ইসি : ‘চোখ নেই, শিং নেই, নখ নেই...’ by ড. আবদুল লতিফ মাসুম

ইলেকশন কমিশন হচ্ছে একটি নিরপেক্ষ সংস্থা, এটি নির্বাচনী কাজের জন্য নিয়োজিত। এর দায়িত্ব হচ্ছে; ১. নির্বাচনে নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা, ২. নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালনা করা, ৩. নির্বাচনী এলাকা নির্ধারণ করা ও ৪. নির্বাচন ব্যবস্থা তদারকি করা। গণতান্ত্রিক দেশগুলোর মধ্যে নানা নামে, নানাভাবে নির্বাচন প্রক্রিয়া পরিচালিত হয়। ইলেকশন কমিশন নামে প্রতিষ্ঠানটি কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোতে বেশ কার্যকর। ভারত, কলম্বিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় ইলেকশন কমিশন পরিপূর্ণ ক্ষমতা এবং দায়িত্বের সাথেই পরিচালিত হচ্ছে। বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রে সংসদীয় সরকারব্যবস্থা কার্যকর রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে ইলেকশন কমিশন সাংবিধানিকভাবে বেশ শক্তপোক্ত। বলা হয়ে থাকে, যেসব সংবিধানে ইলেকশন কমিশনকে নির্বাচনব্যবস্থা পরিচালনার জন্য প্রভূত ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, তাদের মধ্যে সম্ভবত বাংলাদেশ সংবিধান সবার শীর্ষে অবস্থান করে। বাংলাদেশ সংবিধানের সপ্তম ভাগে ১১৮ অনুচ্ছেদ থেকে ১২৬ অনুচ্ছেদ পর্যন্তÑ নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব, কর্তব্য এবং ক্ষমতায়ন ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ১১৮ এর ৪ উপধারায় বলা হয়েছে, ‘নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন’। ১৯৭২ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত নির্বাচন কমিশনের কার্যকারিতা পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতার প্রয়োগ নির্ভর করেছে কমিশন নেতৃত্বের ওপর। শাসক দল বশংবদ নেতৃত্ব পছন্দ করলেও কেউ কেউ কুশলতা, অভিজ্ঞতা, সাহস ও সততা দ্বারা যেকোনো বৈরিতাকে অতিক্রম করতে পেরেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে যখন আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়, তখন তারা তাদের মনোনীত প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবউদ্দীনকে নির্বাচনী ফলাফল বাতিল করার জন্য চাপ দেয়। কথা না শুনলে তাকে আওয়ামী লীগ ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলে অভিহিত করে। ওই সময়ে গোপালগঞ্জ এবং আত্মীয়তা সূত্রে আমলা এম এ সাঈদকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার মনোনীত করে আওয়ামী লীগ। ব্যক্তিত্ববান এম এ সাঈদ তখন মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমি নিরপেক্ষ নই, কিন্তু নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করা আমার দায়িত্ব’। আওয়ামী লীগ তাকেও তিরস্কার করেছিল। এটা দুর্ভাগ্যজনক, রাজনৈতিক সরকারগুলো নির্বাচন কমিশনকে দলীয় স্বার্থ দ্বারা সংগঠিত করতে চায়। এমন সব ব্যক্তিকে নির্বাচনী দায়িত্ব দেয়া উচিত, যাদের ওপর সাধারণ মানুষের আস্থা আছে। ষোল কোটি মানুষের এই দেশ নিশ্চয়ই এমন দেউলিয়া হয়ে যায়নি যে, মর্যাদাবান মানুষের আকাল পড়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এবারে নির্বাচন কমিশনকে মনোনীত না করে তাদের অনুসৃত প্রতারণা কৌশল অনুযায়ী একটি ‘সার্চ কমিটি’ গঠন করে। এই সার্চ কমিটি গঠন করা হয় আওয়ামী বিশ্বস্ত এলিটদের দিয়ে। তারা অত্যন্ত যোগ্যতার সাথে একান্ত বিশ্বস্ত তাঁবেদারদের মনোনীত করে। শুরু থেকে এ পর্যন্ত তারা বিশ্বস্ততার উৎকৃষ্ট নমুনা উপহার দিয়েছে! বিতর্কিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে নির্বাচন কমিশনকে ক্ষমতায়ন করার ক্ষেত্রে কিছু কার্য