জলবায়ু নীতিতে বাস্তববাদিতা by অলিভার জেনডেন

জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরার জন্য আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলছে, তার ধরন-ধারণে মৌলিক পরিবর্তন এসেছে। ১৯৯২ সাল থেকে ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার মনোভঙ্গির আলোকে এই প্রচেষ্টা চলছিল, তার জায়গায় এখন ধীরে ধীরে নিচ থেকে মতামত গ্রহণের মডেল চলে এসেছে। গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস করার জন্য আইনি মডেলের বদলে এখন চেষ্টা করা হচ্ছে, সব দেশ যেন আলাদাভাবে অঙ্গীকার করে, তারা এই নিঃসরণ কতটা কমাবে।
এক অর্থে এটা আসলে ব্যর্থতার স্বীকারোক্তি, এই মনোভঙ্গি দিয়ে বৈশ্বিক তাপমাত্রা হ্রাসে ২০১০ সালে জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের সীমা অর্জন করা যাবে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত অগ্রগতির শম্বুকগতি দেখে মনে হয়, বিশাল পরিসরে চুক্তি করার চেয়ে প্রতিটি দেশের পৃথকভাবে অঙ্গীকার করাটা বরং বাস্তবসম্মত, কারণ এই বড় বড় চিন্তা কখনোই বাস্তবায়িত হয় না।
গত পাঁচ বছরে এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আলোচনাকারীরা প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন, কিন্তু জাতিসংঘের বেঁধে দেওয়া ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্য অর্জনের জন্য আরও অনেক কিছু করতে হবে। ফলে বৈশ্বিক চুক্তি করতে আবারও ব্যর্থ হলে আন্তর্জাতিক এই আলোচনা প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা বিনষ্ট হবে ভেবে কূটনীতিকেরা ভীত হয়ে লক্ষ্যমাত্রা বদলে ফেলেছেন।
সুনির্দিষ্টভাবে বললে, নিঃসরণ কমানোর মাত্রা বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারটা সবার অলক্ষ্যেই বাদ পড়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবেশের জন্য কোনটা কাঙ্ক্ষিত, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে যা অর্জনযোগ্য, সবার দৃষ্টি এখন সে দিকেই। অর্থাৎ আলোচনা প্রক্রিয়ার সম্ভাবনা ও বাধা কী কী, যার লক্ষ্য হচ্ছে অধিকাংশ দেশের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। ১৯৯৫ সালের ইউএন ক্লাইমেট চেঞ্জ সামিটের পরবর্তী পর্যায়ে উত্তরণের ধীরগতির কারণে ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন ক্লাইমেটের সব পক্ষের উপস্থিতি নিশ্চিত করা গেলে তা ঐতিহাসিক সফলতা হিসেবে স্বীকৃতি পাবে।
সে কারণে এই নভেম্বর ও ডিসেম্বরের প্যারিসে জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক সম্মেলনে যখন বিশ্বনেতা ও পরিবেশমন্ত্রীরা একত্র হচ্ছেন, তখন আর নিঃসরণ কমানোর বহুল কথিত আইনি বাধ্যবাধকতাসম্পন্ন চুক্তি করা বাস্তবসম্মত মনে হচ্ছে না। বিশ্বের শীর্ষ তিন নিঃসরণকারী অর্থাৎ চীন, ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এটা পরিষ্কার করে বলেছে, তারা নিজেরাই নির্ধারণ করবে কোন পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তারা যেহেতু নিজেদের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে ফেলেছে, সেহেতু তারা আর বহুপক্ষীয় সমঝোতা করবে বলে মনে হয় না।
