চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানায় স্নাইপার রাইফেল, সেনা পোশাক উদ্ধার

চট্টগ্রামের হাটহাজারীর আমানবাজারে জঙ্গি
আস্তানায় অভিযানে উদ্ধার স্নাইপার রাইফেল,
গুলি, বিস্ফোরক ও সামরিক বাহিনীর পোশাক।
আটক জেএমবির দুই সদস্য (ইনসেটে) -যুগান্তর
ঢাকার পর এবার চট্টগ্রামে জঙ্গি আস্তানার সন্ধান পাওয়ার কথা জানিয়েছে নগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। হাটহাজারী উপজেলার আমানবাজার এলাকার ওই জঙ্গি আস্তানায় শনিবার রাতে প্রায় সাড়ে চার ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি একটি অত্যাধুনিক এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেল, ২৫০ রাউন্ড গুলি, দুই কেজি জেল এক্সপ্লোসিভ, ১৪টি সেনা পোশাক, বোমা তৈরির বিপুল পরিমাণ সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে ডিবি।
গোয়েন্দারা বলছেন, উদ্ধার করা রাইফেলটির সাহায্যে প্রায় ১৫০০ গজ দূরত্বের যে কোনো লক্ষ্যবস্তুকে নির্ভুলভাবে আঘাত হানা সম্ভব এবং এটি দিয়ে মিনিটে ৭৫০ রাউন্ড গুলি ছোড়া যায়। নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) দেবদাস ভট্টাচার্য সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে কখনও এ ধরনের অস্ত্র উদ্ধার হয়নি।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার জানান, হাটহাজারি থানার আমানবাজার এলাকায় চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের পাশে জয়নব কমিউনিটি সেন্টারের পেছনে হাজী ইছহাক ম্যানসন নামে ওই দোতলা বাড়ির নিচতলায় শনিবার রাত ১২টা থেকে রোববার ভোর সাড়ে ৪টা পর্যন্ত অভিযান চালান তারা।
তিনি জানান, ২৩ সেপ্টেম্বর নগরীর সদরঘাট এলাকায় তহবিল সংগ্রহে ছিনতাই করতে গিয়ে দুই জেএমবি সদস্যের মৃত্যু এবং ৫ অক্টোবর খোয়াজনগর এলাকায় গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে গ্রেফতার পাঁচ জেএমবি সদস্যদের বিষয়ে তদন্ত করছিল ডিবি। এরই অংশ হিসেবে শনিবার কাজীরদেউড়ি থেকে জেএমবি সদস্য নাইমুর রহমান ওরফে নয়নকে (২৭) গ্রেফতার করা হয়। তার দেয়া তথ্য অনুসারে কোতোয়ালি থানার নালাপাড়া থেকে জেএমবি সদস্য ফয়সাল মাহমুদ (২৬) এবং পাঁচলাইশের কসমোপলিটন লেন থেকে শওকত রাসেলকে (২৪) গ্রেফতার করা হয়। এরা তিনজনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের বিভিন্ন বর্ষের ছাত্র।
বাবুল আক্তার আরও জানান, গ্রেফতার তিনজনই চট্টগ্রামে জেএমবির প্রধান ফারদিন ওরফে পিয়াসের সহযোগী। তাদের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে আমানবাজারের ওই বাসায় অভিযান চালানো হয় এবং সেখান থেকে অস্ত্র ও গুলিসহ অন্যান্য সরঞ্জাম উদ্ধার হয়। সেখানেই থাকতেন জেএমবির চট্টগ্রাম অঞ্চলের কমান্ডার ফারদিন ওরফে পিয়াস। কিন্তু অভিযানের আগেই তিনি ওখান থেকে সরে পড়েন।
জেএমবির আস্তানা থেকে উদ্ধার করা বিস্ফোরক দিয়ে চারটি বহুতল ভবন উড়িয়ে দেয়া সম্ভব বলে জানিয়েছেন সিএমপি কমিশনার আবদুল জলিল মণ্ডল। এমকে-১১ স্নাইপার রাইফেলটি সাধারণ মানুষের পক্ষে ব্যবহার করা সম্ভব নয় বলেও জানান তিনি। রোববার সকালে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, জঙ্গি আস্তানা থেকে আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর পোশাকও উদ্ধার করা হয়েছে। জঙ্গিরা এসব পোশাক ব্যবহার করে অপরাধ করছে।