ব্যবস্থা নেয়া হলেও এই কমিশন সেই ক্ষমতা প্রয়োগে অপারগতা প্রদর্শন করে। ২০১৪ সালে ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত কথিত নিয়ম রক্ষার নির্বাচনে তারা যে নৈতিক দেউলিয়াত্বের পরিচয় দিয়েছে সেটা সবারই জানার কথা। এরপর বিগত সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের কারসাজির চেহারা গোটা জাতি অবলোকন করেছে। এখন ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিতব্য পৌর নির্বাচনে তারা খেল দেখাতে যাচ্ছেন। এই প্রথমবারের মতো যখন দলীয় ভিত্তিতে নির্বাচন স্থানীয় সরকার নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তখন তারা সময়ের সঙ্কীর্ণতা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে সরকারি আনজামে সায় দেয়। প্রধান বিরোধী দল নির্বাচনী সময়সূচি কয়েক দিন পিছিয়ে দিতে বললেও তারা স্পষ্ট না বলে দেয়। ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করার জন্য তারা নির্ধারিত নির্বাচন কর্মকর্তাদের বাদ দিয়ে দলমুখী সরকারি কর্মকর্তাদের রিটার্নিং অফিসার হিসেবে নিয়োগ দেয়। ইতোমধ্যে নির্বাচনী প্রচারণায় খুন, জখম, গুম, সঙ্ঘাত হানাহানির ঘটনা ঘটলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সেনাবাহিনী মোতায়নের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১১ সালের ১২ থেকে ১৮ জানুয়ারি দেশের আড়াই শ’-এর মতো পৌরসভায় নির্বাচনের সময় সেনাবাহিনী মোতায়েন করেছিল কমিশন। এখন নির্বাচনব্যবস্থায় কারচুপি এবং কারসাজি রেকর্ড করায় সর্বশেষ ভরসা হচ্ছে গণমাধ্যম। এবার যাতে গণমাধ্যম নির্বাচন কেন্দ্রের ভেতরে ঢুকতে না পারে সে জন্য এক বাহিনী প্রধান পরামর্শ দিয়েছিল। ইলেকশন কমিশন সে নির্দেশ পালনে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছে। এ বিষয়ে নির্দেশ দিয়ে ইতোমধ্যে নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে চিঠি দেয়া হয়েছে। পাঁচ দফা নিদের্শনায় বলা হয়েছে: ১. প্রিজাইডিং অফিসারের অনুমতি ছাড়া কোনো সাংবাদিক ভোটকক্ষে প্রবেশ করতে পারবেন না। ২. সাংবাদিকেরা নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের কর্তব্য পালনে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। ৩. কোনো ধরনের নির্বাচনী উপকরণ স্পর্শ বা অপসারণ করতে পারবেন না। ৪. কোনো প্রার্থী বা রাজনৈতিক দলের পক্ষে বা বিপক্ষে কর্মকাণ্ড চালাতে পারবেন না। ৫. সংবিধান ও নির্বাচনী বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। স্পষ্ট করে ওই নির্দেশনায় বলা হয়েছে, ভোট দেয়ার গোপন কক্ষে তারা কোনোমতে প্রবেশ করতে পারবেন না। সাধারণভাবেই বোঝা যায়, নির্বাচনী কারচুপির কোনো প্রমাণ তারা রাখতে দেবে না। ইতঃপূর্বের নির্বাচনগুলোর ভিডিও এবং তথ্য প্রমাণ সরকার এবং নির্বাচন কমিশনকে বিব্রত করেছিল।
স্থানীয় সরকার নির্বাচনে যদি বিরোধী প্রার্থীরা সব আসনেও জয়লাভ করে তাহলে সরকার পতন হবে না। (অবশ্য নিরেট দল নিরপেক্ষ নির্বাচন হতো তাহলে অমন ফলাফল হতেও পারত) যদি এমন হয় তখন ইতঃপূর্বের প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনগুলোর ফলাফল অসত্য বলে প্রমাণিত হবে। দ্বিতীয়ত, সরকার একদলীয় ব্যবস্থা কায়েমের যে পরিকল্পনা নিয়েছে তা এ ধরনের একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। সুতরাং প্রথম থেকেই তারা সব ধরনের আইন-কানুন, নিয়ম-রীতি, ভব্যতা-সভ্যতা অগ্রাহ্য করে একরকম কাপড় ছেড়ে নেমেছে। ক. অনবরত মন্ত্রী-এমপি ও নেতারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করে চলেছেন। খ. নির্বাচনের আগেই হামলা-মামলা দিয়ে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করে বিরোধীদের মনোনয়নপত্র জমা দেয়া