নিঃসরণ কমানোর মাত্রা বেঁধে দেওয়ার ব্যাপারটা সবার অলক্ষ্যেই বাদ পড়ে যাচ্ছে। ফলে পরিবেশের জন্য কোনটা কাঙ্ক্ষিত, সেটা আর এখন আলোচনার বিষয় নয় নিশ্চিতভাবে কিছু কূটনীতিক এ কথাটা খুব পরিষ্কারভাবে বলবেন। সেটা করলে তাঁরা যে গত ২০ বছরে ব্যর্থ হয়েছেন, সেটা স্বীকার করে নেওয়া হবে। এর বদলে তাঁরা যে নিচ থেকে মতামত নেওয়ার মনোভঙ্গি তৈরি করেছেন, সেটা আসলে আগের ওপর থেকে আরোপিত কাঠামো থেকে শুধু বেরিয়ে আসা নয়, এটা এক বাস্তবসম্মত সম্পূরণী, যার মধ্যে শীর্ষ নিঃসরণকারীরা জায়গা পাবে। এর মাধ্যমে বড় শহর ও কোম্পানির মতো সত্তাগুলোর জলবায়ু পরিবর্তন-বিষয়ক কিছু করার কাঠামো সৃষ্টি হবে।
কিন্তু সত্য হচ্ছে মানুষ এই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার মনোভঙ্গিটি ইতিমধ্যে ত্যাগ করেছে। এটা পরিষ্কার যে প্যারিস সম্মেলনে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যাবে না, বা অন্য কোনো কঠোর আইনি বিষয়েরও সমাধান হবে না।
১৬০টি দেশের নিঃসরণের ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা একত্র করা হলে তাদের ব্যর্থতার মাত্রা পরিষ্কার হয়ে যাবে। এমনকি সব দেশ যদি খুব কঠোরভাবে নিজেদের প্রতিশ্রুতি পালন করে এবং পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলেও সেটা সম্ভব হবে না।
হ্যাঁ, প্যারিস সম্মেলনের ঘোষিত লক্ষ্য হবে ‘২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রাকে আয়ত্তের মধ্যে রাখা’। কূটনীতিকেরা পরিকল্পনা করছেন, তাঁরা এমন এক প্রক্রিয়া অনুসরণ করবেন, যাতে ধারাবাহিকভাবে আকাঙ্ক্ষা বৃদ্ধি করা সম্ভব হয়। যার কারণে হতাশাজনক ফলাফলের গতিমুখ পাল্টে ইতিবাচক ধারায় প্রবাহিত হবে, আর অধিকতর উচ্চাকাঙ্ক্ষী নীতির আশা জিইয়ে থাকবে।
তথাপি, আশাবাদের আরও কারণ রয়েছে, কারণ আদর্শবাদের চেয়ে বাস্তববাদ আরও শক্তিশালী। বহুদিন ধরে বহু চেষ্টার পরেও এই ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়ার মনোভঙ্গি পরিষ্কারভাবেই কাজে আসেনি, ফলে নিচ থেকে মতামত নেওয়ার মনোভঙ্গি গ্রহণ করার মধ্য দিয়ে এটা নীরবে মেনে নেওয়া হলো যে কোনো দেশকে জোর করে কিছু মানানো যায় না, তা সে যতই বৈজ্ঞানিক তথ্য–প্রমাণসমৃদ্ধ হোক না কেন।
এদিকে স্বেচ্ছাপ্রসূত পদক্ষেপ গ্রহণের কারণে ইতিমধ্যে কিছু অগ্রগতিও হয়েছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও চীন সমন্বিত অঙ্গীকার করেছে। এই নিচ থেকে মতামত নেওয়ার মনোভঙ্গি সার্বভৌম দেশগুলোর কাজ করার ধরনকে শ্রদ্ধা করে বলে এমন সম্ভাবনা আছে যে এটা ইতিবাচক গতি সৃষ্টি করতে পারে। অধিকাংশ সরকারই আসলে রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও স্বল্পমেয়াদি অর্থনৈতিক সফলতাকে গুরুত্ব দেয়, ফলে এই দেশগুলো যদি জানতে পারে যে তাদের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীরাও এই কাজে হাত দিয়েছে, তাহলে তারাও জলবায়ু পরিবর্তনের রাশ টেনে ধরার কাজে হাত লাগাবে।
এখন ভারসাম্য করলে দেখা যাবে, এই নিচ থেকে মতামত নেওয়ার মনোভঙ্গির বিকাশ আসলে জলবায়ু পরিবর্তনের লড়াইয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আগামী দিনের পৃথিবী যদি আজকের চেয়ে ৩ ডিগ্রি বেশি গরম হয়, তাহলে সেটা আদর্শ পৃথিবী থেকে অনেক দূরে চলে যাবে। কিন্তু সেটা জলবায়ু পরিবর্তনের গতি-প্রকৃতি আয়ত্তের বাইরে চলে যাওয়ার চেয়ে ভালো।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
অলিভার জেনডেন: জার্মান ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড সিকিউরিটি অ্যাফেয়ার্সের ইউরোপীয় ইউনিয়ন গবেষণা বিভাগের প্রধান।

No comments

Powered by Blogger.