আস্তানাটি থেকে আরও উদ্ধার করা হয়- সামরিক নেমপ্লেট, ব্যাজ র‌্যাংক, সাংগঠনিক মানচিত্র, ডায়েরি এবং দাওয়াতি ও জিহাদি বিভিন্ন বইপত্র। এর সঙ্গে পাওয়া গেছে জেএমবির কাজের ছক সংক্রান্ত সাংগঠনিক মানচিত্র, ডায়েরিতে সাংকেতিক বিভিন্ন নির্দেশনা ও সংকেত, কর্মকাণ্ডের বিবরণ। এসব নথিপত্রের মধ্যে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় পুলিশ সদর দফতর থেকে জারি করা একটি স্পর্শকাতর নির্দেশনাও আছে। গোপন আদেশের নথি জঙ্গিদের কাছে কীভাবে পৌঁছল, তা নিয়ে বিস্মিত খোদ পুলিশ।
এর আগে বুধবার মধ্যরাত থেকে ঢাকার মিরপুরের এক বাড়িতে ১৫ ঘণ্টা ধরে অভিযান চালিয়ে জেএমবির তিন সদস্যসহ সাতজনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই বাসায় পাওয়া যায় ১৬টি হাতে তৈরি গ্রেনেড, ককটেল ও ‘সুইসাইড ভেস্ট’।
উপ-কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার যুগান্তরকে জানান, আমাদের কাছে তথ্য ছিল ফারদিনের আস্তানা থেকে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা করা হচ্ছিল। আর কয়েক দিন সময় পেলে তারা বড় ধরনের নাশকতা ঘটাতে সক্ষম হতো। এ অভিযানের মধ্য দিয়ে জেএমবির চট্টগ্রামে বড় ধরনের ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা বানচাল করা গেল। এদিকে ঘটনায় অস্ত্র ও বিস্ফোরক আইনে হাটাহাজারী থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছিল বলে রোববার রাতে যুগান্তরকে জানায় পুলিশ।
‘পরিচয় গোপন করে’ বাসা ভাড়া : হাজী ইসহাক ম্যানশনের মালিক হাজী মো. ইসহাক জানান, ব্যাচেলর ভেবে ভাড়া দিতে রাজি হইনি। কিন্তু সে (ফারদিন) বলল, তার স্ত্রী-সন্তান আছে, শহরে ব্যবসা করে। এমন পরিচয়ে ছয় মাস আগে মাসে ছয় হাজার টাকায় বাসাটি ভাড়া নিয়েছিল। তবে সে তার নাম বলেছিল ‘নাফিস’। তার স্ত্রী ও এক বছর বয়সী নুসাইবা নামে এক কন্যা ছিল। নাফিসের একটি লাল (পালসার) মোটরসাইকেল ছিল। তবে বাসায় বেশি থাকত না। সব সময় স্ত্রী আর মেয়েকে নিয়ে বাইরে থাকত। মাসে সর্বোচ্চ ৮-১০ দিন বাসায় থাকত।
ইসহাক আরও জানান, তাকে দেখে আপনি কখনও ভাবতে পারবেন না যে, এমন একটা কাজের সঙ্গে সে জড়িত। তার ব্যবহার ছিল অমায়িক। সব সময় নিচু স্বরে কথা বলত, যথা সময়ে বাসা ভাড়া দিয়ে দিত। আমি তো এখন অবাক। এগুলো কি মুসলমানের কাজ?
কোরবানির ঈদের আগে তার বউ তাদের বাড়িতে চলে গেছে। এরপর থেকে সে এখানে আসত রাতে। আর সকালে কেউ ঘুম থেকে উঠার আগেই সে বাইরে চলে যেত। তাছাড়া ৩-৪ দিন আগে ঢাকায় বাড়ি যাওয়ার কথা বলে সে আর বাসায় ফেরেনি। এরপর থেকে বাসা তালাবদ্ধ ছিল।
এ ব্যাপারে অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (উত্তর-দক্ষিণ) বাবুল আক্তার সাংবাদিকদের বলেন, সে (ফারদিন) ভিন্ন ভিন্ন স্থানে একেক নামে দু’চার মাসের জন্য বাসা ভাড়া নিয়ে এসব কাজ করে যাচ্ছে। যেমন সে এখানে বাসা ভাড়া নেয়ার সময় নাফিস নাম ব্যবহার করে ভাড়া নিয়ে মূলত ফারদিনই বাসাটিকে তার আস্তানা হিসেবে ব্যবহার করছিল। ফারদিনকে আমরা এবারও ধরতে পারিনি। তবে তাকে আটকের প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

No comments

Powered by Blogger.