অসম্ভব করে তুলেছে। উদাহরণস্বরূপ বিএনপির দুর্গ ফেনী এবং নোয়াখালীতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র ও কাউন্সিলর নির্বাচিত হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গ. জোরপূর্বক মনোনয়ন প্রত্যাহারের খবর সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্টতার খবর পাওয়া গেছে। ঘ. বিএনপি এবং বিরোধী প্রার্থীদের প্রচারণায় আওয়ামী লীগ বারবার হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) আলতাফ হোসেন চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী আবদুল্লাহ আল নোমান এবং সাবেক চিফ হুইপ জয়নাল আবেদীন ফারুক আওয়ামী হামলার শিকার হয়েছেন। ঙ. বিরোধী দলের প্রার্থী ও সমর্থকদের বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। চ. বিভিন্ন এলাকায় আওয়ামী গডফাদাররা স্ব-স্ব বেষ্টনী তৈরি করেছে। উদাহরণ হিসেবে লক্ষ্মীপুর এলাকায় প্রকাশিত ‘তাহের আতঙ্ক’ এর উল্লেখ করা যায়। ছ. নির্বাচনী প্রচারণায় হত্যাকাণ্ড ঘটছে। মাটিরাঙ্গা পৌরসভা নির্বাচনে বিএনপির কৃষক দলের স্থানীয় সহসভাপতি নজরুল ইসলামকে হত্য করা হয়েছে। জ. আওয়ামী লীগের নেতারা মহিলাদের ওপরও হামলা করছে। কুষ্টিয়ার খোকশায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী মেয়র প্রার্থী ও এক কাউন্সিলর প্রার্থীর নারী সমর্থকদের ওপর হামলা করেছে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থীর সমর্থকেরা। ঝ. সরকারের গৃহপালিত বিরোধী দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ স্পষ্ট কারচুপির ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘সকাল ৯টার মধ্যেই ইলেকশন শেষ হয়ে যাবে’। ঞ. সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন আওয়ামী মহাজোটের ছোট শরিককেরা।
অবস্থাদৃষ্টে সহজেই মন্তব্য করা যায়, এই নির্বাচনও আগেকার নির্বাচনের মতো প্রহসনে পরিণত হবে। ইলেকশন কমিশন নির্বাচনের জন্য যে রাজনৈতিক সমঝোতার পরিবেশ প্রয়োজন তা নিশ্চিত করেনি। আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে রাখার আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। এখন যখন সেনা মোতায়েনের আহ্বান আসছে, তখন তারা সরকারি ভাষ্যেই কথা বলছে। নির্বাচনকালীন ইলেকশন কমিশন আইনগতভাবে সব ব্যবস্থাই নিতে পারে। কিন্তু মজার ব্যাপার তারা নিজেদের দায় অপরের মাথায় তুলে দিতে চায়। তারা স্থানীয় প্রশাসন এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যর্থতা নির্দেশ করেই তাদের দায়িত্ব পালন করতে চায়। যে দায়িত্ব তাদের প্রতি সাংবিধানিকভাবে আরোপিত সে দায়িত্ব পালনে তারা সরকার প্রধানের দোহাই দিয়ে দায় এড়াতে পারে না। ইলেকশন কমিশন অযোগ্যতা, অকর্মণ্যতা, অদক্ষতা, অনভিজ্ঞতা ইত্যাদি অনেক ‘অ’-এ বিভূষিত হচ্ছে। তাদের ক্ষমতা আছে প্রয়োগ নেই, তাদের দায়িত্ব আছে সমাপনে আগ্রহ নেই। তাদের চোখ আছে কিন্তু তারা দেখেন না। তারা কয়েক জন ব্যক্তি আছেন বটে কিন্তু তাদের ব্যক্তিত্বের স্ফুরণ নেই। এ কঠিন দায়িত্ব পালনের জন্য যে ঝুঁকি নেয়া দরকার সেটা সম্পূর্ণভাবেই তাদের মধ্যে অনুপস্থিত। হয়তো দলীয় অন্ধত্ব এবং সুবিধাবাদ তাদের পেয়ে বসেছে। সে জন্য তারা শুধু দুধ-ভাত খেতে চায়। আর ‘ডাণ্ডা মেরে’ সব ঠাণ্ডা করতে চায়। তাদের তুলনা করতে গিয়ে ছোট সময়ের ছড়া ‘বাবু রাম সাপুড়ে’ মনে পড়ছে। সেই যে পঙ্তিমালা.. ‘বাবু রাম সাপুড়ে/ কোথা যাস বাপুরে../ যে সাপের চোখ নেই / শিং নেই, নখ নেই / ছোটে নাকি হাঁটে না / করে নাকো ফোঁস ফাঁস/ মারে নাকো ঢুঁশ ঢাঁশ / নেই কোনো উৎপাত খায় শুধু দুধ ভাত.../ তেড়ে মেরে ডাণ্ডা করে দেই ঠাণ্ডা’।
Mal55ju@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.