটি স্বল্পসময়ের জন্য তুরস্কের আকাশসীমায় প্রবেশ করেছিল। তবে গুলি বা ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে এটি ধ্বংস হওয়ার পর সিরিয়ার ভূ-সীমায় এটি পতিত হয়েছে।
সিরিয়া ১৫১৬ সাল থেকে ছিল তুর্কি খেলাফতের অধীনে, উসমানিয়া সাম্রাজ্য ভেঙে যাওয়ার আগে পর্যন্ত সেভাবেই ছিল। ‘তুর্কম্যান’ বিদ্রোহীদের ওপর বোমা বর্ষণ করার সময় যে রুশ সু-২৪ বিমানটি ভূপাতিত করা হয়েছে, তারা জাতিগতভাবে তুর্কি। ১৯২১ সালের চুক্তির আলোকে সীমান্ত আরোপ করার সময় এই তুর্কিরা তুরস্ক সীমান্তের বাইরে পড়ে যায়। দীর্ঘ দিন আগে কেটে বাদ দেয়া হলেও সাবেক সাম্রাজ্যগুলো তাদের অদ্ভুত মানসিক কারণে এখনো মনে করে, ওইসব এলাকায় হস্তক্ষেপ করার তাদের বিশেষ অধিকার রয়েছে। পুতিন বলছেন, তিনি তুর্কমেন পর্বতমালায় ইসলামিক স্টেটের ওপর বোমা ফেলছে, যদিও সেখানে বা তার কাছাকাছি কোনো এলাকাতেও ইসলামিক স্টেট বাহিনীর কোনো উপস্থিতির রেকর্ড নেই। তারা হলো আসাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেয়া তুরস্ক সমর্থিত মধ্যপন্থী বিদ্রোহী।
এরদোগানের লক্ষ্যগুলোর একটি ক্রেমলিনের কাছেও পরিচিত। এটি হলো রাশিয়ার সাথে অভিন্ন কৌশল গ্রহণে সমঝোতায় আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও অন্যান্য দেশকে বেশ জোরালোভাবে দেখানো যে, তুরস্কের স্বার্থ পুরোপুরি বিবেচনায় না নেয়া হলে সিরিয়ায় কোনো সমাধানই ফলপ্রসূ হবে না। তুর্কি স্বার্থগুলোর মধ্যে রয়েছে, আসাদের সাথে সমাঝোতা হলে যাতে তুর্কম্যানই হোক আর আরবই হোক, কোনো সুন্নি শক্তিকে ধ্বংস করা না হয়। রাশিয়ার জন্য সঠিক কাজ হতে পারে এটা স্বীকার করে নেয়া যে, সে তুর্কি স্পর্শকাতরতাকে দেশটি যথাযথভাবে মূল্যায়ন করেনি। পুতিনের অনেক বৈরী প্রতিবেশী যেমন রয়েছে তেমন আছে সাবেক মিত্রও। কিন্তু আরো অগ্রসর হওয়ার প্রলোভনও রয়েছে তার সামনে। আবার হয়তো এরদোগানের হিসাবেও ভুল রয়েছে। অথবা রয়েছে ক্ষমতাধরদের কাছে তার অজ্ঞাত কোনো বাধ্যবাধকতা। এটি অনস্বীকার্য যে, পুতিন ইউক্রেনে যতটা দুর্বল, এরদোগান সিরিয়ায় তার চেয়েও বেশি দুর্বল।
বর্তমানে প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে রাশিয়া অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে যাচ্ছে, উত্তর সিরিয়ায় বিমানবিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা মোতায়েন করতে যাচ্ছে, তুর্কমেন পর্বতমালায় বোমাবর্ষণ দ্বিগুণ করতে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এরদোগানের করণীয় নানা কারণে ঝুঁকিপূর্ণ। রাশিয়ার সাথে এরদোগানের অর্থনৈতিক সহযোগিতাকে অনেক পশ্চিমা মিত্র ভালোভাবে নেয়নি। এ জন্য এরদোগানকে নানাভাবে চাপে রাখতে চেয়েছে তারা। জুনের নির্বাচনে তার বিপর্যয়কর ফলাফল এবং সিরিয়ায় রাশিয়ান হস্তক্ষেপকে গোপনে অনুমোদন করার যে অভিযোগ আমেরিকার ব্যাপারে উঠছে, সেটি সঠিক হলে এরদোগানকে রাশিয়ার মুখোমুখি করে রাখার একটি প্রচেষ্টা অন্তরালে সক্রিয় থাকতে পারে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য পরিণামদর্শী নীতি দুই দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যা এখনো সেভাবে দেখা যাচ্ছে না। তা না হলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধপরিস্থতি আরো ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। যার জের ধরে যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে সেটিও অসম্ভব নয়।
mrkmmb@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.